ব্যাঙমানবীদের আমি প্রথম দেখেছিলাম খুব ছোটবেলায়। তখনো আমাদের শহর সেভাবে মজবুত হয়ে গড়ে ওঠেনি। মাত্র কয়েক বছর আগে হয়েছে শহরের গোড়াপত্তন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন চারিদিকে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা চলছিল, তখন আমরা ডজনখানেক পরিবার মূল জনপদ থেকে অনেক, অনেক দূরে সরে এসে এখানে বসতি গড়েছিলাম। পরে লোকমুখে খবর পেলাম, জনপদগুলোও যুদ্ধে গুড়িয়ে গেছে। জীবিত মানুষের সন্ধান পাওয়াই এখন দুষ্কর। নগরীর পর নগরী, জনপদের পর জনপদ শুধুই ধ্বংসলীলা, কোথাও জীবনের সন্ধান নেই। সেই সময়টাতে আমরা সবকিছু ছেড়েছুড়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে চলে আসি বসতি গড়ার জন্য। পেয়েও যাই একটি সবুজ উপত্যকা। একটি ঝর্ণা রয়েছে উপত্যকার ধারে, রয়েছে একটি গভীর কুয়ো। পানির জন্য আমাদের তেমন চিন্তা করতে হয়নি। খাবারের জন্যও না। জঙ্গলে শিকার করে কিংবা ফলমূল সংগ্রহ করে খেতাম আমরা। কেউ কেউ চাষবাষও শুরু করে দিয়েছিল।
কিছুদিন পর আমাদের সাথে আরো কিছু পরিবার এসে যোগ দেয়। দেখতে দেখতে জঙ্গলের মাঝখানে অনেক খানি জায়গা উজার করে একটি ছোটখাটো শহর, একটি ছোটখাটো সভ্যতা গড়ে তুললাম আমরা। আমাদের সাথে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এই একটি জিনিসের তেমন অভাব নেই, আগ্নেয়াস্ত্র। যে কোন ধ্বংস জনপদের আনাচে কানাচে চাইলে অনেক অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে।
তখনই হঠাৎ একদিন ওদের দেখতে পাই আমরা। আমার মা উপত্যকার ধারে যে কুয়োটা রয়েছে, সে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য দড়ি বেঁধে বালতি ছুড়েছিল পানির ভেতর। অমনি ভেতর থেকে অদ্ভুত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ শোনা গেল। মা চিৎকার করে উঠল। আমরা সবাই ছুটে গেলাম তার চিৎকার শুনে। শহরের প্রহরার দায়িত্বে থাকা তরুণ ছেলেরা বন্দুক বাগিয়ে দৌড়ে এল। কুয়োর ভেতর থেকে লাফ দিয়ে উঠে এল একটি অদ্ভুত জন্তু। আমরা কেউ এমন কিছু আগে কখনো দেখিনি। পিচ্ছিল শরীর তার। ব্যাঙের মতো অনেক দীর্ঘ, ভাজ করা হাত এবং পা। কিন্তু মুখমণ্ডল, গলা এক ধরনের মেয়েলী গড়নে তৈরি। এক রকম কলা পাতার আবরণে শরীর ঢাকা তার, যেন পাতার তৈরি পোশাক পরেছে। মাথায় বেশ ঝাঁকরা চুলও আছে। শুধু চোখগুলো টকটকে লাল রঙা। চোখের মনির চারিদিকে সাদা অংশের জায়গায় অদ্ভুত রকম সুন্দর লাল রঙ, যেন মাছের কানকোর লাল। প্রাণীটা আমাদের দেখে সাপের মতো লকলকে, তিন ভাগে চেরা জিভটা বের করে অদ্ভুত রকম ফোঁস ফোঁস শব্দ করল। তারপর তীব্র গতিতে ছুটে পালাল লম্বা লম্বা হাত পা ব্যবহার করে।
শহরের সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এমন প্রাণী দেখে। কেউ বাপের জন্মে এমন কোন প্রাণী দেখেনি কিংবা এমন কোন প্রজাতির কথা শোনেনি।
শহরে কোন জীববিজ্ঞানী ছিল না। তাই কেউ প্রাণীটা আসলে কি, সে সম্পর্কে কেউ ধারণা দিতে পারল না। দু’জন ডাক্তার ছিল, তারাও এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারল না।
সে রাতে শহরে আলোচনা সভা বসল। এই প্রাণীটি নিশ্চয়ই একা নয়, এর মতো আরও আছে এখানে। থাকলে তারা আমাদের জন্য হুমকি কিনা সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। এরা কতটা বুদ্ধিমান সেটাও একটা প্রশ্ন। এদের গায়ে কাপড়মতো কিছু ছিল, তার মানে শুধু বুদ্ধিমত্তাই নয়, সমাজবদ্ধ জীবনও হয়তো তাদের আছে।
আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণ হলো পরে। আস্তে আস্তে আমরা আবিষ্কার করলাম, এই প্রাণীগুলো শুধু এখানে না, আশেপাশে সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এবং তারা তেমন বুদ্ধিমানও নয়। আমাদের উপত্যকার পেছনে একটি কচু গাছে ছেয়ে যাওয়া জঙ্গল ছিল। বড় বড় কচুগাছ সেখানে, চার-পাঁচ ফুট হবে। কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আছে কচুগাছগুলো। এই কচুবনে আমরা প্রচুর ব্যাঙমানবী আবিষ্কার করলাম। প্রতিটি কচু পাতার নিচে একটি করে ব্যাঙ। এটাও বুঝতে পারলাম তারা আমাদের জন্য মোটেও হুমকি নয়। তারা চুপচাপ থাকে। পোকা মাকড় ধরে খেয়ে বেড়ায়। জলায়, ডোবাতে কিংবা কোন কুয়োর ভেতর ব্যাঙের মতো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়। তাদের মধ্যে নারী পুরুষ আলাদা আছে কিনা বোঝা গেল না। কারণ সবার চেহারাই মেয়েলী। কেঁচোর মতো উভলিঙ্গ নিশ্চয়ই নই। তবে কোনটা ছেলে, কোনটা মেয়ে সেটা বোঝার উপায় নেই।
ব্যাঙমানবীরা যে সুখাদ্য হতে পারে সেটা একদিন শহরের কিছু ডানপিটে ছেলে আবিষ্কার করে ফেলল। তারা শিকারে বেরিয়েছিল সেদিন। শিকার টিকার না পেয়ে শেষে একটা ব্যাঙমানবী ধরে আনে এবং শহরে এসে আগুনে পুড়িয়ে খায়। অদ্ভুত সুস্বাদু নাকি সেই মাংস। ব্যাঙ-মানবীদের মানবী বললেও তারা তো আর মানুষ নয়, হয়তো উন্নত প্রজাতির কিছু ব্যাঙ। তাই দুয়েকজন আপত্তি জানালেও একসময় গা সওয়া হয়ে যায়। অনেকেই ব্যাঙমানবীদের ধরে ধরে খেতে থাকে।
একটা ব্যাঙমানবীকে আমার তখন খুব ভালো লেগে যায়। আমি যেখানে খেলাধুলো করতে যেতাম, সেখানে প্রায়ই আসত সেটা। লাফ ঝাপ দিয়ে আমার আশেপাশে ঘুরত। ছোট ছিলাম, একা একা খেলাধুলো করতাম, আমার বয়সী তেমন কেউ ছিল না, তাই ব্যাঙটাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে ভালোই লাগত। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে থাকি, ব্যাঙ মানবীর সাথে আমার বন্ধুত্ব গভীর থাকে। একসময় সে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকত। বাবা মা কিংবা বড় কেউ তেমন কিছু বলত না। ব্যাঙটাকেও কেউ ঘাঁটাত না।
শহরে পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল, ছোটখাটো স্কুল ছিল একটা। আর বই ছিল প্রচুর। বড়রা যে যেভাবে পেরেছে, দূর দূরান্তের পরিত্যক্ত জনপদে গিয়ে বই পুস্তক সংগ্রহ করে এনেছে, নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে। সে সব বই পড়ে আমি গণিত, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভূগোল, সমাজ ইত্যাদি শিখতে থাকি। আমার সঙ্গে সেই ব্যাঙমানবীও থাকত সারাক্ষণ। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে ব্যাঙ পোষা শুরু করল, আর সেটাই ছিল কাল। ব্যাঙমানবীরা তুলনামূলক ভাবে অন্য প্রাণীদের থেকে বুদ্ধিমান তা আঁচ করে নিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু এতটা বেশি তা আশা করিনি। আমরা যা শিখতাম, যা করতাম, ওরাও আস্তে আস্তে সব শিখে নিতে লাগল, অথচ আমাদের বুঝতেও দিল না। আগের মতোই শান্ত, নির্বিরোধী, বোকা সেজে থাকত।
তারপর একদিন হলো সেই সামরিক অভ্যুত্থান। আমরা যেমন বিভিন্ন পরিত্যক্ত-ধ্বংস জনপদ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আনতাম, বই সংগ্রহ করে আনতাম, ওরাও আনত। আমাদের জানতে দিত না। ওরা নিজেরা সে সব অস্ত্র শস্ত্র পরিচালনা শিখে নেয়। তারপর একদিন আক্রমণ করে বসে। ব্যাঙদের অগঠিত হাত দিয়ে অস্ত্র পরিচালনা সম্ভব সেটা আমরা কেউ কল্পনাও করিনি। সেদিন প্রথম জানলাম। তবে দেরি হয়ে গিয়েছিল, করার কিছু ছিল না তেমন। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করে ওরা, কয়েকশো ব্যাঙ এক সাথে, সাথে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। প্রথমে যতটুকু সম্ভব প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা আমরা করেছিলাম বটে আমরা, তবে সফল হইনি। আমাদের ১৪ বছরের গড়া নগরী ধ্বংস হয়ে যায় একরাতেই। শহরের প্রতিটি মানুষ মারা যায় সে রাতে।
সবাই যদি মারা যায় তাহলে এই গল্পটি বলছে কে? কেউ কি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল? না, কেউ বাঁচেনি। এই গল্পটি আমি সেই ছেলেটার মতো করে বলতে চেষ্টা করেছি, যে প্রথম ব্যাঙমানবীদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল। আমি হলাম সেই ব্যাঙ মানবী, যে মানুষের প্রথম বন্ধু, প্রথম পোষ্য ছিলাম।
মানুষের পর এই নগরীতে আমরা বসবাস করছি, মানুষের ইন্টেলেকচ্যুয়াল কাজগুলো সব আমরা শিখে নিয়েছি। এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মানুষ যখন আমাদের ধরে ধরে খাওয়া শুরু করল, তখন এটাই বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল আমাদের। শক্তিশালীরা টিকে থাকবে, দুর্বলরা বিলীন হবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
পৃথিবীতে আর কোথাও কোন মানুষ অবশিষ্ট আছে কি না জানি না, তবে তারা যদি কখনো এই নগরীতে আসে, আমাদের সাথে লড়াই করে নগরীর দখল আদায় করতে হবে তাদের। নতুবা পৃথিবী ছেয়ে যাবে ব্যাঙমানবীতে।
(সমাপ্ত)
এই সিরিজটা শুরু করেছিলাম বছরখানেক আগে। ঘুমোলে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতাম বলে স্বপ্নগুলো লিখে রাখতাম ঘুম থেকে উঠে। সেখান থেকে গল্প লিখতাম। এভাবে চারটা পর্ব লিখেছিলাম। কাজে এসেছিল লেখাগুলো। আমার দুঃস্বপ্ন দেখা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তখন। আজকাল আবার দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। অনেক রকম দুঃস্বপ্ন। বেশিরভাগই জীবনের নানা ধরনের জটিলতা সংক্রান্ত। তবে কিছু কিছু বেশ ভয়ংকর। যেমন গতকাল স্বপ্নে দেখলাম-একটা পাহাড়ের উপর আমরা কয়েক জন মানুষ বসে আছি, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে প্রচন্ড। পাহাড়ের নিচে মেয়েলী চেহারার বড় বড় কিছু ব্যাঙ কচুপাতার নিচে বসে আছে। আমাদের মধ্যে একজন বলে উঠল-আমাদের খাবার ফুরিয়ে এসেছে, এগুলো খাওয়া যায়। বলেই বল্লম দিয়ে ব্যাঙটাকে গেঁথে ফেলল মাটির সাথে। বাকী ব্যাঙগুলো পালিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেল।
ভাবছি সিরিজটা নতুন করে শুরু করব আবার।
এই সিরিজের অন্য গল্পগুলোঃ
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ শয়তানবিদ্যা
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ অবসেশন
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ আয়না-ভীতি
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ কুকুরের ডাক
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:১২