কুসংস্কারে এখনও আচ্ছন্ন তামিলনাডু
তামিলনাডুর তিরুচ্চি এবং নামক্কাল জেলার লাগোয়া একদম প্রত্যন্ত গ্রাম বাভিথরাম ভেল্লালাপাট্টি। বিজয়া দশমীর দিন সকাল। প্রাচীন শ্রী আচ্চাপান মন্দিরের বাইরে বিশাল ভিড় মহিলা, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। একদল নানা বয়সী মহিলা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন মন্দিরের একদিকে। মন্দিরের বার্ষিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে বৃদ্ধা মিলিয়ে প্রায় ২হাজার মহিলা বসে আছেন, তাঁদের চোখে-মুখে আতঙ্ক, ভয়। তীব্র রোদে একটানা পাঁচ ঘন্টা বসে থাকার পরেই প্রথামাফিক পোষাক পরে এলেন মন্দিরের পুরোহিত। আর এসেই সপাটে বেতের চাবুক মারলেন এককোণে জবুথবু হয়ে বসে থাকা নানা বয়সী ঐ মহিলাদের ওপর। আকাশ বাতাস মথিয়ে করে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলেন তাঁরা। তাতে কোনো পাত্তা না দিয়ে পুরোহিত একের পর এক বেতের বারি চালাতে লাগলেন। কলেজ ছাত্রী থেকে শুরু করে মহিলারা সকলেই নিশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁসিয়ে উঠলেন। পিঠের ওপর থেকে এক খাবলা ছাল উঠে গিয়ে মাংস বের করে দিলো। ব্যথায় যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেও বারচানোর জন্য এগিয়ে আসবে না কেউই। কারণ এঁদের সকলকেই নাকি ‘ভুতে ধরেছে।’ যে কোনো ধরণের অস্বাভাবিক আচরণের একই ব্যাখ্যা দিয়ে মহিলাদের নিয়ে আসা হয় এই মারণ ভূমিতে। তবে শুধু মহিলাদেরই আনা হয়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই ‘ভুত’ শুধু মহিলাদের ওপরই ভর করে!
মন্দিরের কাছাকাছিই এক গ্রামে থাকে বছর ১৬’র বনিতা। পড়াশোনায় সে ধারাবাহিকভাবে ফল ভালো করছে না। মন লাগছে পড়াশোনায়, তাকে ‘জিন’-এ ধরেছে—এই অভিযোগ মা-বাবার। তাই বনিতাকে নিয়ে আসা হয়েছে মন্দিরের সামনের মাঠে, বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আরো এমন হাজারো মানুষের সামনে। বনিতা আসতেই চায়নি, কারণ স্কুলে জানাজানি হলে তার সঙ্গে আর কোনো বন্ধু কথা বলতে এগিয়ে আসবে না, তাকে দেখবে সন্দেহের চোখে। শুধু বনিতাই নয়, ডিন্ডিগুল জেলার প্রায় একই বয়সী আরেকটি মেয়ে। তাকেও নিয়ে আসা হয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার শারিরীবৃত্তিয় ক্রিয়াগুলি শুরু না হওয়ার জন্য। এক বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে আসা হয়েছে শুধুমাত্র তার শ্বশুর বাড়ির লোকের ধারণা তার মধ্যে ‘জিন’ ভর করেছে, তার ভিত্তিতে। আর পুরোহিত? তার সদম্ভ ঘোষণা, কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা এই প্রথাকীভাবে বদল করা যাবে?
সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে সমস্যা হোক অথবা শারীরিক অসুবিধা কিংবা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সমস্যা অথবা ব্যবসায়িক জটিলতা — সব সমস্যার সমাধান আছে চিন্নাইয়ার কাছে। চিন্নাইয়া মানুরাইয়ের ভেল্লিমাল্লাইয়া গ্রামের প্রখ্যাত ওঝা। ‘ভূত ছাড়ানো’ই নয়, চিন্নাইয়ার দাবি এই সমস্ত কাজ সে করতে পারে।
শুধু চিন্নাইয়াই নয়, ভেল্লিমাল্লাইয়া গ্রামে কমপক্ষে ৬ জন ‘ভূতের ওঝা’ আছে। যারা নিজেদের ঈশ্বরের দূত হিসেবে প্রচার করে। ঈশ্বরের নির্দেশেই তারা নাকি ‘ভূতে পাওয়া’ বা ‘ভূতে ধরা’ কিশোরী ও মহিলাদের চাবুক মারে! সাত থেকে সত্তর— সব বয়সী মহিলারাই এদের হাতে ‘দেবতার নির্দেশে’ চাবুক খায়। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এই ঘটনাকে কারোর নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক মধ্যযুগীয় বর্বরতা মনে হলেও ভেল্লিমাল্লাইয়ের ভূতের ওঝারা এর জন্য বেশ গর্বিত।
মহিলাদের নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা অথবা মানসিক অবসাদ ইত্যাদির কারণে যে সব মহিলাদের মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়, তাদেরই ভূতে ধরেছে বলে প্রচার করা হয়। তাছাড়াও নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক কারণেও একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী বহু মহিলাকে ভূতে ধরেছে বলে রটিয়ে দেয়।
সামাজিক কলঙ্ক, সচেতনতার অভাব, লিঙ্গ পক্ষপাতপূর্ণতা ইত্যাদি নানা কারণে মানসিক অবসাদগ্রস্ত মহিলাদের যথাযথ চিকিৎসা করানো হয় না। দীর্ঘ কুসংস্কারের রীতিতে অভ্যস্ত পরিবারের লোকেরাই বাড়ির ছোট মেয়ে থেকে প্রবীণা-বৃদ্ধাদের নিয়ে আসে চাবুক মারাতে। আবার চিকিৎসার বিপুল খরচ চালাতে পারবেন না বলে অনেকে বিনা চিকিৎসার মানসিক রোগিণীকে ‘কর্মা’-র ভরসায় নিয়ে আসেন আছাপ্পান মন্দিরে।
শুধু চাবুকেই শেষ নয়, কোয়েম্বাটোর জেলার পেরিয়ানাইকেনপালায়মে এক ‘সাধু’ তলায় কাঁটা কাঁটা দাঁত আছে এমন জুতো পরে ‘এক একজনকে মহিলাকে দশবার করে চাবুক মারে। কেউ বলতে পারবে না আমার কাজে কোন ঘাটতি আছে।’ গর্বের সঙ্গেই জানালেন চিন্নাইয়া।
মাদুরাইয়ের পাহাড়ি টিলার ওপর ছোট্ট গ্রাম ভেল্লিমাল্লাইয়াই নয়, তামিলনাডুর প্রায় সমস্ত গ্রামেই এ ধরনের ‘ঈশ্বরের দূত’ বা ভুতের রোজা আছে। ভূত ছাড়ানোর নামে মহিলাদের চাবুক মারার নারকীয় বর্বরতা চলছে। কয়েক শতক ধরে।
রাজ্য সরকার নিশ্চুপ, উদাসীন। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর তিরুচি জেলার ভেল্লালাপাট্টি গ্রামে অসংখ্য মহিলাকে এভাবেই চাবুক মারা হলো। নির্বিকারভাবেই তা দেখলো প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরাও। প্রতি বছরই বিজয়া দশমীর দিন এভাবেই মহিলাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে চাবুক মারা হয়। ভেল্লালাপাট্টির স্থানীয় আছাপ্পান মন্দিরেই প্রতি বছর মহিলাদের এভাবেই চাবুক মারা হয়। মহিলাদের গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটেছেন। ঐ মহিলারা মনে করেন তাঁদের যে ‘পাপ’ আছে তা সব খাক হয়ে যাবে এর ফলে।
গবেষক, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং লোকাচার বিদ্যার বিশেষজ্ঞদের অভিমত প্রায় ২ হাজার বছর ধরে তামিল সমাজে মহিলাদের ওপর চাবুক মারার এই নারকীয় প্রথা চলছে। লোকাচার বিশারদরা যেমন এর সমক্ষে বহু প্রাচীন তামিল সাহিত্যকে তুলে ধরছেন, তেমনি বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিকরাও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে এই বিষয়টিকে উত্থাপন করছেন। তবে কারো কারো মতে তথাকথিত অশুভ শক্তির হাত থেকে মুক্তির নামে মহিলাদের চাবুক মারার প্রথা গত ২০০ বা ৩০০ বছর আগে থেকে শুরু হয়। মধ্যযুগীয় এই বর্বরতা এখনো চলছে স্বার্থান্বেষীদের সাহায্য করার জন্যই। কখনো সম্পত্তি, জমির দখল, কখনো বা পারিবারিক বিবাদের জেরে অসহায় মহিলাদের জোর করে এই অমানবিক প্রথাগুলির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
দু’শো বছর হোক বা দু’হাজার, বিষয়টি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় কিভাবে চলতে পারে প্রশ্ন সেখানেই। যেখানে একটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার চলছে, সেখানে প্রশাসনের নাকের ডগায় এখনও এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় বর্বরতা কিভাবে চলছে প্রশ্ন তা নিয়েই।
২০০২ সালে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এই নিয়ে একটি রিপোর্ট দেয় সরকারের কাছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাজ্য সরকার মন্দিরে মন্দিরে ‘ভূত ছাড়ানোর কাজ’ নিষিদ্ধ করে। এরপরেও যথারীতি রমরমিয়ে চলছে ‘ভূত তাড়ানো’র কাজ। তিরুচি জেলার কালেক্টর টি সৌন্ডিয়া, পুলিস প্রশাসনের সামনেই বিজয়া দশমীর দিন চাবুক মারার ঘটনা ঘটেছে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। সৌন্ডিয়া জানালেন, উপায় কী? জোর করে এই ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করতে গেলে মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লাগে। এর ফলে তারা ভোট বয়কটের দিকে চলে যায়। এছাড়াও জোর করতে গেলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকছেই ফলে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভারও আসবে প্রশাসনের ঘাড়েই। অতএব...
তবে তামিলনাডু মহিলা কমিশন বিষয়টিকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই গ্রহণ করেছে। ‘মহিলাদের ওপর যখন এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে আমরা তখন নীরব থাকবো না। এটা স্বৈরাচার। এটা চলতে দেওয়া যায় না। এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে আমরা সমস্ত পদক্ষেপ নেবো। জানিয়েছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন কে এম রমানাথাল।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী ইউ বাসুকি জানিয়েছেন, ‘এই ঘটনা সর্বার্থেই মহিলাদের স্বার্থের বিরোধী। এবং সভ্য সমাজের পক্ষেও তামাশা। ঐতিহ্যের নাম করে অপরাধীরা ছাড় পেতে পারে না। চাবুক মারা একটা সামন্ততান্ত্রিক কার্যপ্রণালীর অংশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর কোনো জায়গা থাকতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ভারত নিজেকে বিশ্ব নেতৃত্বে তুলে ধরতে চাইছে তখন উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে অবশ্যই বিজ্ঞানমনস্কতা এবং লিঙ্গ সংবেদনশীলতা গড়ে তুলতে হবে।
ঠিক এই জায়গাটাকেই চিহ্নিত করেছেন প্রখ্যাত মনোবিদ গীতা মেনন।
‘ভেল্লালাপাট্টির মতো পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে মেয়েদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ আসবেই। আমি জানি না কেন এ ধরনের ঘটনাকে মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার বলে গণ্য করা হবে না এবং প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?