প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
আজকের দিনটা শুভ্র আর নিলার জন্য একেবারেই অন্যরকম। গতকাল পর্যন্ত তারা ছিল খুব ভাল বন্ধু, অথচ একদিনের ব্যবধানেই সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের গন্ডি পেরিয়ে তারা এখন প্রেমিক-প্রেমিকা, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তাদের। ঠান্ডা হিমহিম হাওয়ার পরিবেশে সংসদ ভবন এলাকার মনোরম পরিবেশে বসে থাকতে তাদের আজ ভালই লাগছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর প্রথম কথা বলে উঠল শুভ্রঃ
-কিরে চুপ করে আছিস কেন নিলা? কিছু বল…
-কি বলব, আমার খুব লজ্জা লাগছে।
-লজ্জা! কিসের লজ্জা!
-কাল পর্যন্ত তুই আর আমি শুধু বন্ধুই ছিলাম, আর আজ….
-(দুষ্টুমি হাসি হেসে শুভ্র’র প্রশ্ন)আজ কি?
-(লাজুক হাসিতে নিলার উত্তর)জানিনা যাহ্…
(নিলার লজ্জাবনত মুখ দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল শুভ্র)
-লজ্জা যে নারীর ভূষণ, তোকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।
-(কপট রাগ দেখিয়ে) বেশী বুঝিস না?
(এবার একটু সিরিয়াস স্বরে শুভ্র’র উত্তর)
-সত্যিই নিলা, আজকের দিনটা অনেক ডিফারেন্ট, তাই না?
-হুমম। আজ থেকে তোর আর আমার সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিল। আসলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলতে যা বোঝায়, সেটা তোকে দেখে আমার হয়নি, গত সেমিস্টারেই তো তোর সাথে আমার পরিচয়, তখন তোকে আর দশটা ছেলের মতই সাধারণ মনে হয়েছে। কিন্তু যতই দিন পার হয়েছে, ততই তোকে নতুন করে চিনেছি।
-আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই, গত সেমিস্টারে তোকে যখন প্রথম দেখি, মনে হয়েছে আর দশটা ধনী বাবার একমাত্র মেয়ের মত তুই-ও অনেক দেমাগী। কিন্তু যতই আমাদের বন্ধুত্বের দিনগুলো পার হয়েছে, ততই তোকে মনে হয়েছে শান্ত স্বভাবের একটা মেয়ে, যে বন্ধুর জন্য সবকিছু করতে পারে।
-আচ্ছা শুভ্র, একটা কথা বলতো, এই যে আমাদের সম্পর্কের নতুন মোড়, এটা ক্ষণিকের মোহ নয়তো? এমন যদি হয়, এটা শুধুই ক্ষণিকের মোহ, কিছুদিন পরেই এই মোহ কেটে যাবে, এমন হবে না তো?
-ধুর কি যে বলিস! মোটেও সেরকম কিছু হবেনা। এরকম ক্ষণিকের মোহ হয় তখন, যখন সম্পর্কটা শুরু হয় আচমকা, ভালোবাসার প্রকাশটা হুট করেই হয়ে যায়। তোর আর আমার ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। আমরা কিন্তু অনেকদিন ধরেই ভাল বন্ধু, সেই নিগাঢ় বন্ধুত্বের ভিত এর কারণেই কিন্তু আজ আমাদের এই নতুন সম্পর্ক। যে সম্পর্ক এরকম মজবুত ভিত-এর উপর তৈরী হয়, সে সম্পর্ক কখনো নষ্ট হতে পারেনা।
-তাই যেন হয়।
-তাই হবে, তুই দেখিস।
-আচ্ছা আরেকটা কথা, আমাদের এই রিলেশনের ব্যাপারে শাওনদেরকে জানানো উচিৎ না?
-হ্যাঁ তা তো বলতেই হবে, এই রিলেশন তো লুকিয়ে রাখার কোন ব্যাপার না। তবে এখনই না, নেক্সট উইক-এ পরীক্ষাটা শেষ হোক। তারপর আমাদের যে প্ল্যান ছিল ঢাকার বাইরে যাওয়ার, ওখানে গিয়ে সুযোগ বুঝে বলা যাবে সবাইকে। এখন কাউকে বলিস না।
-ঠিক আছে। আচ্ছা সন্ধ্যা হয়ে আসছে, চল আজ উঠি।
-হ্যাঁ চল।
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। নিলার দেরী দেখে মা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেনঃ
-কিরে কোথায় গিয়েছিলি? এত দেরী হল যে?
-এই তো মা, শুভ্রর সাথে একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা।
ফ্রেশ হয়ে নিয়ে পড়তে বসল নিলা। সময় আর বেশী বাকি নেই, আজকালের মধ্যেই সিলেবাস শেষ করতে হবে………।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসল। সবাই শেষ মুহুর্তের প্রিপারেশন নিয়ে ব্যস্ত। কাল নার্গিস ম্যাডামের সাবজেক্টের পরীক্ষা। এই সেমিস্টারে এই সাবজেক্টটাই শুভ্রদের বেশী ভোগাচ্ছে, একগাদা এসাইনমেন্ট,টিউটোরিয়াল এসব পার হয়ে কাল ফাইনাল পরীক্ষা, কি যে হয় আল্লাহ্ই জানে। যাকগে এখন এত ভেবে কাজ নেই, কাল যা হওয়ার হবে, এই ভেবে শুভ্র রাতের খাওয়া শেষে ঘুমাতে গেল তাড়াতাড়ি। পরীক্ষার আগের রাতে এমনিতেই তার রাত জাগার অভ্যাস নেই। তাছাড়া তাড়াতাড়ি ঘুমাতে না গেলে সকালে উঠতে দেরী হয়ে যাবে, তখন পরীক্ষার হলে সময়মত পৌঁছতে পারবেনা।
সকালে ঠিক সময়মতই পরীক্ষার হলে পৌঁছল শুভ্র। পৌঁছেই দেখে বাকিরা শেষ মুহুর্তের প্রিপারেশনে ব্যস্ত। পরীক্ষার টেনশানে কেউ ঠিকমত কথাই বলছেনা। শুভ্র তাই ভাবল এখন কারো সাথে কথা না বলাই ভাল, পরীক্ষা শেষ হোক, তখন কথা বলা যাবে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে শুভ্র,নিলা,শান্ত,দিপা,শাওন আর ফারজানা নিচে নেমে বটতলায় আসল চা খেতে। চা খেতে খেতে পরীক্ষা সংক্রান্ত টুকটাক কথা হলো সবার মাঝে। পরীক্ষা সবারই ভালো হয়েছে। সবাই খুব টেনশনে ছিল আজকের পরীক্ষা নিয়ে, কারণ আজকেরটাই সবচেয়ে টাফ। আজকেরটা যখন ভালোয় ভালোয় উতরে গেছে সবাই, বাকী দুটো নিয়ে তেমন টেনশন নেই। তবুও কাল পরশু পরপর দু’দিন পরীক্ষা, আজ বেশীক্ষণ আড্ডা দেয়ার সময়ও নেই। চা খাওয়া শেষ করে যে যার মত বাসায় ফিরল।
দেখতে দেখতে বাকী দুটো পরীক্ষাও শেষ হল। আহ্ কি শান্তি! আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা শেষে বের হয়ে সবাই ক্যান্টিনে বসল আড্ডায়। আজ প্রথমেই কথা বলে উঠল শান্তঃ
-উফ, যাক বাবা। এট লাস্ট পরীক্ষা শেষ হল। নেক্সট টু উইকস নো টেনশন।
-(শাওনের উত্তর) তা যা বলেছিস, এই সেমিস্টারে চরম ধকল গেল আমাদের। এবার একটু রিলাক্সের টাইম। আচ্ছা শুভ্র, আমাদের আউটিং এ যাওয়ার প্ল্যানটার কি হলো?
-হুমম…প্ল্যান তো আছেই। তোরাই বল কোথায় যাওয়া যায়?
-(শান্ত বলল) দূরে কোথাও না যাওয়াই ভালো, কারণ দূরে কোথাও যেতে হলে মিনিমাম একদিন স্টে করতে হবে ওখানে। মেয়েদের গার্ডিয়ানরা হয়তো সেই পারমিশান নাও দিতে পারে।
-হুমম, ঠিক বলেছিস। তাহলে চল মুড়াপাড়া কলেজের দিকে যাই।(শুভ্র’র প্রস্তাব)
-(বাকীরা সমস্বরে বলে উঠল)মুড়াপাড়া!! এটা আবার কোথায়?
-নারায়ণগঞ্জের দিকে, পুরানো এক জমিদারবাড়ি টাইপ এর। খুব সুন্দর জায়গা।
-(ফারজানার প্রশ্ন) তাই নাকি? তুই গিয়েছিলি আগে?
-আমি যাইনি, তবে আমাদের পাড়ার এক বড়ভাই গিয়েছিলেন, তিনিই আমাকে কয়েকদিন আগে বললেন সুযোগ পেলেই যেন যাই ওখানে, নাইস প্লেস।
-(নিলা বলে উঠল)পুরানো জমিদার বাড়ী, শুনেই কেমন যেন থ্রিলিং লাগছে। চল কাল সকালেই যাই।
-ওকে দ্যান, কাল সকালে আমরা রওনা হচ্ছি।
-(নিলা প্রস্তাব দিল) তোরা সবাই সকালে আমার বাসায় চলে আসিস, আমার গাড়ীতে করে যাওয়া যাবে।
-(সবার সম্মতি)গুড আইডিয়া, তাই হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবাই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিলার বাসায় চলে এল। নিলা সবার জন্য ওয়েট করছিলো। সবাই আসতেই নিলার মা সবাইকে নাস্তার টেবিলে বসতে বললেন। যদিও সবাই হাল্কা নাস্তা সেরে এসেছিল বাসা থেকে, কিন্তু নিলার মায়ের পীড়াপীড়িতে না করতেও পারলোনা, একসাথে বসে নাস্তা করল সবাই। তারপর বেড়িয়ে পড়লো মুড়াপাড়ার উদ্দ্যেশ্যে।
সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ী মুড়াপাড়া কলেজ প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেল। গাড়ী সেখানে পৌঁছামাত্রই সেখানকার চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সবাই বিমোহিত হয়ে পড়ল। চারিদিকে সারি সারি গাছ, পুকুরঘাট, পুরোনো জমিদারবাড়ি, এককথায় অপূর্ব। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল এই নয়নাভিরাম দৃশ্য।
ঘুরতে ঘুরতে একসময় লাঞ্চের টাইম হয়ে এল। গাড়ীতে রাখা খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসে সবাই পুকুরপাড়ে বসল খাওয়ার জন্য। খেতে খেতে প্রথম কথা বলে উঠল শুভ্রঃ
-তোদের সবাইকে আজ একটা কথা বলব। মন দিয়ে শোন।
-কিরে কোন সিরিয়াস কথা নাকি?(দিপার জিজ্ঞাসা)
-হুমমম…..আই এম ইন লাভ।
-সত্যি!!! কি বলিস!!! মেয়েটা কে? কোথায় থাকে?(সবার সমস্বরে প্রশ্ন, একমাত্র নিলা নিশ্চুপ)
-মেয়েটা আজ আমাদের মাঝেই আছে….
-মানে!!! কার কথা বলছিস তুই!!!(বিস্মিত জিজ্ঞাসা সবার)
-নিলা….আই এম ইন লাভ উইথ নিলা।
(এবার সবাই ঘুরে তাকাল নিলার দিকে)
-নিলা!!! সত্যি নাকি? কবে থেকে? আমরা তো কিছুই জানিনা…
-(লাজুক হাসি দিয়ে নিলার উত্তর) কয়েকদিন আগেই শুভ্র আমাকে প্রপোজ করেছে ফার্স্ট। আমিও হ্যাঁ বলেছি।
-আই ক্যান্ট বিলিভ ইট!!! আমরা কিছুই জানলামনা(শান্তর বিস্ময়ের পালা যেন এখনও শেষ হচ্ছেনা)
-(শুভ্রর উত্তর)কথাটি সত্যি, তোরা বিশ্বাস কর আর না-ই কর।
-এনিওয়ে, কনগ্রাচুলেশন্স দোস্ত(সবাই শুভ্রর সাথে হ্যান্ডশেক করল, সাথে সাথে নিলাকেও অভিনন্দন জানালো সবাই)।
-(ফারজানার আনন্দিত কন্ঠ) এমন একটা সুন্দর পরিবেশে দারুন একটা খবর পেলাম, খুবই আনন্দ হচ্ছে।
-(শান্তর উত্তর)ঠিকই বলেছিস, শুভ্র আর নিলা, একেবারে পারফেক্ট কাপল।
(শান্তর এই কথা শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল নিলার মুখ)
-যাহ্, কি যে বলিস না……….
-ওরে আমার লজ্জাবতী লতা রে, এখন আর লজ্জা পেতে হবেনা, ঘটনা তো ঘটিয়ে ফেলেছিস।
শান্ত’র এই কথার সাথে সাথে তার পিঠে কিল বসিয়ে দিল নিলা, সবাই হো হো করে হেসে উঠল। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এল। যাওয়ার তাগাদা দিল সবাইকে শুভ্র।
-এই চল, রওনা দেই। রাত হয়ে গেলে বাসায় আবার সবাই চিন্তা করবে।
-হ্যাঁ চল, যাওয়া যাক। (সবাই বলে উঠল)
সবাই গাড়ীতে উঠে বসল। গাড়ী চলতে শুরু করল ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে। পেছনে পড়ে রইল প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যের মনোরম সাজ। শুভ্র আর নিলাও খুব খুশী আজ, কারণ এমন চমৎকার একটা দিনে আর দারুন এক পরিবেশে তারা তাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে জানাতে পেরেছে।
...........................
পিডিএফ লিংক