গ্রিক মিথলজিঃ- সৃষ্টিগল্প(পর্ব-২) -- চিল্ড্রেন অফ নাইট - ৩(শেষ )
গ্রিক মিথলজি সম্পর্কিত আমার এই সিরিজটিতে আমি এতদিন মুলতঃ বিভিন্ন আদি স্বত্বার পরিচয় দিয়েছি। এসব আদি স্বত্বারা খুব বেশী আলোচনায় না আসলেও মিথে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনীতে মাঝে মাঝেই তাদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং অনেক সময় এসব ঘটনা বিভিন্ন চমকপ্রদ মোড় নিয়েছে তাদেরই হস্তক্ষেপে। তাই সবার আগে আমি এসব গৌণ স্বত্বাগুলোর উৎপত্তি ও তাদের প্রকৃতির বর্ণনা করেছি যাতে পরবর্তীতে যখন এদের নাম আমাদের সামনে আসবে তখন যেন এরা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত না থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে আমি মূল গল্পের গভীরে ততটা প্রবেশ করতে পারিনি। তাই আগের লেখাগুলো অনেকের কাছেই হয়তো একটু বোরিং লাগতে পারে। তবে সুখবর হলো, গ্রিক মিথলজির এই পর্বসহ আগামী কিছু পর্বের মাধ্যমে আমরা গল্পের ভিতরে প্রবেশ করবো। এ বিষয়ে আগ্রহী যারা এখনো এই সিরিজের আগের লেখাগুলো পড়েন নি তাদেরকে বলবো সময় সুযোগ করে পড়ে নিতে এবং এই পর্বটি পড়ার আগে অন্ততঃ গ্রিক মিথলজিঃ সৃষ্টিগল্প(পর্ব-১) -- প্রিমরডিয়াল ডেইটিজ ও গ্রিক মিথলজিঃ সৃষ্টিগল্প(পর্ব-২) -- চিল্ড্রেন অফ নাইট - ১ পর্বদু'টিতে একটু চোখ বোলাতে। আর প্রিমরডিয়াল ডেইটিজ যাদের পড়া আছে তাদেরকে বলবো আর দেরী কেন ? চলুন গভীরে ডুবি।
তো মাদার আর্থ-“গাইয়া” ক্যাওস থেকে সৃষ্টি হলেন। অনন্ত যৌবনা গাইয়া নিজ খেয়ালেই কালযাপন করতে লাগলেন। তার ঐশ্বরিক বিভিন্ন খেয়ালে পৃথিবীপৃষ্ঠে উথিত হল পর্বতমালা(Ourea) , জন্ম নিলেন সমুদ্রের অর্ধস্বত্বা প্যান্টাস(Pantus)। সমুদ্রের বাকি অর্ধস্বত্বা থালাসা’র সাথে প্যান্টাস মিলিত হয়ে সম্পূর্ণ সমুদ্রের জন্ম দিলেন। গাইয়ার এই নতুন সৃষ্টিগুলো গাইয়াকে যেন আরো উর্বরা, আরো যৌবনা করে তুললো। নিজের ভিতরে কিসের একটা অভাবে গাইয়া দিশেহারা বোধ করতে লাগলেন। কী এক রহস্যময় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন তিনি। নিজেকে তার খুবই একা লাগতে লাগলো কিন্তু তখনো তিনি জানতেন না তার সে অনুভূতির পরিচয় সম্পর্কে। গভীর বিষাদময় তৃষ্ণা নিয়ে তিনি প্রতি রাতে নিদ্রা যেতেন।
এমনই এক রাতে গাইয়ার নিদ্রা মাঝে তার হৃদয়ের সেই করুণ আহ্বানে সাড়া দিয়ে, তার স্বত্বার কোন একটা অংশ তার মধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর বিচ্ছিন্ন এই স্বত্বাটি হলেন ইউরেনাস(Uranaus),আকাশ বা হেভেন স্বয়ং। ইউরেনাস জন্ম নিয়েই প্রথম দেখেন নিদ্রারত গাইয়াকে। আর স্বাভাবিকভাবেই তার পুরুষস্বত্বা গাইয়ার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা শুরু করে।
নিদ্রা থেকে উঠে ইউরেনাসকে দেখে গাইয়া আনন্দে আত্মহারা হলেন। তিনি ইউরেনাসকে নিজের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলেন। ইউরেনাস তো গাইয়ার সৌন্দর্যে অভিভূত ছিলেন তার জন্মলগ্ন থেকেই। গাইয়ার ভালোবাসা পেয়ে তিনি গাইয়ার প্রতি আরো বেশী দুর্বল হয়ে পড়লেন এবং গাইয়াকে চারদিক থেকে আবৃত করলেন প্রবল ভালোবাসায়। অতঃপর তারা মিলিত হলেন এবং সূত্রপাত করলেন দ্য গ্রেটেস্ট ড্রামা অফ রিয়েলিটির ( আমার মতে )। গাইয়ার স্বামী হিসেবে ইউরেনাস সর্বোচ্চ শাসনকর্তা হয়ে সৃষ্টি জগত শাসন করতে লাগলেন।
তবে জীবনে সুখ কারোই স্থায়ী হয় না। এমনকি দেবতাদেরও না। তাই গাইয়া আর ইউরেনাসের অমর জীবনেও নেমে এসেছিলো দুর্ভোগ। আর এ দুর্ভোগ ছিলো নিয়তি নির্দিষ্ট।
গাইয়া ও ইউরেনাসের মিলনে প্রথমে সৃষ্টি হল পঞ্চাশ মাথা ও শত হস্ত বিশিষ্ট অতিকায় দানব হেকাটনখেইরিস (Hekatonkheires) ভাইত্রয়ের। ব্রায়ারেওস(Briareos),কটস(Kottos) এবং জাইজিস(Gaiges)। এদের প্রত্যেকেই ছিলেন প্রচন্ড কদাকার দেখতে এবং দুর্দমনীয় ক্রোধে এরা সবসময়ই ফুঁসতেন। তারা ছিলেন অমিত শক্তির অধিকারী। তাদের পদচারনায় পৃথিবীপৃষ্ঠ মুহুর্মুহু কেঁপে উঠতে লাগলো।
গাইয়া ও ইউরেনাসের মিলনে এরপর জন্ম হয় এক চক্ষু বিশিষ্ট বিশালাকার আরো তিনটি দানবের। ব্রন্তেস(Brontes), স্তেরোপ্স(Steropes) ও আরজিস(Arges) নামের এই তিন ভাই মিথলজিতে সাইক্লোপস (Cyclopes) নামে পরিচিত। এই সাইক্লোপসরা হলেন পৃথিবীর প্রথম কর্মী এবং তারা নির্মাণকাজে দক্ষ ছিলেন। সাইক্লোপসরা এতটাই বিশাল ছিলেন যে গ্রিকরা সাইক্লোপসদের বলত দ্য বিগেস্ট জায়ান্টস এভার অন আর্থ। এরাও প্রচন্ড বদরাগী ছিলেন।
এদিকে প্রেমিক হিসেবে যথেষ্ট নাম করলেও স্বামী ও পিতা হিসেবে ইউরেনাস মোটেও দায়িত্বশীল ছিলেন না। ভয়ানক শক্তিশালী , বিশালাকার ও কুশ্রী হওয়ায় ইউরেনাস তার ছয় সন্তানকে মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। বরং তিনি এই ভেবে ভয় পেতেন যে তার এই সন্তানরাই বুঝি একদিন তার ক্ষমতা কেড়ে নিবে। তাই তিনি হেকাটনখেইরিস ও সাইক্লোপসদের নির্বাসিত করলেন টারটারাসে। এতে হেকাটনখেইরিস ও সাইক্লোপসরা পিতার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেও টারটারাসের বীভৎসতার মাঝে থেকে তারা কিছুই করতে পারলেন না।
এদিকে স্বামীর এমন নিষ্ঠুর আচরণে গাইয়া ব্যাথিত হলেন। তিনি ইউরেনাসকে বারবার অনুরোধ করলেন তার সন্তানদের মুক্ত করে দিতে। কিন্তু ইউরেনাস সেসব আবেদন কানেই তুললেন না। ইউরানাস জানতেন না যে নারী হলেও গাইয়ার প্রধান স্বত্বা প্রেয়সী হিসেবে নয় বরং মাতা হিসেবেই গড়ে উঠেছিল। তিনি জানতেন না নিজ সন্তানদের জন্যে গাইয়া ঠিক কতটা হিংস্র হতে পারেন। ইউরেনাসের অবজ্ঞায় গাইয়া খুবই ক্রুদ্ধ হলেন। তবে তিনি জানতেন শক্তি দিয়ে তিনি ইউরেনাসের কিছুই করতে পারবেন না। তাই তিনি নিরবে অপেক্ষা করতে লাগলে সঠিক সময় ও সুযোগের। আর অপেক্ষার এ সময়টিতে তিনি নিজের ভিতরে জন্ম নেয়া ক্রোধকে আরো বাড়তে দিলেন আর সন্তানদের জন্যে তার ভিতরকার শোক ধীরে ধীরে তার শক্তিতে রুপান্তর হতে লাগল।
তথ্যসূত্রঃ
১। দ্য গ্রিক মিথস(রবার্ট গ্রেভস);
২। হেসিওডস থিওগনি;
৩। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ গ্রিক এন্ড রোমান মিথলজি;
৪। অনলাইন।
ছবি সংগ্রহঃ গুগল এন্ড পিন্টারেস্ট
পরবর্তী পর্বঃ ইউরেনাসঃ- গ্রিক মিথলজিঃ ইউরেনাসঃ- দ্য ফল অফ দ্য ফার্স্ট ফেইলিউর(The Fall of the First Failure)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:২৮