মা হঠাৎ এভাবে চলে যাবে কখনও কল্পনাতেও আসেনি।নীলিমার নির্বাসনে থাকার এ যেনো এক নির্বাক প্রতিবাদ। শুধু যেনো মেয়েকে দেখার জন্যই বেঁচে ছিলো শেষের কয়টা দিন। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে অপলক তাকিয়ে থেকেছে । চোখের কোনায় দুঁ ফোটা জল। আশা ছাড়েনি কখনই। সব সময় শুধু একটাই কথা বলেছে আমার নীলু আসবেই । নীলু কে না দেখে আমি যে মরেও শান্তি পাবনা। বিকেলে পৌছে মাকে দেখেই মনে হয়েছে যেন আর কটা দিন আগে এলে হয়তো একটা কিছু করা যেতো, এ যাত্রায় বাঁচানো যেতো মাকে। মনে হয়েছে ডাক্তার হয়ে নিজের মায়ের সেবাই করতে পারলামনা । যে মা সারাটা জীবন ধরে স্বপ্ন দেখেছে নীলিমার ডাক্তার হবার , সেই মা বিনা চিকিৎসায় এভাবে চলে গেলো।
কোনো ডাক্তার বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। এতো অসুস্থ অবস্থায় মানোবল দেখে সবাই অবাক হয়েছে।
সেই যে ইন্টার্নশিপ করার সময় শেষ বাড়ি এসেছিলো। তারপর প্রেম করে বিয়ে করেছে বলে আর কখনই বাড়ি যাবার অনুমতি মেলেনি। বাবা ছিলেন খুব কড়া মানুষ। সাহস করে বাবার সামনে কখনও দাঁড়াতে পারেনি নীলিমা। যেই রবির জন্য নীলিমার বাবা মা কে ছেড়ে আসা সেই যখন অবহেলা করেছে ,সহ্য করাটা ছিলো আসলেই খুব কষ্টের । কত ভাল রেজাল্ট, আমেরিকায় স্কলারশিপ, সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার সব ছেরে দিয়েছে রবির একটা কথায়। মানুষ চেনা আসলেই খুব কঠিন।
মার ইচ্ছে ছিল নীলু ডাক্তার হয়ে প্রথম মার চিকিৎসা দিয়েই ডাক্তার জীবনের শুরু করবে। আজ ইচ্ছা করছে আরো আগে যদি মার চিকিৎসা টা করা যেতো! মার শরীর টা খুব দুর্বল একটা স্যালাইন দেয়া দরকার ।কিছু ভিটামিন ওষূধ ছিল ব্যাগে খুঁজে দেখতে হবে।অনেক দিন পর বাসায় এসে সব অচেনা লাগছে। মনেই হচ্ছেনা এই বাসাতেই কেটেছে শৈশব আর কৈশরের সব আনন্দের দিনগুলো। মার হাতের ইলিশ খিচুরি , দাদুমার হাতের আঁচার,পড়া ফাঁকি দিলে বাবার বকুনি। পাশের বাড়ির সোহেল ভাই এর মোটর সাইকেল চালিয়ে বাসার সামনে ঘোরাফেরা।সব কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছোটোবালেয় মা পুতুল বানিয়ে দিত।কত যে রংবেরংএর পুতুলের শাড়ি। পুতুলের বিয়েতে মা পায়েস রান্না করে দিত। সে অনেক আয়োজন। অথচ নিজের মেয়ের যেদিন বিয়ে হল সেদিন মা টেরও পেলনা।
মাঝরাত থেকেই মার শরীর টা বেশি খারাপ হতে শুরু করেছে। মার চেহারায় স্পস্ট যন্ত্রনার ছাপ। কি করবে নীলিমা কিছুই বুঝতে পারছেনা।অনেক ব্যাথা রে নীলু আমাকে একটা ব্যাথার ওষুধ দে এই বলেই মা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল। কি হল মার। নীলিমার সারাটা পৃথীবি যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। আর কিছুই চিন্তা করতে পরছেনা। নীলিমার হাতের একটু সেবা পাওয়ার জন্যই মনে হয় এতগুলো দিন বেঁচে ছিল, আজ সব কস্টের পালা শেষ হয়ে গেলো।
দাফনের পরপরই কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে । পাড়া প্রতিবেশি, আত্মিয় স্বজন সবার এত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত মনের অবস্থা নেই এখন। লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা নীলিমা। অনেক দিন পর কাঁদতে পেরে মনটা যেন অনেক হালকা লাগছে। জীবনে যখন আর কোনো পিছুটান থাকেনা তখন কেমন একটা শূন্যতা কাজ করে। এখন শুধু একটাই চিন্তা বাবুই কে নিজের মনের মত করে বড় করে তুলতে হবে।