গ্রামে এসে মনে হচ্ছে নিস্তব্ধতার সাগরে ডুবে গেছি। থ্যংস গড যে মাঝরাতে ঝিঁঝিঁ পোকাদের দল অন্তত আমার সঙ্গী হয়েছে । আমার কাজিনরা সব ঘুমিয়ে গেছে সেই সন্ধ্যায় , এটা অবশ্য ওদের রেগুলার প্র্যাকটিস । গতবার যখন এলাম তখন তো ইলেক্ট্রিসিটিও ছিলনা। এখন লাইফটা অনেক ইজি হয়ে গিয়েছে। অজ পাড়াগায়ে বসে ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্রাউজ করছি যা কয়েক বছর আগেও ভাবাই যেতনা। ফেসবুকের বদৌলতে এখন আর মনে হয়না যে বন্ধুদের থেকে দূরে আছি।
বাবা আমাকে দেখে খুব অবাক হচ্ছে। আমি সবার সাথে এমন ভাবে মিশে গেছি যেন আমি এখানেই বড় হয়েছি । প্রথম প্রথম ওদের ভাষা টা বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছিল, এখন আর অতটা কঠিন লাগেনা। আমি বুঝিনা মা কেন গ্রামে আসতে চায়না।এখানে সবাই এত ভাল।
অন্যান্যবার মার সাথে দেশে আসি তাই ঢাকাতেই থাকতে হয় নানুর বাসায়। ঢাকায় থাকতে আমার একটুও ভালো লাগেনা। সারাদিন মার সাথে শপিং সেন্টারে ঘুরে বেড়ানো আর রাস্তায় জামে গাড়িতে বসে থাকা, ডিসগাস্টিং । গতবার গ্রামে ছিলাম মাত্র একদিন, সেই একদিনই আমার কাছে দেশের স্মৃ্তি হয়ে ছিল। এবার তাই বাবার সাথে গ্রামে আসার লোভ সামলাতে পারলামনা। বহুদিন পর বাবা এসেছেন উনার একটা রিসার্চ এর কাজে। এক বছর দেশে থাকার সুযোগ পেয়ে বাবা যার পর নাই খুশি। আমার নেক্সট মাসেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তাই চাইলেও বেশিদিন থাকতে পারবনা।
সকাল সকাল বাবার সাথে নদীর পাড় ধরে হেটে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। কুয়াশা ঢাকা ভোরে বড়ফুপি পিঠা বানায়। ভাপা , চিতই, আর কতকি নাম পিঠার। ছোট চাচু মাটির পাত্রে আখের রস কিনে এনেছে। কি মজা খেতে। মা বলেছে আমি নাকি গেঁয়ো হয়ে যাচ্ছি দিনেদিনে। গেলামই নাহয়। আর কয়টা দিনই তো। সিডনী ফিরে গিয়েই তো আবার অন্য জীবন। বি বি এ লাস্ট সেমিস্টার বাকি। তারপর কি করব ঠিক করিনি এখনও। একবার ভাবছি পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে আসব। মা সহজে রাজি হতে চাইবেনা। বাবা খুব খুশি হবে। বাবার অনেক দিনের শখ শেষ জীবনে গ্রামে এসে কিছু করার। ছোটোখাটো একটা ফার্ম হাউজ, একটা স্কুল, লাইব্রেরী, রিসার্চ সেন্টার , হসপিটাল, এমন অনেক স্বপ্ন বাবার। আমাকে সাইন্স পড়ানোর ইচ্ছা ছিল, ডাক্তার হয়ে দেশে এসে মানুষের সেবা করব। তখন বুঝিনি বি বি এ পড়ায় বাবা কেন এতো রাগ করেছিল। ছোটবেলায় যদি গ্রামে আসতাম তাহলে কখনও এই ভুল সিদ্ধান্ত নিতামনা।
মাকে খুব মনে পড়ছে । মা কিছুতেই দেশে ফিরে আসতে চাইছেনা। মা প্লিজ রাজি হয়ে যাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তুমি আসলেই বাবার স্বপ্নপুরন কত সহজ হয়ে যায় । এত বড় ডাক্তার তুমি, তুমিই তো পার বাবার হসপিটালের দায়িত্ব নিতে। প্লিজ দেশে এসে বাবার পাশে দাঁড়াও। চলোনা মা সবাই মিলে ঘরে ফিরে আসি। সবুজ ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদী করতোয়া । তার পাশে আমাদের ছোট গ্রাম। এই সবুজ ছেড়ে চলে যেতে আমার একটুও ইচ্ছে করেনা মা। একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে । সবুজ ধানক্ষেতের বুক চিড়ে মাথা তুলছে লাল সূর্য ।