somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অণুগল্প: মহামানব

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"রিয়াজ সাহেব, এখনো কি আপনার মাথার ভেতর অন্য কারো গলার আওয়াজ শুনতে পান? কেউ কি মনের ভেতর আপনার সাথে কথা বলে? আপনাকে কোন নির্দেশ দেয়? আদেশ করে?"



আমি ডানে বামে জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে বললাম, "নাহ, একদম না। সেসব সমস্যা সব চলে গেছে।"

ডাঃ রওশন আমার দিকে দীর্ঘক্ষণ তার অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে থাকলেন। এই পুরোটা সময়ই আমি আমার মেকি হাসিটা ধরে রাখলাম আর ডাক্তারের চোখ থেকে চোখ সরালাম না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার হালকা ভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে আমার কথায় সম্মতি দিলেন। আমি জানতাম। দিতে তিনি বাধ্য। আমাকে আগেই বলা হয়েছে ঠিক কি করতে হবে, কি বলতে হবে। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছে।

এক হিসাবে দেখলে আমি কিন্তু মিথ্যা বলিনি। একদম না। আর যাই হোক, আমাকে মিথ্যাবাদী কেউ বলতে পারবে না। আমি নির্যস সত্য কথাটাই বলেছি। আমার মাথার মধ্যে কোন আওয়াজ আর শুনতে পাই না, আওয়াজ বলতে অন্য কোন মানুষের গলার স্বর। এটাই সত্যি, কসম।

আসলে আমি এখন ঐসব আওয়াজ-টাওয়াজ শোনার স্তরে নেই। আমি এখন যে শব্দগুলো শুনি সেগুলো আরও সুন্দর, আরও সুমধুর, নিখুঁত ও মুগ্ধকর। এই পৃথিবী নিজেই এখন আমার সাথে কথা বলে। যেই বিচ্ছিরি শব্দের সাহায্যে আমি-আপনি বা অন্য মানুষ কিংবা পশু-পাখি নিজেদের মধ্যে কথা বলে সেরকম নয়। আমার সাথে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কথা বলে বাতাসের মাধ্যমে, যখন বাতাস বয়ে যায় আর পাতাগুলো সরসর শব্দ করে উড়ে যায়, গাছের শাখাগুলো একটা আরেকটার সাথে বাড়ি খায় - আমি কান পেতে থাকি আমাকে কি বলা হচ্ছে তা শুনতে। যখন আকাশে মেঘেরা উড়ে যায়, তাদের চলার পথে নানান নকশায়, আলো আর অন্ধকারে আমি আমার সাথে কথা বলতে থাকা এক অমোঘ, আদিম, সীমাহীন সত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। রাতের চাঁদ-তারা, কিংবা দিনের বেলা সূর্য-ছায়া, ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি, গাছের ফুল এরা সবাই আমার সাথে কথা বলে। আমাকে নির্দেশ দেয়, কখন-কোথায়-কি করতে হবে। আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাই।

সব জিনিসেরই নিজস্ব ভাষা আছে। প্রতিটা ঋতুর ভাষা আলাদা, প্রতিটা ধূলিকণা-একেকটা গাছের পাতা-ফুলের-মাটির, এমনকি একেকটা পুকুর-দিঘী কিংবা নদীর ভাষাও সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি সেই সব ভাষা বুঝতে পারি, তাদের সাথে কথা বলতে পারি। আমি এখন সর্বজ্ঞানী, সর্বশ্রোতা, মানুষের মধ্যে সেরা, মহামানব। সৃষ্টিকর্তার একান্ত বাধ্য দাসানুদাস আমি, তার দেয়া প্রতিটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। তার বদলে তিনি আমার এই অসুস্থতা দূর করে দিচ্ছেন। ঐ দুই টাকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রওশনের যেই ক্ষমতা হয় নি এতদিনেও।

আগে যেমন অন্ধকার ভয় পেতাম, একাকীত্বে আমার ভীষণ ভয় ছিল। মৃত্যুর কথা ভাবতেও পারতাম না। রক্ত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। এখন এসব কোন সমস্যাই না আমার কাছে। রাতের অন্ধকার গলিতে চুপ করে লুকিয়ে থাকতে পারি, একা একা। রক্তের মধ্যে আঙ্গুল ডুবিয়ে সৃষ্টিকর্তার সাথে কথা বলতে পারি অনর্গল, মৃত্যুর স্বাদ-গন্ধে তার অসীম উপস্থিতির সাথে প্রগাঢ় মিলনের আস্বাদ পাই আমি।

নিজের নোটবুকে কিসব লেখা শেষে নিজের প্রেসক্রিপশনের খাতাটা টেনে নিলেন ডাঃ রওশন। ইশ, আমি একদম চাইনি এটা হোক। আমাকে অবশ্য আগেই বলা হয়েছিল এরকম হতে পারে। অবশ্য ডাক্তারকে দোষ দিয়ে আর লাভ কি। সে তো আর আমার মতন দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয় নি। সে কি করে বুঝবে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছি। তার জন্য আমার কষ্ট হল, ভীষণ কষ্ট। ডাঃ রওশন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চান, কি সব বিচ্ছিরি ওষুধ দেন তিনি খেলেই আমার শুধু ঘুম আসে। জেগে থাকলেও নির্দেশগুলো ঠিকঠাক শুনতে পাই না, সব ঝাপসা-গোলমেলে লাগে। আর সৃষ্টিকর্তা আমার সাথে কথা বলতে চাইলে বাধা দেওয়ার কে এই ডাক্তার? আমাকে একা, আলাদা করে রাখতে চায়; ওর মতন সাধারণ মানুষদের কাতারে নামিয়ে আনতে চায় এই হারামজাদা!

হালকা বাতাসে ডাক্তারের পেছনের পর্দাটা দুলে উঠলো। আমার নির্দেশ পেয়ে গেছি আমি। স্রষ্টা নিজেও চান না তার এই দাসানুদাস তার সাথে কথা বলা থেকে বঞ্চিত হোক। উল্টোদিকে ফিরে কিছু একটা খুঁজছেন ডাঃ রওশন। তার কাঁচাপাকা চুলের মাঝখানে দুই ইঞ্চি ব্যাসের একটা গোল চকচকে টাক। সেদিকে তাকিয়ে টেবিলের উপর থেকে পেপারওয়েট-টা তুলে নিলাম আমি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:০৬
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×