এক.
শুক্রবার সকালবেলা। ছুটির দিন হওয়ায় বিছানা থেকে ওঠার কোনো গরজ করছি না। কিছুক্ষণ পরপর ডানচোখটা অর্ধেক খুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার আধাঘন্টার জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলছি। হঠাৎ খাট কাপিয়ে মোবাইল ফোন ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। আমি চোখ না খুলেই হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা কানের কাছে নিলাম, একটা ভরাট কন্ঠ বললো-
: আসসালামু আলাইকুম, স্যার আমি নভো।
: ওয়ালাইকুম সালাম, কোন ব্রাঞ্চ? আমি ভাবলাম অফিসের কোনো ফোন হবে।
: স্যার আমাকে চিনতে পারেননি। আমি নভোনীলের নভো।
আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। ঘুমটুম সব এক মুহূর্তে উধাও! ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখি ডিসপ্লেতে অদ্ভুত এক নাম্বার, অসংখ্য ডিজিট, এক লাইনে কুলাচ্ছে না, তিনলাইন লাগছে। আমি চোখ পিট পিট করতে লাগলাম, স্বপ্ন টপ্ন দেখছি নাতো? ফোনের স্পিকার অন করে দিয়ে রুমীকে ডাকলাম, রুমী কিচেন থেকে দৌঁড়ে আসলো। ওদিকে ফোনের মধ্যে নভো স্যার, স্যার করেই যাচ্ছে।
কি হলো, চেঁচাচ্ছ ক্যানো? তাড়াতাড়ি বলো, তাওয়ায় রুটি পুড়ে যাচ্ছে.....আর ফোনে কে, কথা বলো- রুমি বললো।
তার মানে রুমিও শুনতে পাচ্ছে। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললাম- হ্যাঁ নভো বলো...... মানে, বলেন।
: স্যার, আগামীকাল আপনাকে একটু ক্যাম্পাসে আসতে হবে, আর আমাকে তুমি করে বলবেন স্যার। আফটার অল আপনারা আমাদের স্রষ্টা।
: কিন্তু আপনি... আপনি?
: কিছু বুঝতে পারছেন না, তাইতো? কাল আসলেই সব বুঝে যাবেন স্যার, সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
: কোথায় আসবো?
: স্যার বিকাল চারটার সময় আমি এবং মৃণ শহিদুল্লাহ হলের পেছনের পুকুরের পূবদিকের সিঁড়িতে থাকবো। অন্যরাও থাকবে।
: এখন কি ওদিকে যাওয়া যাচ্ছে? করোনায় কার্জন হলেন সব গেট বন্ধ শুনছিলাম...
: কোনো সমস্যা হবে না স্যার, সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
আমি আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেলো। আমি নির্বোধের মত ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হচ্ছে কি এসব! আমরা স্রষ্টা, মৃণ থাকবে, সব ব্যবস্থা করে রাখবো, অন্যরাও থাকবে, এসবের মানে কি? তাহলে কি আমরা যারা নভোনীল লিখেছি তাদের কথা বললো?
এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হলো। এ ফোনের কথা বললে কেউই বিশ্বাস করবে না। নভোনীলের অন্য পর্ব যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারলে হয়তো কিছু একটা বোঝা যেতো। কিন্তু এমনই কপাল, আমি এঁদের কাউকেই বাস্তবে চিনি না, নিজে ফেসবুক ব্যবহার করি না যে সেখান থেকে খুঁজে নেব....। এখন নিজেই নিজের কপাল চাপড়ানো ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছে, সেটাতে একবার রিংব্যাক করতেই অদ্ভুত এক ভাষায় কি সব বলতে শুরু করলো। আমি বিন্দুবিসর্গ কিছুই বুঝতে পারছি না।
আরে! ফোনটার আবার কি হলো, এর তো কথা থামছেই না, মনে হচ্ছে নতুন নতুন বিভিন্ন ভাষায় একই মেসেজ রিপিট করছে। হঠাৎ শুনি পরিষ্কার বিশুদ্ধ বাংলায় বলতে শুরু করলো- আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন সেটি প্রক্সিমা সেন্টারাই গ্রহে নিবন্ধিত। এই নাম্বারে পৃথিবী গ্রহ থেকে ফোন করা সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে দ্বিতীয়বার এই চেষ্টা করবেন না...।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! বলে কি!
কাল যাবো, না যাবো না, গেলে সমস্যা হবে, নাকি হবে না, না গেলে আবার কোনো সমস্যা হবে কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে আমার গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো!
দুই.
শনিবার বিকেল ৩টা ৩০ মিনিট। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না। একটু ভয় নিয়েই গেলাম কার্জন হলে। সবদিকের গেটই বন্ধ। মনে মনে সন্দেহ হতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে চানখারপুলের দিকের গেটের সামনে গিয়ে দেখলাম ওই গেটটা খোলা। আমি ঢুকতে যেতেই মামা এসে আটকালো- কোথায় যাবেন?
নভোর কথা বলা ঠিক হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতে মামাই বললেন- নভো মামার....
তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি বললাম- হ্যাঁ, হ্যাঁ....
শহিদুল্লাহ হলের এক্সটেনশনের সামনে যেতেই দেখলাম পুকুড়ের পূবের সিঁড়িতে বেশ কয়েকজন মানুষ বসা। এছাড়া চারদিক নিরব, কোথাও কেউ নেই। বিস্ময়ের পর বিস্ময়! কাছে যেতেই অনেককে চিনতে পারলাম। নভোনীল, মৃন্ময়ী আর চশমা চোখে খায়রুল আহসান স্যারকে খুব সহজেই চেনা গেলো। সাথে মাথায় ফেটিশ বাঁধা মেয়েটা নিশ্চয় রিম সাবরিনা আর ডেভিড শেপার্ড ক্যাপ পড়া লাজুক ধরনের ছেলেটা বোধহয় নিয়াজ সুমন। এর বাইরে একজন আবার তুতেনখামেনের ছবিওয়ালা একটা টি-শার্ট পড়ে এসেছেন, খুব সম্ভবত ইনি আখেনআটেন। বাকিদের না চিনলেও বুঝতে পারছি সবাই নভোনীল টিমেরই।
আমার একটু লজ্জা লাগতে লাগলো। আমি আমার স্বল্পবন্ধুবলয়ে খুব প্রগলভ, কিন্তু এ রকম একটা পরিবেশে একদমই আক্রু হয়ে যাই। তার উপর এখানে কি ঘটছে, কিভাবে ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ নভো উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটার মধ্যে আসলেই কি রকম একটা ব্যাপার আছে। পাথরে খোদাই করা মুখের মত। নভো আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো- আপনারা তেরোজন স্যার ওই পাশে বসেন।
বুঝলাম আমরা যারা ১৩ পর্ব লিখেছি, তাঁদের কথা বলা হচ্ছে। আমরা এর ওর দিকে তাকাতে তাকাতে দেখলাম এপাশে ১৩জন হয়ে গেছি- রিম সাবরিনা, আমি পদ্মপুকুর, মেঘশুভ্রনীল, খায়রুল আহসান স্যার, আখেনআটেন, পুলক ঢালী, নিয়াজ সুমন, কবিতা পড়ার প্রহর, মনিরা সুলতানা, বিলুনী, ঢুকিচেপা, মোঃ মাইদুল সরকার এবং কল্পদ্রুম।
আমাদের মধ্যে খায়রুল আহসান স্যার ছাড়া সবারই খানিকটা বিহ্বল চেহারা; বিএমএ লংকোর্সের ট্রেইনিংয়ের বদৌলতে স্যার মনে হয় ভয় পাচ্ছেন না অথবা সফলভাবে টেনশন চেপে রাখতে পারছেন। কিছুক্ষণ পরপর তিনি ফোনে কেউ একজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটা দুটো শব্দ বলার পরই লাইনে বিচিত্র শব্দ চলে আসছে। কল ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমি স্যারের দিকে একবার তাকাতে চাপাস্বরে বললেন- বিসিআই-এ ব্রিগেডিয়ার ফারাজ স্পেস কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইউএফও সেকশনটা দেখে, ওকে একটু বলে রেখেছি। যদি কোনো সমস্যা হয়। ওর লোকজন আশেপাশেই আছে।
আমি বললাম, স্যার কোনো সমস্যা হবে না।
বললাম বটে কিন্তু নিজেই বিশ্বাস করছি না।
নভো বললো- ম. হাসান স্যার, আপনিও ওপাশে যান।
আমরা বুঝলাম- ম. হাসানও আছেন, বেচারা বোধহয় এক পুরস্কারের কথা বলেই ফেসে গেছেন!
যাই হোক, তিনিও আমাদের দিকে এসে বসলেন। অন্যদিকে নভো এবং মৃণ ছাড়াও আরও সাত আটজনকে দেখা যাচ্ছে, কাউকেই অবশ্য এখনও চিনতে পারছি না।
মৃণ বললো- এবার কথা শুরু করা যাক, আমাদের সময় খুবই কম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রক্সিমাতে ফিরে যেতে হবে।
হ্যাঁ, আমাদের হাতে সময় কম; নভো বলতে শুরু করলো। ‘আসলে আমাদের কিছু কথা আছে আপনাদের সাথে। আমরাতো একটা বিপদেই আছি আপনাদের এই গল্পে ঢুকে। সাধারণত একজন মানুষ আমাদের মত অনেকজনকে সৃষ্টি করেন একেকটা গল্পে, আমরা তখন তাঁর সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মত করে আমাদের জীবনের গল্প এগিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু এখানে আপনারা এতজন মিলে আমাদের এই অল্প কয়জনকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের ইতিহাসে এরকম কখনও হয়নি, আপনাদের এই এক্সপেরিমেন্টের কারণে প্রক্সিমা সেন্টারাইতে আমাদের সিস্টেমই হ্যাং হয়ে গেছে। আমাদের সুপ্রিমো এই জন্য আপনাদেরকে নিয়ে যেতে বলেছেন.... এখন আমরা কি করবো বলেন?’
আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠলো.... বাকিদের অবস্থাও তথবৈচ!
‘আপনারা একেকজন এসে একেকভাবে আমাদের যেখানে ইচ্ছে সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, গাড়ির নিচে ফেলতে চাচ্ছেন, ছারপোকা না কি এক প্রাণীর কামড় খাওয়াচ্ছেন, মারপিট করাচ্ছেন, বমিটমি করিয়ে লজ্জায় ফেলছেন আবার আমাদের মাথা অন্যের দেহের সাথে জুড়ে দিচ্ছেন...ছি ছি ছি! আপনারা সবই করছেন কিন্তু আমাকে আর মৃণকে এক করছেন না। এই যে ম. হাসান স্যার, আপনিতো দ্বিতীয়পর্বেই আমাদের করোনায় মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন..’
‘এখন আমরা এসব কাকে বলবো?’ নভো এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। ওর কন্ঠে রাগ বাড়ছে।
আমরা এর ওর দিকে তাকাচ্ছি। আমার তো নিজের উপরেই এখন রাগ লাগছে। ক্যান যে জড়াতে গেলাম ঘোড়ার ডিম! এখন যদি এরা আমাদের আটকে নিয়ে যায়, তাহলে কি হবে। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। অন্যরাও কেউ কোনো কথা বলছে না।
হঠাৎ খায়রুল আহসান স্যার বললেন- এভাবেতো আমরা যেতে পারবো না, এখন আমাদের কি করতে হবে তুমিই বলো, তোমার কথাটা আগে শুনি।
‘আমাদের কথা হলো- আপনারা দ্রুত আমাদের নিয়ে এই খেলা বন্ধ করেন। আর দুই পর্বের মধ্যেই প্রজেক্ট শেষ করেন, আমাদের আবার নোহ্যোয়ারআউট বাংলাদেশ ডট নেট-এ অন্য প্রজেক্টে সিড্যুল দেয়া আছে।’
রিম সাবরিনা এক ধরনের প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বললো- ঠিকাছে, ঠিকাছে, আমরা বাকি দু’পর্বেই শেষ করে দেবো।
রিমের হাসি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। ঝামেলাটা শুরু করলো সে এখন আবার হাসছে, নির্ঘাৎ মনে মনে এদের সাথে প্রক্সিমায় ট্যুরে যাওয়ার মতলব আটছে আর ভাবছে ওখান থেকে ফিরে এসে ক্রিট সন্তিরিনি, রিভা দেল গার্দা বা আল্পবাখের বাঁকে’র মত আরেকটা বোমবাস্টিং সিরিজ লিখবে... হা হা হা মামা, সে গুড়েবালি, একবার নিয়ে গেলে ছাল চামড়া খুলে নির্ঘাৎ গিনিপিগ বানিয়ে ছাড়বে, ইহজনমে আর ফেরত আসা লাগবে না....
‘আর হ্যাঁ, আমাদের কথা হলো শেষ দুপর্ব লিখবে সোনাবীজ ধুলোবালি ছাই, আহমেদ জিএস, পদাতিক চৌধুরী
গিয়াসউদ্দিন লিটন, অপু তানভীর, কাউসার চৌধুরী, সাজিদ উল হক আবীর, জুন, শায়মা, সোহানী অথবা মিররডল। তবে মিররডল আমাকে হাটুছেড়া প্যান্ট পড়ালে খবর আছে। এখন এদের রাজী করানোর দায়িত্ব আপনাদের।’
‘আপনাদের অগ্রগতি দেখার জন্য আমি মাধবী আপু, সিন্থিয়া, খাইরুল স্যার, পার্থদা, রাকিব ভাই, কল্প আর আফজাল ভাইকে রেখে যাচ্ছি। ওরা আপনাদের আশেপাশেই থাকবে আর আমাকে রিপোর্ট পাঠাবে। বাকি দুই পর্ব দ্রুত না আসলে আমরা আপনাদের সবাইকে ধরে নিয়ে আমাদের ওখানে আটকে রাখবো।’ নভো বললো।
‘আরেকটা কথা, যদ্দিন পর্যন্ত আপনারা আমাদের এই গল্পের সমাধান না করবেন, তদ্দিন পর্যন্ত সামহোয়্যারের নির্বাচিত পাতাও ঠিক হবে না। কাল্পনিক ভালোবাসাকে জানিয়ে দিয়েন। উনাকেও ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু তার সিস্টেম খুবই শক্তিশালি, আমাদের নেটওয়ার্ক ব্লক করে দিয়েছে।
আর ম. হাসান স্যার, আপনি দ্রুত আপনার পুরস্কার রেডি করেন। পুরস্কার দেয়ার দিন আমরা আবার আসবো। মনে থাকে যেনো, দ্রুত না শেষ করলে সবাইকে....
আর কিছু শোনা গেলো না, হঠাৎ দেখি শহিদুল্লাহ হলের পুকুরের পানি মহা অশান্ত হয়ে পড়েছে। বিকট শব্দে প্রকাণ্ড সব ঢেউ এসে পাড়ে বাড়ি খাচ্ছে। সে শব্দে গেট থেকে মামারা দৌঁড়ে এসে আমাদেরকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- কি ব্যাপার আপনারা কারা, এখানে ঢুকলেন কি করে?
আমরা বোকার মত এর ওর দিকে তাকাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আগে এরাই তো আমাদের খাতির করে ভেতরে আনলো! এদিকে নভোদের টিমের কাউকেই কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মামারা বললেন- আপনারা যান তাড়াতাড়ি, এই পুকুরে দোষ আছে।
আমরা দ্রুত ওখান থেকে সরে আসলাম।
এরপর থেকে ফোন বাজলেই আঁতকে উঠছি। বাপ্রে, কি ভৌতিক কাণ্ড হলো একটা!
নভোনীল এক, নভোনীল দুই, নভোনীল তিন, নভোনীল চার, নভোনীল পাঁচ, নভোনীল ছয়, নভোনীল সাত, নভোনীল আট, নভোনীল নয়, নভোনীল দশ, নভোনীল এগারো, নভোনীল বারো, নভোনীল তেরো, নভোনীল চৌদ্দ, নভোনীল পনেরো
ছবিকৃতজ্ঞতা
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:২৮