somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাভারতের গপ্পো - ০০৯

০৭ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জনমেজয়ের সর্পসত্র যজ্ঞ

মন্ত্রীদের কাছে পিতার মৃত্যুবিবরণ শুনে জনমেজয় প্রচন্ড দুঃখ পেলেন। তিনি জলস্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করলেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিবেন। তিনি পুরােহিতদের সাথে আলোচনা করে সর্পসত্র নামে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। এই যজ্ঞে তক্ষককে সাপেদের বংশসহ আগুণে পুড়িয়ে মারা যাবে।



যজ্ঞের প্রস্তুতি নেয়ার সময় একজন পুরহিত রাজাকে জানালো কোনো এক ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞে ব্যাঘাত ঘটাবে। রাজা জনমেজয় দ্বাররক্ষিদের হুকুম দিলেন বাইরে থেকে কেউ যেন যজ্ঞস্থলে আসতে না পারে। এরপর শুরু হলো সর্পসত্র যজ্ঞ। কালো আলখেল্লা পরে পুরহিতেরা সাপদের আহবান করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। আগুনের তাপ আর ধুয়ায় তাঁদের চোখ লাল হয়ে গেলো। নানান জাতের নানা বর্ণের অসংখ্য সাপ সেই মন্ত্রে আবিষ্ট হয়ে এসে আগুনে আত্মহুতি দিতে লাগলো। তক্ষক নাগ ভয় পেয়ে আশ্রয়ের জন্য ইন্দ্রের কাছে গেল। ইন্দ্র তাঁকে অভয় দিয়ে নিজের কাছে আশ্রয় দিলেন।



অন্য দিকে স্বজনদের এই করুন মত্যুতে বাসুকি খুব কারত হয়ে পরলেন। তিনি তার বোন মনসাকে গিয়ে ধরলেন। বোনকে বললেন তার ছেলে আস্তীককে রাজার কাছে পাঠিয়ে সাপেদের এই যজ্ঞাগ্নি থেকে রক্ষা করতে।



তখন মনসা তার পুত্র আস্তীককে পর্বের সকল ইতিহাস জানিয়ে বললেন তুমি আমার ভাই ও আত্মীয়দের যজ্ঞাগ্নি থেকে রক্ষা কর। মায়ের কাছে সব শুনে আস্তীক যজ্ঞস্থানে গেলেন, কিন্তু দ্বাররক্ষিরা তাঁকে প্রবেশ করতে দিলো না। তখন তিনি রাজার নামে স্তুতি (স্তব, মহিমা-কীর্তন, তোশামোদ) করতে লাগলেন –
পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয়, তুমি ভরতবংশের প্রধান, তােমার এই যজ্ঞ প্রয়াগে অনুষ্ঠিত চন্দ্র, বরণ ও প্রজাপতির যজ্ঞের তুল্য;
আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়।
ইন্দ্রের শত যজ্ঞ, যম রন্তিদেব কুবের ও দাশরথি রামের যজ্ঞ, এবং যুধিষ্ঠির কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রভৃতির যজ্ঞ যেরূপ, তােমার এই যজ্ঞও সেইরপ;
আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়।
তােমার তুল্য প্রজাপালক রাজা জীবলােকে নেই, তুমি বরুণ ও ধর্মরাজের তুল্য। তুমি যমের ন্যায় ধর্মজ্ঞ, কৃষ্ণের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন।


আস্তীকের স্তুতি শুনে রাজা জনমেজয় খুশী হয়ে তাকে বর দিতে চাইলেন। তখন প্রধান পুরহিত রাজাকে মনে করিয়ে দিলো তক্ষক এখনো এখানে আসেনি। তক্ষক এখানে আসার পরে ব্রাহ্মণকে বর দেয়া যাবে।
পুরহিতেরা বুঝতে পারে তক্ষক হয়তো ভয় পেয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তাই তারা এবার ইন্দ্রকে আহবান করলেন। ইন্দ্র যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হলেন। তক্ষক তখন ইন্দ্রের উত্তরীয়ে (উড়ানি; চাদর) লুকিয়ে ছিলো। জনমেজয় তখন রেগে গিয়ে ইন্দ্রেরে সঙ্গেই তক্ষককে আগুণে নিক্ষেপ করতে বললেন। এবার ইন্দ্র ভয় পেলেন এবং তক্ষককে ফেলে পালিয়ে গেলেন



তক্ষক মন্ত্রের প্রভাবে মােহগ্রস্ত হয়ে যজ্ঞাগ্নির দিকে গর্জন করে আসতে শুরু করলো। তখন পুরহিতে রাজাকে বললো আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, এখন ঐ ব্রাহ্মণকে বর দিতে পারেন। রাজা আস্তীককে বর চাইতে বললেন। আস্তীক তক্ষকের উদ্দেশে বললেন, তিষ্ঠ তিষ্ঠ তিষ্ঠ; তক্ষক তখন আকাশে স্থির হয়ে রইল। এবার আস্তীক বললেন এই যজ্ঞ এখনই বন্ধ হক, আগুনে আর যেন সাপ না পরে। রাজা জনমেজয় বললেন, ব্রাহ্মণ আপনি যা চান তাই দেবো, কিন্তু আমার যজ্ঞ যেন বন্ধ না হয়। রাজা বার বার অনুরােধ করতে থাকলে আস্তীক বললেন, আমি আর কিছুই চাই না, আপনার যজ্ঞ বন্ধ হক, আমার মাতৃকুলের মঙ্গল হক। তখন পুরহিতরা সকলে মিলে রাজাকে বুঝালেন ব্রাহ্মণকে তার চাওয়া বর দিতেই হবে। এবার রাজা বাধ্য হয়ে রাজী হলেন। যজ্ঞ সমাপ্ত হল, সাপেরা প্রাণে বেঁচে গেলো। সবশেষে রাজা আস্তীককে বললেন, তুমি আমার অশ্বমেধ যজ্ঞে পুরহিত হয়ে আবার এসাে। আস্তীক সম্মত হয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেন।

আস্তীক সাপেদের প্রাণ রক্ষা করেছে বলে সাপেরা আনন্দিত হয়ে আস্তীককে বর দিতে চাইলে আস্তীক বললেন, কোনো ব্যাক্তি যদি সর্পভয়বারক মন্ত্র পাঠ করে তাহলে তোমরা তার কোনো ক্ষতি করবে না। সাপেরা বললো, ঠিক আছে ভাগিনা তাই হবে, আমরা তােমার কামনা পূর্ণ করব।

সর্পভয়বারক মন্ত্র
আস্তীকঃ সর্পসত্রে বঃ পন্নগান, যােহভ্যরক্ষত।
তং স্মরন্তং মহাভাগাঃ ন মাং হিংসিতুমহর্থ॥
সর্পাপসর্প ভদ্রং তে গচ্ছ সর্প মহাবিষ।
জনমেজয়স্য যজ্ঞান্তে আস্তীকবচনং স্মর।
আস্তীকস্য বচঃ শ্রত্বা যঃ সর্পো ন নিবর্ততে।
শতধা ভিদ্যতে মূর্ধা শিংশবৃক্ষফলং যথা॥


অর্থ- হে মহাভাগ সর্পগণ, যিনি সপসত্রে তােমাদের রক্ষা করেছিলেন সেই আস্তীককে স্মরণ করছি, আমায় হিংসা করাে না। সর্প, সরে যাও, তােমার ভাল হক; মহাবিষ সর্প, চলে যাও, জনমেজয়ের যজ্ঞের পর আস্তীকের বাক্য স্মরণ কর। আস্তীকের কথায় যে সর্প নিবৃত্ত হয় না তার মস্তক শিশু গাছের ফলের ন্যায় শতধা বিদীর্ণ হয়।


====================================================================

বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।

লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।


====================================================================

সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮

====================================================================
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২১ দুপুর ২:৫৮
৮টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×