আমরা যখন আক্রান্ত, একের পর এক খুন হচ্ছে এক অভিশপ্ত লিস্ট ধরে, একদিন ধমকি খেলাম। কান দেইনি বরাবরের মতই, তবে পরে যখন খেয়াল করলাম এই ধমকি দেওয়া ছেলেটা আমারই শহরের, আইএস এর ফলোয়ার এবং ভক্ত আর তার ফ্রেন্ড লিস্ট ভর্তি লোকাল শিবিরের সদস্য - থানায় গিয়েছিলাম জিডি করতে।
প্রথমদিন আমাকে হঠিয়ে দিলেন এক পুলিশ আপা। তিনি জিডি নেবেন না। তারপর অনেক ছবক ও দিলেন, বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন তিনি। আমি নাছোড়বান্দা, জিডি করাবোই, পাঠালেন থানারই একটু বড় এক অফিসারের কাছে - তিনি সরাসরি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে খুব বিরক্ত ভাবে এক লাইনেই সমাধান দিলেন, "জিডি নেওয়া যাবে না, ফোন নম্বর বদলান, ফেসবুক- ব্লগ সব ডিএকটিভ করে দেন, পারলে দেশের বাইরে চলে যান" - তারপর মুখে এবং বিহেভিয়ারেও বুঝিয়ে দিলেন - "রাস্তা মাপেন"।
এরপর ধর্না দিলাম কমিশনার পদের একজনের অফিসে - দু'দিন ঘোরাঘুরি করার পর চোখের সামনেই দেখলাম সদ্য আসা লোক খাতির তোয়াজে ওপরে গিয়ে "স্যার" এর দেখা পাচ্ছে - আমিই কেবল পাল বংশের একজন হরিদাস।
শেষমেষ একজন বিগশট আত্মীয়ের শ্মরনাপন্ন হলাম নিরুপায় হয়ে - তিনি লিংক দিলেন পুলিশের আমার ডিভিশনের বড়কর্তার - সেখানে গেলাম -তিনি ফোন করলেন থানায়, তারপর বললেন, "থানায় যাও, জিডি নিবে, আর একটু সাবধানে থাকবা।" - এতেই আমি খুশি।
থানায় এলাম। এবারেও আরেক আপা, তবে জিডি নিলেন এবং সাবধানে থাকতে বলেন।
একটা জিডি এনট্রি করতে যে হারে ঘুরতে হয়েছে সেসময় - এরপরে আর কখনো যাইনি খোঁজ নিতে অথবা নতুন ধমকিতে আরেকটা জিডি করতে। কারন লাভ নেই, নিয়মরক্ষায় একটা জিডি করা যাবে, তবে তাতে আমিই আরো এক্সপোজ হয়ে যাচ্ছি - এরকমটা ধরনাও করার থাকে প্রাপ্ত ব্যাবহারে।
ডিবি থেকে ফোন করেই জানিয়ে দিয়েছিলো, "নজর রাখছি, একাউন্টে "সিরাম" কোনো কিছু দেখলে খবর আছে।"
গনজাগরন মঞ্চ এর লোকাল অপারেশন এর সময়ও দেখেছি, পুলিশ এর অনেকেই আমাদের যাষ্ট কোনোমতে সহ্য করছেন, সরকারী আদেশ পেলে যে আমাদের ভর্তা বানিয়ে তারাও কিছু নেকী আর সোয়াব কামাই করে নিতেন সেটা বুঝতে বাকি থাকেনি তখন।
যাকগে, এত কথা বলার কারন, কোন এক হঠাৎ গজানো নাচিয়ে বাঁদরের দল হেফাজতে ইসলাম আর তার দেওয়া সেই ৮৪ নামের অভিশপ্ত একটা লিস্ট এর কারনে আর আমাদের বিশিষ্টসাংবাদিক ভাইদের ওভারস্মার্টনেসের কারনে আমরা, এই নাম ক'টা সারা দেশে মোটামুটি সু-পরিচিত "বলোগার" এবং "নাস্তিক" নামক কোনো অজানা এক হিংস্র প্রানী হিসাবে যাদের মেরে ফেলাটা এমনকি ধর্মের বই আর পয়গম্বরের বানীতেই আছে।
সেসময় অনলাইনে যা দেখেছি আমাদের খুন জায়েজ করতে, বাস্তবতা তার চাইতে অনেকই বেশী খারাপ। অনলাইনে "নাস্তিক বলোগার" কোপানোর ফতোয়া দেওয়া ছেলেটা আমার আপন কেউ না, তবে বাস্তবে যখন দেখেছি এমনকি পরিবারের ক্লোজ লোকেরাও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এসব সমর্থন করে - পায়ের নীচে মাটি থাকে না।
একটু তবু শান্তনা, পরিবারের খুব বেশী লোক জানে না যে আমার লেখার অভ্যেসটা ছিলো কোনকালে। তাই যখন ক্লোজ রিলেটিভরা এইসব খুন জায়েজ করেন ড্রইং রুমের আড্ডায় - চুপ করে শোনা ছাড়া গতি ছিল না, এখনো নেই।
নাস্তিক লিস্টখানা মোটামুটি "সিরিয়াল কুপান্তিস এন্ড হুর-ভেহেশত বুকিং" প্রজেক্ট এর আওতায় আছে সেই ২০১৩ থেকেই - সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে ইসলামেরই আরেক মাজহাব শিয়া কোতল, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান জবাই প্রজেক্ট। বোনাস - "বিদেশী কোপাও - ঈনাম পাও" অফার।
আউটসোর্সিং শিল্পকে তার চরম উৎকর্ষে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে ইসলাম রক্ষার সৈনিকেরা - আইএস আর আলকায়দা এখন বাংলাদেশে খুনও আউটসোর্স করাচ্ছে।
স্বরাস্ট্র মন্ত্রী সেই ১৭৫৭ সাল থেকেই এক ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন - "সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, দেশে জংগী নেই, দেশ আমেরিকা-ইউরোপ হৈতেও নিরাপদ", পুলিশ "তদন্ত-তদন্ত" নামের টেস্ট খেলছে, আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
আবারো পুলিশ এবং সরকার এর বিষয়ে ফিরে আসি।
নাস্তিক মরেছে - আপনারা খানিক টেস্ট খেলে অফ গেছেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান মরেছে - আপনারা লুডো খেলে হাঁপিয়ে গেছেন। বিদেশী মরেছে - আপনারা হাঁক-ডাক দিয়ে "জাইগা আছি" জানিয়ে আবার ঘুমিয়েছেন। এই ফাঁকে যে ইসলামী মৌলবাদী উন্মাদেরা দাবার ছকের মতন আপনাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে তা বুঝতে পারেন নি, আমরা বলে দিয়েছি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি - চোখ খোলেননি আপনারা।
সেদিন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী খুন হয়েছে তার ৬ বছর বয়সী ছোটো বাচ্চাটার সামনে- এটা কিন্তু আপনাদের জানিয়ে দেওয়া যে রাজা, অর্থাৎ সরকার এখন "চেক" এর সামনে - কিশ্তি মাৎ হবার চাল আসতে হয়তো আর দেরী নেই।
গত ডিসেম্বরে জেএমবি ঘাঁটি থেকে থেকে ডজন ধরে সেনাবাহিনীর পোশাক, নেম প্লেট, র্যাংক ব্যাজ, গ্রেনেড আর 'এম-১১' স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার - লক্ষন আমার কাছে ভালো মনে হয় না কোনো ভাবেই।
আমি চাইনা, আমাদের স্বরাস্ট্রমন্ত্রী কোনো এক সকালে উঠে বলুক, "হ্যাঁ আমি ঘুমোচ্ছিলাম, আজ আমারই স্বজন খুন হয়েছে" অথবা দেখতে চাই না আমাদের ল' এনফোর্সার অথবা ডিফেন্স এর অফিসারদের আর কোনো "বিডিআর জেনোসাইড" টাইপ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।
আজকে পুলিশ অফিসারের পরিবারের গায়ে হাত উঠেছে, কাল পুলিশ অফিসারকে খুন করতে ওদের বাধবে কি? সেদিনই তো, শ্যামলকান্তি বিষয়েই ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া" নামে ফেসবুক পেইজে আহ্বান ছিলো, "প্রয়োজনে বাধা দিতে আসা ৫/১০ পুলিশ হত্যা করুন" - এরকম আহ্বান আমরা হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিযানের সময়ও পেয়েছি বাঁশের কেল্লা আর শিবিরের পেইজ/ওয়েবসাইট থেকে।
এখনো বোধহয় সময় আছে - সরকার একটু ঠিকঠাক নজর দিলেই হয়।
নিজের ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:২৬