এটা দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
!@@!446973 !@@!446974 !@@!446975 !@@!446976 !@@!446977]।
ফেরার পথে রাজিবুল নিয়ে চললো !@@!446984 !@@!446985। কেল্লাটি প্রায় আয়তাকার দেয়াল দিয়ে ঘেরা মোগল ধাঁচের একটা বিশাল বাগানের মতো এলাকা। পশ্চিম পাশে রয়েছে শাহী মসজিদ। মসজিদের অঙ্গনের মাঠে এলাকার দুরন্ত কিশোরেরা ক্রিকেট খেলছে মহা আনন্দে। তাদের পেরিয়ে মসজিদের অঙ্গনে প্রবেশ করলাম।
লালবাগ কেল্লার কাজ শুরু হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে, তাঁর পুত্র শাহজাদা আযমের হাতে। ১৬৭৮ সালে কাজ শুরু হয়। সীমানা প্রাচীর, তোরণ, আর পর্যবেক্ষণের টাওয়ার দিয়ে ঘেরা এই কেল্লায় একে একে তৈরী হয় একটি সুরম্য দরবার হল ও হাম্মামখানা, শাহী মসজিদ, আর শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির সমাধি। তবে এর পর শায়েস্তা খানের আমলে ১৬৮৪ সালে এর কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এবং একসময় এটি পরিত্যক্ত হয়। এর পর বিভিন্ন সময়ে আস্তে আস্তে এর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে, দেয়ালের কারূকার্য হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর দায়িত্ব নিয়েছে, এখানে গড়ে তুলেছে একটি জাদুঘর, যেখানে ঐ আমলের অনেক পুরাকীর্তি রাখা হয়েছে।
শাহী মসজিদের সামনে এসে মনে হলো সেই সপ্তদশ শতকের মোগল আমলের কথা। এই মসজিদে বা এই কেল্লার অন্য কোথাও এক সময় শাহজাদা আযম আর শায়েস্তা খান নামাজ আদায় করেছেন। শায়েস্তা খানের আমলের বাংলার সুশাসনের কথা এখনও মানুষে মনে রেখেছে প্রবাদের মাধ্যমে।
শাহী মসজিদ থেকে বেরিয়ে কেল্লার মূল অংশে ৫ টাকার টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম। শুরুতেই পড়ে পরী বিবির মাজার। সুদৃশ্য মোগল স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরী এই সমাধিভবনের মধ্যভাগে রয়েছে শায়েস্তা খানের বড় মেয়ে পরী বিবির কবর। আর তার ডান পাশেই আছে শায়েস্তা খানের কথিত কন্যা শামসাদ বানুর কবর। মাজারের সামনে জলাধার আর ফোয়ারা, তবে আমরা যেদিন গেছি সেদিন সেটা চালু ছিলো না। শাহী মসজিদ আর পরী বিবির মাজার মিলে তুলে নিলাম পঞ্চাশের উপরে ছবি।
এবার চোখ পড়লো দক্ষিণ দিকের প্রাচীরের উপর। সেখানে সারি সারি প্রবেশদ্বার রয়েছে, তবে সবগুলিতেই তালা মারা। মাঝে উপরে উঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম এক বিশাল বাগান। মোগল আমলের পাথর বসিয়ে চমৎকার ভাবে নকশা করে বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছে দক্ষিণ প্রাচীরের ছাদে। আমি ভাবছিলাম, এটা এখনকার নাকি সেই সময়ের। ওখানে কাজ করছিলেন যেই মালি, তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম এটা মোগল আমলের সময় থেকেই রয়েছে।
এই শূণ্যোদ্যান পেরিয়ে কোণার ওয়াচটাওয়ারে চলে গেলাম। এখন ওয়াচ টাওয়ারের সামনেই পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর বৈদ্যুতিক/টেলিফোনের তারের ছড়াছড়ি। কিন্তু দিব্য চোখে দেখতে পেলাম, তিনশ বছর আগে এখানেই থাকতো ২৪ ঘন্টা ধরে তীরন্দাজ আর তলোয়ার ধারী প্রহরীদের অন্তন্দ্র পাহারা। আজ অনেক দিন পর ওয়াচ টাওয়ারটি খাঁ খাঁ করছে। জানালার ভেতর দিয়ে চোখে পড়লো, পরী বিবির মাজার আর মসজিদের দিকে।
ফিরে এলাম বাস্তবে। অনেক ইঁট খসে পড়েছে, আর ছাদের মোগল আমলের কারূকার্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। দেয়ালে অনেক উৎসাহী ব্যক্তি নিজেদের নাম লিখে রেখেছেন, অনেকে তো ছাদের একেবারে মাঝখানটাকেও রেহাই দেননি। অথচ ভারতে ভ্রমণের সময় দেখেছে, ওরা ওদের সব দর্শনীয় স্থানকে পর্যটকদের জন্য একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে রেখে বিদেশীদের কাছ থেকে বিস্তর টাকা কামিয়ে নিচ্ছে।
এবার নেমে দক্ষিণ পূর্ব কোণে কেল্লার মূল অংশের দিকে গেলাম। বাংলাদেশের অনেক আগে বেরুনো ডাকটিকিটে এটারই ছবি দেখেছিলাম। দূর্গে ঢোকার প্রধান ফটক এখানেই ছিলো বলে মনে হচ্ছে। এখন এটার পিছনেই আনসার ক্যাম্প, সেখানে ক্যারম খেলছিলেন অনেকে। আনসারদেরকে অনুরোধ করে তাঁদের ক্যাম্পের ভিতরের দিকের অংশ হতে ছবি তুলে নিলাম।
এবার দরবার হল/হাম্মাম খানার দিকে যাবার পালা। দ্বিতল এই ভবনটির এর পাশেই রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর। শীতকাল বলেই বোধহয়, পুকুরে পানি খুবই কম। তবে এর মাঝে ফুটে রয়েছে পদ্ম আর শাপলা ফুল। পুকুরের অন্য পাশ হতে দরবার হলের ছবি তুলে রওনা হলাম তার দিকে। ভবনটি এখন লালবাগ দুর্গের জাদুঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এক তলায় রয়েছে ঐ আমলের মূদ্রা আর অস্ত্র শস্ত্রের নিদর্শন। দোতলার সিঁড়ির পাশ থেকে পুরো দূর্গ এলাকার অসাধারণ দৃশ্যটি আমার ক্যামেরায় বন্দী হলো। বেলায়েত নিজেও একটা ক্যামেরা এনেছিলো, সেটারও শাটার চলতে থাকলো। জাদুঘরের ভিতরে অবশ্য ছবি তোলা মানা। দোতলার অংশে রয়েছে সেই ১৭শ শতাব্দীর বিভিন্ন দুর্লভ গ্রন্থ ও দলিল পত্র, মোগল আমলের কার্পেট, ফুলদানী ও সুদৃশ্য পাত্র ইত্যাদি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় পড়লো হাম্মাম খানা।
বেরিয়ে একটু বামে তাকাতেই দেখতে পেলাম একটা কামান। সাড়ে তিনশ বছর আগে এই সব যুদ্ধাস্ত্র দিয়েই শায়েস্তা খান আর অন্য মোগল সেনাপতিরা পর্তুগীজ হার্মাদ আর মগ দস্যুদের আক্রমণ হতে বাংলাকে রক্ষা করেছিলেন। কামানটার গায়ে হাত বুলাতেই যেন শুনতে পেলাম, যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গর্জন আর তলোয়ারের ঝংকার।
কেল্লা হতে বেরুতে গিয়ে একবার ফিরে চাইলাম। ঢাকার এই সারি সারি বাড়ি আর জমকালো মার্কেট গুলোর মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কমই। কেল্লার বাইরেই শুরু হয়েছে ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর দোকানপাটের সারি। সামনের রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি দুই-তিনটি রিক্সা কষ্ট করে চলতে পারে মাত্র।
শুনেছিলাম বছর কয়েক আগে, এই কেল্লাতে লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ড শো্থর আয়োজন করা শুরু হয়েছিলো। রাতের আকাশে আলোকরশ্মির খেলার এই প্রদর্শনীটি দিল্লীর ঐতিহাসিক কেল্লাগুলোতে আয়োজন করা হয় নিয়মিতভাবে, দর্শকরা দেশ বিদেশ থেকে দেখতে আসেন সেটা। দুঃখের বিষয়, আমাদের ঢাকা শহরের এই সুপ্রাচীণ নিদর্শনে ঐ প্রদর্শনীটা বেশিদিন চলেনি।
রাজিবুল প্ল্যান করে রেখেছিলো, সেটা অনুযায়ী চললাম শাহী মসজিদ আর বড়ো কাটরার দিকে। পুরানো ঢাকার সংকীর্ণ রাস্তাগুলিতে বিস্তর মানুষের ভীড়। তার মধ্যে বাজারগুলোর রাস্তা জুড়ে ঠেলাগাড়ি আর রিকশার আনাগোনা, ফলে হাঁটার জায়গা একেবারেই নেই। ঠেলে ঠুলে আস্তে আস্তে এগুতে হয়। রাজীবুল ও বেলায়েত এলাকার ছেলে, তাই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। চকবাজার পেরিয়ে !@@!447773 !@@!447774 দিকে চললাম। কিন্তু সেখানে পৌছাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সেই প্রাচীন ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণ একেবারেই নেই। কাটরার দেয়াল ঢেকে গায়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরী হয়েছে ঘরবাড়ি আর দোকানপাট। কাটরার উপরের দিকটা মাদ্রাসার দখলে। আর ঠিক সামনেই পিডিবির বিশাল একটা ট্রান্সফর্মার ও তারের জট থাকায় পুরো ভবনটাই ঢেকে গেছে। কোনোভাবেই বড় কাটরার ছবি তোলা গেলোনা এগুলোকে বাদ দিয়ে। ছোট কাটরার অবস্থা আরো খারাপ, সেটার আর আলাদা অস্তিত্ত্ব নেই, আশে পাশের ভবনগুলোর সাথে জোড়া লাগিয়ে জীর্ণতায় পর্যবসিত হয়েছে সেটা। তার উপর এলাকার বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী ব্যানার, পোস্টার ু এসব টাঙ্গানোতে কিছুই দেখা গেলোনা।
ক্থদিন আগে টিভিতে দেখেছিলাম, সোয়ারীঘাট বাজারের কথা, দুশো বছরেরও বেশি পুরানো সেটি। তাই ভীড় ঠেলে চলে গেলাম সেখানে। দুশো বছরে ঘাট এলাকায় খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হলোনা। সেই গরুর গাড়ি, ডিঙ্গি নৌকা, এসবের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া হিসাবে কেবল যন্ত্রচালিত একটা বড় নৌকাকেই দেখা গেলো।
ফিরে চললাম, পথে পড়লো !@@!447917 !@@!447918 !@@!447919। সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে কারাগারটি ঘেরা। অনেক নাটক, সিনেমাতে এই কারাগারের প্রবেশদ্বার দেখেছি। পাশের ছোট দরজার পাশে বিপুল পরিমাণ মানুষের ভীড়, আপনজনদের ব্যাপারে ছুটোছুটি করছে। কারাগারের ভেতরে তো আর যেতে দিবে না, তাই প্রধান প্রবেশ দ্বারের ছবি তুলে নাজিমুদ্দিন রোড দিয়ে চলে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো, কাছেই তো !@@!447968 !@@!447969, সেটাতে যাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে তো অবাক, দক্ষিণ দিকে বিশাল পুকুর। আর সাদা রঙের হোসেনী দালানটি পুরোটাই ইসলামী ক্যালিগ্রাফির সুদৃশ্য নীল বর্ণের কারূকার্যে মন্ডিত। ভিতরের অংশের চমৎকার নকশাগুলোর ছবি অবশ্য আর এদিন তুলিনি, কেননা সেখানে তখন জোহরের ওয়াক্তের নামাজ চলছিল। খাদেমের অনুমতি নিয়ে বাইরের ছবি তুলে পেছনের পুকুর এলাকায় চলে গেলাম। সেখান থেকে হোসেনী দালান ভবনের চমৎকার কিছু ছবি তুলে নিলাম। চোখ পড়লো ক্যামেরার ছবির সংখ্যার দিকে, ততক্ষণে ৩০০ পেরিয়ে গেছে। আর এতো ছবি তুলতে তুলতে ব্যাটারির চার্জও শেষ। তাই শেষমেস আজকের মতো বাদ দিলাম। সেই সকাল ১০টায় ছবি তোলার কাজ শুরু করেছিলাম, বেলা গড়িয়ে তখন দুপুর ২টা বাজে।
পরে বাসায় ফিরে গুণে দেখলাম, মোট ছবির সংখ্যা ৩০৫টি। কিছু ছবি ভালো আসেনি, কিন্তু কম করে হলেও দুশোর উপরে চমৎকার ছবি এসেছে। এই ছবিগুলো আমরা উইকিমিডিয়া কমন্সে যোগ করে দেবো অচিরেই। এই সাইটটি হলো উইকিপিডিয়া প্রকল্পের অংশ, যেখানে মুক্ত লাইসেন্সের ছবি বা ভিডিও রাখা হয়, সারা বিশ্বের সব মানুষের ব্যবহারের জন্য। যে কেউ যে কোনো প্রয়োজনে এখানকার ছবি ব্যবহার করতে পারবেন, নির্দ্বিধায়। ফলে আমাদের এই পুরানো ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারা যাবে, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমরা রেখে যেতে পারবো একবিংশ শতকের গোড়ার দিকের পুরানো ঢাকার চালচিত্র।
এই ছবিগুলো তুলতে আমাদের ৪ ঘন্টা সময় লেগেছে মাত্র। রাজিবুল ও বেলায়েত ু এই দুই টগবগে তরুণের সাহায্য না পেলে সম্ভব হতোনা কাজটা করা। কিন্তু আমাদের এই সামান্য শ্রমের বিনিময়ে যদি পুরানো ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর কথা আমরা তুলে ধরতে পারি, অল্প হলেও, তবে আমরা হাজার বার এই কাজটা করতে রাজি আছি। আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ু এসব সংরক্ষণ করার কাজটা বিদেশ থেকে কেউ এসে করে দেবে না। এটা আমাদেরকেই করতে হবে। উন্মুক্ত বিশ্বকোষের এই প্রযুক্তি আমাদের সেই সুযোগটা দিচ্ছে। লাখ, কোটি টাকা ব্যয়ের দরকার নেই, আমাদের এই গরীব দেশের মানুষের দেশের প্রতি ভালোবাসা আর একটু চেষ্টা, সহযোগিতাই এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সংরক্ষণে, বিশ্বের কাছে তুলে ধরায় অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সবার কাছে রইলো অনুরোধ, বাংলাদেশের সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তুলে !@@!448280 !@@!448281 !@@!448282 দিয়ে দিন, মুক্ত লাইসেন্সের অধীনে সেটিকে সারা বিশ্বের মানুষের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিন। লাভটা পৃথিবীর ভবিষ্যত প্রজন্মেরই। [সমাপ্ত]
[যারা ছবি দিতে চান তাঁরা আমাকে ইমেইল করতে পারেন ragibhasan AT gmail DOT com এই ঠিকানায়। কোথায় ছবি দিতে হবে, আমি তা বলে দিবো।]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০০৭ রাত ১১:৪৬