somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষার ধর্ম | ধর্মের ভাষা /

২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কয়েকজনে গিয়েছিলেন খেতে কলকাতার এক রেস্তোঁরাতে। পেটপুরে ভাত খাবার পরে বেয়ারাকে “পানি” দিতে বলাতে রেস্তোঁরার গোঁড়া মালিক সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেরা করেছিলেন, “আপনারা কি মোহামেডান”?

জবাবে রসিক এক খেলোয়াড় বলেছিলেন, “কী যে বলেন দাদা, মোহামেডান হতে যাবো কেনো!! আমরা সবাই ভিক্টোরিয়ান”*।

এক বাঙালি জাতি, সেই চর্যাপদের আমল থেকে বাংলা বলতে বলতে কখন যেনো নিজের অজান্তেই ভাষাকে ভাগ করে ফেলেছে ধর্মীয় লেবাসে।

--

জল নাকি পানি, এই বিতর্ক এই ভেদাভেদ এখন প্রকট হয়ে গেছে পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুসলিম প্রধান এবং হিন্দু প্রধান এলাকাতে। এক সময় অর্কুট নামের ব্যর্থ সোশাল নেটওয়ার্কের এক কমিউনিটির সদস্য ছিলাম, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো (কাগজে কলমে), দুই বাংলার মিলন সাগর। কিন্তু ঘটিদের বাগে পেলে বাঙালেরা যেমন সাইজ করে, সেই কমিউনিটিতে হাতে গোনা দুই বাংলাদেশীর একজন হওয়াতে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, উল্টোটাও সত্য। বাংলাদেশ = মুসলিম = সন্ত্রাসী এই ফরমুলাতে ধাতানী দেয়ার এক পর্যায়ে মস্তান দাদা যে থিওরি দিলেন, তা এরকম – বাংলাদেশের বাংলা আর বিশুদ্ধ বাংলা নেই, তা এখন উর্দুঘেষা বাংলাতে পরিণত হয়ে গেছে, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই “জল” এর বদলে “পানি” বলে, যা নাকি খাস উর্দু থেকে চাপানো হয়েছে।

ঘটি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের এই তত্ত্ব আগেও শুনেছি ... কেবল আমিই শুনেছি তা না, আমাদের বাঙাল গর্ব সুনীল গাঙ্গুলীকেও শুনতে হয়েছে বহুকাল। হাজার হলেও সুনীল ফরিদপুরের খাস বাঙাল, ৪৭ এর দেশ বিভাগের পরে যখন তাঁর স্থায়ী নিবাস কলকাতায়, তখন তাঁকেও “পানি” নিয়ে উপহাসের স্বীকার হতে হয়েছে। আত্মজীবনী “অর্ধেক জীবন” বইটাতে সুনীল “পানি” শব্দের এই “ধর্মীয় লেবাস” সম্পর্কে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন, কেননা পানি শব্দটি আদতে সংস্কৃত মূল “পান্য” থেকে এসেছে বাংলাতে, তার পাশাপাশি হিন্দুস্থানীতে (ও তার অধুনা সন্তান হিন্দি ও উর্দুতে)। এক মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা জল হয়ে গেলো “খাঁটি বাংলা”, আর “পানি” হয়ে পড়লো “মুসলমানী (বিকৃত) বাংলা”, পশ্চিমবঙ্গে (এবং হয়তো পূর্ববঙ্গেও) প্রচলিত এই ধর্ম-শব্দ-ধারনার কারণ কী, সুনীল প্রশ্ন করেছেন সেখানে।

---
সুনীলের প্রশ্নটা আমাকেও ভাবায়, বাংলাতে আরবী শব্দ যে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করেন না, তা নয়। “কাগজ”, “কলম”, এরকম আরবী শব্দ ব্যবহারে তো কারোরই কোনো আপত্তি নেই। নেই আপত্তি “আইন” শব্দটিতে, কিন্তু সংস্কৃত পানি শব্দটি কীভাবে হয়ে গেলো “মুসলমান”, আর জল হয়ে গেলো “হিন্দু”?

পারিবারিক সম্পর্কের শব্দগুলো চুড়ান্ত রকমের ধর্ম-ভিত্তিক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সম্ভবত কেউই “আম্মা” বা “আব্বা” বলেননা, যেমন মুসলমানেরা বলেননা “পিসি”। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত “ভাইয়া” শব্দটি সর্বত্র মুসলমান শব্দ বলেই বিবেচিত হয়, (গল্পে নাটকে মুসলমান চরিত্রগুলোর মুখেই আসে দেখি)। অথচ আরেকটু পশ্চিমে গেলেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই ভাইয়া বলে চলে। ভাই শব্দটি কোথা থেকে এসেছে, অ-ভাষাবিদ আমার পক্ষে জোরসে বলা অত সহজ নয়, কিন্তু প্রায় নিশ্চিত যে সংস্কৃত “ভ্রাতঃ” শব্দ থেকেই এটা এসেছে, ইন্দো-ইয়ুরোপীয় সংযোগের সুবাদে যার ইংরেজি রূপ “ব্রাদার”। তাহলে ভাইয়া কেনো মুসলমান আর দাদা হলো হিন্দু?

বাংলার এই ধর্মীয় শব্দভেদ তাহলে এলো কীভাবে? বাংলার পশ্চিমের এলাকাগুলো সব সময়ে যে মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিলো, তাও নয়, বরং বাংলার চাইতে ভারতের সেই সব এলাকায় মোগল পাঠান শাসকদের শাসন চলেছে অনেক বেশি। খোদ বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গেও সর্বত্র মুসলিম শাসন ছড়িয়ে যায় নি, তার পরেও কেনো পূর্ববঙ্গের ভাষায় তথাকথিত “মুসলিম” বাংলার আধিক্য, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত “শুদ্ধ” শব্দের ব্যাপকতা বেশি?

--
কলকাতার সেই হোটেল মালিক জল আর পানিতে ধর্ম চিনতে চেষ্টা করেছিলেন। দাদা আর ভাই, জল আর পানি, -- কেমন করে যেন বাংলা শব্দগুলো চাপা পড়েছে ধর্মের লেবাসে, তাই গোসল আর স্নানে, নিমন্ত্রণ আর দাওয়াতে আমরা চিনে নেবার চেষ্টা করি মানুষের ধর্মীয় পরিচয়, এক লহমায় ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে। সেই স্টেরিওটাইপ আমাদের মন মানসে নিয়ে আসে মরিচ, কিংবা স্থানভেদে লংকার ঝাল, কিংবা লবন অথবা নুনের মতো স্বাদ।

-----------------------------

[পাদটীকা ১] ভাষার উপরে উপরের লেখাটিতে বিস্তর “সম্ভবত” ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ অনেকটাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কুপমন্ডুক হিসাবে আমার দৃষ্টিসীমা একটু সীমাবদ্ধ, কাজেই অনেক শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণাটিও সেরকম। দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।

[পাদটীকা ২] সেই সময়ে ঢাকার দুই বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ছিলো মোহামেডান আর ভিক্টোরিয়া

[পাদটীকা ৩] বাংলা উইকিতে এই সংক্রান্ত ঝামেলা বাঁধার আগেই আমরা ভাবছি, ব্রিটিশ-আর-আমেরিকান বানানের/শব্দের মতো রীতিটা হয়তো বেছে নিবো। অর্থাৎ কেউ একটা বানান/শব্দ বেছে নিয়ে নিবন্ধ শুরু করলে সেটা "ঠিক" করার চেষ্টা হবে না, আর এলাকা ভিত্তিক বিষয়বুঝে শব্দ/বানান ব্যবহার করা হবে। দেখা যাক, এই ব্যাপারে শেষমেশ কী ঠিক করা চলে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:১৫
৩৭টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×