শাহেদ জামাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
সে বাকি জীবনে কোনো কাজকর্ম করবে না। জীবনের অর্ধেক সে পার করে ফেলেছে। তার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ। আগামী পঁয়ত্রিশ বছর কি সে বাঁচবে? সম্ভবনা কম। চল্লিশ বছরের পর থেকেই তো নানান অসুখ বিসুখ দেখা দেয়। বাকি যেক’টা দিন সে বাঁচবে রোগশোক নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। অযথা কাজকর্ম করে সে আর সময় অপচয় করতে চায় না। বাকি জীবনটা সে এনজয় করতে চায়। সে খাবে, ঘুরবে, বই পড়বে, লিখবে আর মুভি দেখবে। এভাবেই সে তার মৃত্যু পর্যন্ত সময়টা কাজে লাগাতে চায়। তাছাড়া তার কোনো সন্তান নেই। স্বামী স্ত্রী দু’জন মাত্র মানুষ। কোনো ভাবে ঠিকই চলে যাবে। শাহেদ জামালের চাকরি কোনোদিন হবে না। সহজ সরল সত্য কথা হলো- এই শহরে ক্ষমতাবান মামা চাচা না থাকলে চাকরি পাওয়া যায় না।
শাহেদ জীবনে চাকরির জন্য বহু ইন্টারভিউ দিয়েছে।
সে এখন ক্লান্ত। বিধস্ত। তার ধারনা তার মতো এত ইন্টারভিউ এই দেশে আর কোনো ছেলে দেয়নি। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তার দারুন সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। এক টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে। কাওরানবাজার অফিস। চ্যানেলের মালিকের ছেলে একটা হাফ প্যান্ট পরে আছে। তাও আবার লাল হাফপ্যান্ট। হাফপ্যান্টের উপরে কালো জ্যাকেট। পায়ে লাল কেডস। এক কানে আবার একটা দুল। সে চিপস আর কোক খাচ্ছে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলল, কত টাকা সেলারি আশা করেন? শাহেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রথমেই এই প্রশ্ন করবে শাহেদ স্বপ্নেও ভাবেনি। শাহেদ কত বলবে? বেশি করে বলবে, না কম করে বলবে? শাহেদ সাহস করে বলল, যাট হাজার টাকা। লাল হাফপ্যান্টওয়ালা বলল, স্যরি আমরা বাইশ হাজারের বেশি দিবো না। আপনি আসতে পারেন। শাহেদ বলল, স্যার আমার বাইশ হলেও চলবে। লাল হাফপ্যান্ট বলল, এগেইন স্যরি। আপনার টাইম শেষ।
এক বড় কোম্পানীতে শাহেদ ইন্টারভিউ দিতে গেল।
এই কোম্পানীর নানান ধরনের কনজুমার প্রোডাক্ট আছে। গুলশান এলাকায় বিরাট অফিস। উত্তরাতেও তাদের অফিস আছে। বড় হল রুমে পাঁচ জন খুব ভাব নিয়ে বসে আছে। এদের মধ্যে একজন টাইপরা। উনিই প্রথম শাহেদকে প্রশ্ন করলেন। আপনি ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন, অথচ টাইপরে আসেন নি কেন? আমাদের কোম্পানী কত বড় এ সম্পর্কে আপনার কোনো ধারনা নেই? শাহেদ বলল, স্যার আমি টাই বাঁধতে পারি না। তবে ইউটিউব দেখে এক দুই মিনিটের মধ্যে শিখে নিতে পারবো। পাশে বসা এক বয়স্ক লোক প্রশ্ন করলেন- আপনি কি চানাচুর খান? শাহেদ বলল, জ্বী স্যার খাই। চানাচুর কি আমাদের শরীরের জন্য ভালো? না খারাপ? শাহেদ বলল, স্যার চানাচুর শরীরের জন্য খারাপ। বয়স্ক লোক বলল, আপনি জানেন আমাদের কোম্পানীর চানাচুর যে বিদেশে রপ্তানি হয়। শাহেদ বলল, ও আচ্ছা! বুঝতে পেরেছি স্যার। এই কথা শুনে বয়স্ক লোক রেগে গেলেন। শাহেদ সালাম দিয়ে হল রুম থেকে বের হয়ে এলো। মনে মনে বলল, চানাচুরের মায়রে বাপ!
এবার পত্রিকা অফিসের ইন্টারভিউ।
এই পত্রিকা অফিস নতুন। মালিকের কাঁচা পয়সা আছে অফিস দেখলেই বুঝা যায়। মালিকের শালা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। পাশে আরো দুইজন বসা। তিনজন মিলে কফি আর সিগারেট খাচ্ছেন। পুরো রুম ধোয়ায় ভরে গেছে। তিনি বললেন, পত্রিকা অফিসে আগে কাজের অভিজ্ঞতা আছে? শাহেদ বললো, জ্বী ভাই আছে। মালিকের শালা হঠাত করে শাহেদের উপর রেগে গেলেন। রাগ করার কারন হচ্ছে- মালিকের শালাকে স্যার না ডেকে, কেন ভাই ডাকা হলো? শাহেদ বললো, পত্রিকা অফিসে তো সবাই সবাইকে ভাই বলেই ডাকেন। এমনকি সম্পাদককে ভাই বলে। শালা রেগে গিয়ে বললেন, আপনার কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। আগে ভদ্রতা শিখুন। শাহেদ বলল, স্যার ভদ্রতা শেখার কোনো স্কুল কি আছে? আপনার জানা থাকলে ঠিকানাটা আমাকে দিবেন। প্লীজ। মালিকের শালা শাহেদের দিকে রক্তচক্ষু লুক নিয়ে তাকিয়ে থাকলো।
ট্রাভেল এজেন্সিতে ইন্টারভিউ।
তারা প্লেনের টিকিট করে, ভিসা করিয়ে দেয়। সৌদি, মালোশিয়া আর দুবাইতে শ্রমিক পাঠায়। এমন কি সারা দেশে তাদের সতেরটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টও আছে। ছোট্র একটা রুমে প্রায় সাতজন বসে আছে। শাহেদ তাদের সামনে ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন শাহেদ ভাজা মাছটি উল্টিয়ে খেতে জানে না। প্রথম জন প্রশ্ন করলেন, কখনও বিদেশ গিয়েছেন? শাহেদ মিথ্যা করে বলল, জ্বী স্যার মালোশিয়া এবং সৌদি গিয়েছি। দ্বিতীয় জন প্রশ্ন করলেন, সৌদির কোন এলাকায় ছিলেন? শাহেদ বলল, হাফার আল বাতেন। হাফার আল বাতেনটা কোথায়? শাহেদ বলল, একদম ইরাকের বর্ডারের কাছে স্যার। পুরা মরুভূমি এলাকা। তৃতীয় জন বলল, সৌদিতে কি কাজ করতেন। শাহেদ বলল, কাঠ মিস্ত্রীর হেলপার ছিলাম। আপনি কি কাঠের কাজ জানেন? শাহেদ বলল, না। তবে আমার আকামা (ভিসা) ছিল কাঠ মিস্ত্রির হেলপার। তবে আমি কাজ করতাম একটা শপিংমলে। আরো অনেকে নানান প্রশ্ন করলো। শাহেদ সব গুলোর প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হলো। শাহেদ মনে কনে ভাবলো তার এই চাকরিটা হয়ে যাবে। কিন্তু না, চাকরি হলো না।
রিয়েল এস্টেট কোম্পানি।
এই কোম্পানীর ফ্লাটের সবচেয়ে কম দাম হচ্ছে এক কোটি টাকা। এছাড়া তারা বিদেশ থেকে টাইল, বাথরুম ফিটিংস ইত্যাদি আনে। সেই রকম তাদের অফিস। তকতকে ঝকঝকে। সরাসরি ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যান ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। শাহেদ চুপ করে বসে আছে। চেয়ারম্যান কার সাথে যেন মোবাইলে রেগে রেগে কথা বলছেন। বারবার বলছেন- ‘don't do this again’। এটা মনে হয় তার মুদ্রাদোষ। যাই হোক, প্রথম প্রশ্ন করলেন চেয়ারম্যান, চাকরিটা কি আপনার খুব দরকার? কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কি পুরোটা মুখস্ত করে ফেলেছেন? Jobs Guide পুরোটা মুখস্ত করে বসে আছেন? কোনো লাভ নাই। চাকরি হবে না। আপনাকে চাকরি দিতে পারবো না। আমরা অভিজ্ঞ লোক চাই। স্যরি। তবে আপনার সিভিটা রেখে দিলাম। সামনে আমাদের প্রতিষ্ঠান আরো বড় হচ্ছে। আমাদের অনেক লোক লাগবে।