সুমন অনুরোধ করে বলল, সোনিয়া মা'র জন্য নাস্তা বানাও।
সোনিয়া তেজ দেখিয়ে বলল, আমি তোমার মার জন্য নাস্তা বানাতে পারবো না। আমার ঠেকা পরে নাই। তোমার মা-বাবা আমার কিছু না। তাদের জন্য আমি কিছু করতে পারবো না। এই কথা শুনে সুমন খুব কষ্ট পেলো। তাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। বিয়ের আগে দুই বছর প্রেম করেছে। প্রেমের সময় সোনিয়া বলেছে, তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি তোমার পরিবারের সবাইকে আপন করে নিবো। তোমার বাবা মায়ের যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না। আজ সকালে বুয়া আসেনি। এখন সকাল দশটা, সুমনের মা না খেয়ে বসে আছে। মার সকালে নাস্তা খেয়ে ওষুধ খেতে হয়। সুমন মা'র কাছে গিয়ে বলল, মা তোমাকে আজ হোটেল থেকে নাস্তা এনে দেই। সোনিয়ার মনে হয় জ্বর এসেছে। ও নাস্তা বানাতে পারবে না। সুমনের মা বললেন, হোটেলের রুটি আমি খেতে পারি না। শক্ত শক্ত লাগে। বাসার আটা রুটি খেয়ে আরাম পাই।
সোনিয়া শুধু নিজের ঘর গুছিয়ে রাখে।
নিজের ঘরের কাজ ছাড়া সে আর কিছুই করতে চায় না। বিশেষ করে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। অথচ তারা বুড়ো মানুষ। এ বয়সে তাদের সেবা যত্নের দরকার আছে। বাবা-মা হয়তো শখ করে সুমনকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলের বউ এসে সংসারের হাল ধরবে। সব দেখাশোনা করবে। কিন্তু না, সোনিয়া তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। অথচ বিয়ের আগে এই সোনিয়া'ই সুমনের বাবা-মার সাথে কত আহ্লাদ করেছে। প্রতিদিন ফোনে কথা বলেছে। বলেছে, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এই সংসারে এলেই সব দায়দায়িত্ব নিয়ে নিবো। আপনাদের কোনো কাজ করতে হবে না। সব আমি দেখাশোনা করবো। আপনারা শুধু খাবেন আর টিভি দেখবেন। এখন শ্বশুর শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও সোনিয়া তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। রান্নাবান্না তো দূরের কথা। সুমন তার স্ত্রীর জন্য বাবা-মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করে তার মধ্যে। তার স্ত্রী যদি সামান্য একটু নজর দিত তার বাপ মায়ের দিকে। সংসারটা কত সুন্দর'ই না হতো!
যেদিন সোনিয়া চিৎকার করে বলল-
আমি তোমার বাপ মায়ের জন্য কিছু করতে পারবো না। সেদিন অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো- চুলের মুঠি ধরে সোনিয়াকে বাসা থেকে বের করে দিত। বের করার আগে দুই-চারটা চড়-থাপ্পড় দিত। কিন্তু সুমন অসম্ভব ভদ্র ছেলে। তারপক্ষে স্ত্রী গায়ে হাত তোলা সম্ভব নয়। সে এমন শিক্ষা পায়নি বাপ মায়ের কাছ থেকে। তার চুক্ষু লজ্জা আছে, সমাজের ভয় আছে। সোনিয়ার জন্য সে তো তার মা-বাবাকে ফেলে দিতে পারে না। তার বাবা-মা তার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। সুমন এর বন্ধু আশিক। আশিক এই ভয়ে যতদিন বাবা-মা বেঁচে ছিলেন ততদিন বিয়েই করে নি। আশিক তার বাপ মায়ের অবহেলা সহ্য করতে পারবে না, এই ভয়ে। আশিক এর বাবা মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তত আশিক মন ভরে তাদের সেবা যত্ন করেছে। বিয়েটা করে ফেললে বাপ-মায়ের সেবা যত্ন করতে পারতো না। পরের মেয়ে এসে বাপ-মায়ের সেবা যত্ন করে না। নো, নেভার। আশিকের মনে বেশ আত্মতৃপ্তি আছে। কোনো অনুশোচনা নেই। অথচ সুমন তার বাপ মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছে না। ভীষন কষ্ট। ভীষন।
সুমন সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকে।
দিনের মধ্যে সে বেশ কয়েকবার ফোন করে বাবা মায়ের খোজ খবর নেয়। অথচ একই বাসায় থেকে সোনিয়া তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির কোনো খোজ খবর নেয় না। সে ব্যস্ত থাকে মোবাইল নিয়ে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে। সারাদিন সোনিয়া অনলাইনে এটা সেটা অর্ডার দিতেই থাকে। অথচ ঘর থেকে দু'পা বাইরে বের হলেই কত কত শপিংমল। বাসার রান্নাটা পর্যন্ত সোনিয়া করে না। বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। অথচ বিয়ের আগে সে সুমনকে বলছে, আমি অনেক সুন্দর রান্না জানি। রান্না করতে আমার ভালো লাগে। মাত্র চারজন মানুষ আমরা। তুমি আমি আর বাবা মা। চারজনের রান্না করা কোনো ঘটনাই না। বিয়ের আগে অর্থ্যাত প্রেমের সময় মেয়েরা অনেক কথাই বলে। এগুলো সবই ফালতু কথা। মিথ্যা কথা। আবেগের কথা। সেসব কথাকে সত্য বলে মনে করলে বিয়ের পর বিরাট বিপদে পড়তে হয়। সুমনের এক ভাই ও বোন আছে। তারা বিদেশে থাকে। মনে হয় না, তারা আর দেশে ফিরবে।
অফিস শেষ করে সুমন বাসায় এসে প্রতিদিন একই চিত্র দেখে।
তার বাপ মা ঘরের এক কোনায় বসে আছে। হয়তো তাদের কারো জ্বর। অথবা কেউ বমি করে কাহিল হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। সোনিয়া ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং বা ভিডিও কলে ব্যস্ত। বুয়া ঘরের কাজ শেষ করে চলে গেছে। সুমন এসে যদি বাপ মাকে সময় দেয়, তখন আবার সোনিয়া খুব চিল্লাচিল্লি করে। একটা কথা আছে- 'আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর'। সোনিয়ার বড় ভাই রফিক বিয়ে করেছে। বিয়ের পর রফিকের বউ রফিকের বাপ-মা'র দিকে ফিরেও তাকায় না। ঘরের কোনো কাজ করে না। প্রতিদিন নানান উছিলায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাইরে বাইরে থাকে। সোনিয়ার অসুস্থ বাপ-মা ভীষন কষ্টে আছে। তাদের ছেলের বউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। বাসায় সারাদিন তারা একাএকা থাকেন। আজ সুমন খুব খুশি। সে সোনিয়াকে বলল, এটাকে বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৯