বাবুই পাখী খুব সুন্দর বাসা বানায়।
বাবুই পাখির বাসা উল্টানো কলসীর মত দেখতে। বাসা বানাবার জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয় ঘাসের আস্তরণ সারায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে(পালিশ করে) গোল অবয়ব মসৃণ করে। কথিত আছে: রাতে বাসায় আলো জ্বালার জন্য বাবুই জোনাকী ধরে এনে গোঁজে। এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে শহরে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। এ বাবুই পাখির বাসাগুলো শোভা পাচ্ছে ধনীদের ড্রইং রুমে। বাবুই পাখির ইংরেজী নাম Weaver । এদের গায়ের রং হলুদ ও খয়েরিতে মিশানো। অনেকটা চড়ুই পাখির মতো দেখতে তবে এদের আকার ও রং বিচিত্র ওনেকটা বেশি। আফ্রিকাতে হলুদ রঙের বাবুই পাখির দেখা মেলে। সারাবিশ্বে বাবুই পাখি ১১৭ প্রজাতির।
বাবুই এটি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাবুই সাধারণত ৩ প্রজাতির হয়ে থাকে।
১/ দেশি বাবুই,
২/ দাগি বাবুই,
৩/ বাংলা বাবুই।
বাবুই পাখি বাসা তৈরির পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়।
সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য কতই কিছু না করে এরা। পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণ করার জন্য খাল-বিল ও ডোবায় ফুর্তিতে নেচে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হলে কাঙ্ক্ষিত স্ত্রী বাবুইকে সেই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলেই কেবল সম্পর্ক গড়ে। স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুইয়ের সময় লাগে চারদিন। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন কাজ করে বাসা তৈরি করে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। ধান ঘরে ওঠার মৌসুম হলো বাবুই পাখির প্রজনন সময়। দুধ ধান সংগ্রহ করে স্ত্রী বাবুই বাচ্চাদের খাওয়ায়। এরা তাল গাছেই বাসা বাঁধে বেশি।
বাবুই পাখি সাধারণত মানুষের কাছাকাছি বসবাস করে, তাই দেখা যায় এদের বাসা মানুষের হাতের নাগালের মাত্র পাচ অথবা ছয় ফুট উপরে। ফলে অনেক অসচেতন মানুষ এদের বাসা ভেঙে ফেলে আর একারণেই এদের সংখ্যা রহস্যজনকভাবে কমে যাচ্ছে। বাংলার এই শিল্পী পাখি নানা সময়ে নানা কবি সাহিত্যিকের রচনার বিষয় হয়েছে। শুধু গল্প করে নয় আগামী প্রজন্মকে প্রকৃতির এই সুন্দর সৃষ্টিকে জানাতে ও তাদের ঊপভোগ করার সু্যোগ করে দিতে, জীব জোগতের ভারসাম্য বজায় রাখতে , আগামীর জন্য একটা সুন্দর বাংলা উপহার দিতে আমরা এদেরকে সংরক্ষনে মন দিই। ফুলের মধু রেণু, শস্যদানা, ছোটো পোকা, ঘাস, বীজ, ভাত, ছোটো উদ্ভিদের পাতা ইত্যাদি খেয়ে থাকে। অনেকেই একে তাঁতী পাখি বলে ডেকে থাকেন।
দাগি বাবুই যার বৈজ্ঞানিক নাম Ploceus philippinus এবং ইংরেজি নাম Ploceus manyar। অফুরন্ত যৌবনের অধিকারী প্রেমিক যত প্রেমই থাক প্রেমিকার জন্য, প্রেমিকার ডিম দেওয়ার সঙ্গেই প্রেমিক বাবুই খুজতে থাকে আরেক প্রেমিকা। পলাশবাড়ী উপজেলায় এক সময় প্রচুর তাল, খেঁজুর ও নারিকেল গাছ ছিল। এ সকল গাছে বাসা বেঁধে বাবুই পাখি বসবাস করত। শিকারিদের বেপরোয়া আচরণের কারণে এ এলাকাসহ সমগ্র উত্তরাঞ্জল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি। ১০-১৫ বছর আগে শেরপুর উপজেলার গ্রামগঞ্জে তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেলগাছে বাবুই পাখির বাসা দেখা যেত। গাছের পাতার সাথে ঝুড়ির মতো করে সুনিপুণভাবে বাসা বুনে এরা বাস করে। একেকটি বাসা একেক রকম। কোনো বাসা লম্বা, কোনোটি আবার গোল, কোনোটি চ্যাপটা। প্রতি বাসায় দুই-তিনটি করে কুঠুরি। ধানসহ অন্যান্য ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার, ফাঁদ ও গুলি করে হত্যার কারণে এ এলাকাসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি।
নওগাঁর মহাদেবপুরসহ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যেত বাবুই পাখির বাসা। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোঁনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। আজও ৩য় শ্রেণীর পাঠ্য বইতে ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি পাঠ্যসুচী হিসাবে অর্ন্তভূক্ত আছে। বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে আমি মনে করি এবং সরকারীভাবে ব্যবস্থা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করছি। চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশ এলাকার পল্লী অঞ্চলে আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা আজ আর চোখে পড়ে না।
একসময় ঝালকাঠির প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গেলে দেখা যেত শত শত বাবুই পাখির বাসা। বর্তমানে যেমন তালগাছসহ বিভিন্ন গাছ নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে তেমন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও। আগে নীলফামারী জেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশ দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। খড়, তালগাছের কচিপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে চমত্কার বাসা তৈরি করত বাবুই পাখি। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙে পড়ে না। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া যায় না। বাবুই পাখির অপূর্ব শিল্প শৈলীতে বিস্মিত হয়ে কবি রজনীকান্ত সেন তার কবিতায় লিখেছিলেন,
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
“কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোধ, বৃষ্টির, ঝড়ে।”
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তাই ?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”
মানুষকে মানবিক দিক থেকে জাগ্রত করার জন্য কবি রজনীকান্ত সেন এ কবিতাটি রচনা করেন। তার এ কালজয়ী কবিতাটি এখনো মানুষের মুখে মুখে। বাবুই পাখিকে নিয়ে কবির স্বাধীনতার সুখ কবিতাটি আজও মানুষ উদাহরণ হিসেবে ব্যাবহার করলেও হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও বাবুই পাখির বাসা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১১