শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা ফিরলাম ট্রেনে করে।
ভয়াবহ সেই ট্রেন। পা রাখার জায়গা নাই। ট্রেনের নাম কাঞ্চন। আসাম থেকে এসেছে যাত্রী বোঝাই করে। কোনো রকমে ট্রেনে উঠলাম। যাওয়ার সময় বেশ আরামেই গিয়েছিলাম। যাই হোক, ট্রেন চলছে খুব স্প্রীডে। ট্রেন থামবে শিয়ালদহ স্টেশনে। বিশাল স্টেশন। পুরো ট্রেন ভর্তি মানুষ আর মানুষ। বহু লোক সিট পায়নি তারা নিচেই পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে। সুরভি বেশ মজা পাচ্ছে। আমি প্রচন্ড বিরক্ত। পা রাখার জায়গা নাই এর মধ্যে প্রচুর হকার আসছে-যাচ্ছে। কেউ কফি, কেউ চিপস, কেউ বাদাম ইত্যাদি বিক্রি করছে। প্রচুর বেচা কেনা হচ্ছে। আমাদেরর ভাগ্য ভালো আমরা বর্ধমান গিয়ে বসার জায়গা পেলাম। বহু লোক বর্ধ্মান নেমে গেল। ট্রেনে মোবাইল চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি মোবাইল চার্জ দিয়ে নিলাম।
সন্ধ্যায় শিয়ালদহ স্টেশনে নামলাম। স্টেশনে হাজার হাজার মানুষ। হাঁটছি তো হাটছি'ই প্লাটফর্ম আর শেষ হয় না। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বের হলাম কিন্তু কেউ টিকিট দেখতে চাইলো না। তার মানে টিকিট না কাটলেও চলতো। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছেই বিশাল এক 'বিগ বাজার'। এই বিগ বাজারে সব রকমের জিনিস পাওয়া যায়। সুরভি সেখানে গেলো কিছু কেনাকাটা করলো। বিগ বাজারের সামনে থেকেই বাসে উঠলাম। দুই জনের ষোল টাকা ভাড়া দিলাম, ধর্মতলা নামিয়ে দিলো। আমরা নিউ মার্কেটের ভেতর দিয়ে আমাদের হোটেলে চলে এলাম। হোটেলে আসার আগে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম।
বোলপুর থেকে শিয়ালদহ আসার পথে অজয় নদী পড়ে। আমাদের একজন ব্লগার এই অজয় নদী নিয়েই অনেক কবিতা লিখেছেন।
আর একদিন আমরা কোলকাতায় আছি।
অথচ কিছুই দেখা হয়নি। তাই পরের দিন সকালে একটা ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে নিলাম ষোল শ' টাকা দিয়ে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের সারাদিন নানান জায়গা ঘুরে দেখাবেন। ড্রাইভার সাহেব লোক ভালো। খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলেন। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার একটি স্মৃতিসৌধ। দারুন সুন্দর জায়গা। খুব সুন্দর সাজানো গুছানো। বাগানে ঘুরে বেড়ালে বিশ টাকা টিকিট। আর দালানের ভিতরে প্রবেশ করলে ত্রিশ টাকা। অবশ্য বাংলাদেশের লোকদের জন্য একশ' টাকা টিকিট। বাগানে বেশ কিছু ছেলে মেয়ে প্রেম করছে। তারা বেশ জড়াজড়ি করে বসা। আমি সুরভিকে বললাম, আমরা কি এইভাবে প্রেমট্রেম করেছি? সুরভি বলল না। আমি বললাম, দেখেছো আমি কত ভদ্র।
যাই হোক, এর মধ্যে আমাদের ড্রাইভার বেশ কয়েকবার ফোণ দিলো। কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা জানার জন্য। এরপর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেল কলেজ স্ট্রীট। সেখানে প্রচুর বইয়ের দোকান। রাস্তার ওপারেই প্রেসিডেন্সী কলেজ। কলেজ স্ট্রীট এলাকাটি আমাদের বাংলাবাজার বা নীলক্ষেত এলাকার মতোন। তবে ওদের থেকে আমাদের বাংলা বাজার বা নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানের সংখ্যা বেশিই হবে। এখানেই বিখ্যাত কফি হাউজ। সেখানে গেলাম। কোনো টেবিল খালি নেই। প্রচুর লোক। সব বয়সী লোকই আছে। আমরা চা-কফি, স্যান্ডউইচ খেলাম। সুরভি একটা কোল্ড কফিও খেলো। সব কিছুর দাম সস্তাই বলা চলে। মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কোনো রকম সংকোচ বা দ্বিধা দেখলাম না তাদের মধ্যে। সুরভির কফি হাউজ খুব ভালো লাগলো।
কোলকাতার মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করে না।
সবচেয়ে বড় কথা তাদের দিকে কেউ কুৎসিত ভাবে তাকাচ্ছে না। আমাদের দেশে একটা মেয়ে হেঁটে গেলে ছেলে বুড়ো সবাই কুৎসিত ভাবে তাকায়। কোলকাতায় যে মেয়েরা শাড়ি পড়ছে। পেটের কিছু অংশ বের হয়ে আছে। সেই উন্মুক্ত স্থান নিয়ে তাদের কোনো সংকোচ নেই। বাংলাদেশে কোনো মেয়ে শাড়ি পড়লে পেট যেন দেখা না যায় তার জন্য আপ্রান চেষ্টা চালায়। ওদের সেই ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই।
কফি হাউজ থেকে গেলাম, রাজার বাড়ি, মার্বেল প্যালেস। বিশাল রাজকীয় বাড়ি। দারুন সব মূর্তি আছে। যা দেখলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। ভিতরে প্রবেশের কোনো টিকিট লাগে না। কিন্তু বাড়ি রক্ষনাবেক্ষকদের পঞ্চাশ-এক'শ টাকা দিতে হয়। এক শ' টাকা কোনো ঘটনা না। কিন্তু বাড়িটি দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন'ই। ১৮৩৫ সালে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। বাড়ির ভিতরে দূর্দান্ত অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। এই মার্বেল প্যালেস কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি । রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের উত্তরাধিকারীরা এখনো এই প্রাসাদে বাস করছেন। তারা নাকি এখনও প্রতিদিন পাঁচ শ' দরিদ্র লোককে ফ্রি খাবার খাওয়ান।
যাই হোক, মার্বেল প্যালেস থেকে একটু সামনে এগুলেই রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। জোড়া সাঁকোর অপর নাম রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এখানে এখন রবীন্দ্রনাথের সেই আমেজ নেই। বড় কৃত্রিম করে ফেলেছে। প্রতিটা ঘরে এসি লাগিয়েছে, দেয়াল গুলোতে নানান রকম রঙ লাগিয়ে আধুনিক করে ফেলেছে। এই বাড়িতেই কবি তার শৈশবকাল কাটান এবং ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে মারা যান। মোট ৪টি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। জোড়াসাঁকোতে প্রবেশ করতে বিশ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। এবং ছবি তোলার জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হয়।
হাওড়া ব্রিজটা বেশ ভালো লেগেছে।
অদ্ভুত একটা ব্রীজ। আড়াই শ' বছর পার হয়ে গেছে। এখনও কোনো ক্ষতি হয়নি। এটা নির্মান করতে ৭ বছর সময় লেগেছিল। এখনও কি সুন্দর। যাই হোক, জোড়াসাঁকো থেকে গেলাম একটা জায়গায়। জায়গার নামটা এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। বেশ সাজানো গুছানো। নদীর পার খুব সুন্দর করে বাধাই করা। আমাদের ড্রাইভার বললেন, এখানে অনেক নাটক সিনেমার শূটিং হয়। নদীর উপরে খুব সুন্দর একটা ব্রীজ আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। বেশি আসে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা। তারা প্রেম করে। এখানে বেশ কিছু ফোটোগ্রাফার আসে। আপনি চাইলে তারা আপনার ছবি তুলে দিবে। ছেলে গুলো ভালো ছবি তোলে। অনেকটা সময় এখানে ছিলাম। বেশ ভালো লেগেছে। এখানকার একটা দোকান থেকে চা নাস্তা খেয়ে নিলাম। এখান থেকে কিছু দূর গেলেই ইডেন গার্ডেন। সেখানে যাই নি। বাংলাদেশের টেস্ট খেলা চলছি। যাই হোক, ফিরতে ফিরতে আমাদের বিকাল প্রায় শেষ হয়ে গেল। আগামীকাল সকাল ১১ টায় আমাদের ঢাকা যাওয়ার বাস ছাড়বে মির্জা গালিব স্ট্রীট থেকে। গত দিন দিনে এত জায়গায় যাই নি। আজ একদিনে যত জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি।
এই জায়গাটার নামই আমি মনে করতে পারছি না। পদাতিক দাদা হয়তো বলতে পারবেন। এখানে থাকা অবস্থায়ও দাদা আমাকে ফোন করেছিলেন।
(কোলকাতা ভ্রমন এখানেই শেষ করে দিলাম। লিখলে আরো লেখা যায়।)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:২৫