সময়টা তখন ১৯৬২ সাল।
বিক্রমপুর অঞ্চলের কামারগাও গ্রামের ঘটনা। গ্রামে এক লোকের নাম বসির উল্লাহ। পাগল শ্রেনীর মানুষ। তার মুখের কোনো লাগাম নেই। গ্রামের সম্মানিত লোককেও যা খুশি বলে দেয়। মুখে কোনো লাগাম নেই। একলোক বাজারে যাচ্ছিলো। তখন বসির উল্লাহ বলল, কিরে এমন তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছিস। লোকটা বলল, পাগলের কথার জবাব আমি দেই না। তখন বসির উল্লাহ বলল, বাজার থেকে ফেরার সময় তুই হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবি নারে। কারো কাঁধে করে ফিরতে হবে। বসির উদ্দিনের কথা ফলে গেলো। বাজারে ঢুকতেই লোকটাকে এক পাগলা গরু এমন ধাক্কা দিলো, সাথে সাথে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান। দুইজন লোক ধরাধরি করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিলো।
চৌধুরী সাহেব তার জমির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
এবার ফসল খুব ভালো হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে চৌধুরী সাহেব তার জমির দিকে তাকিয়ে আছেন। বসির উদ্দিন হেঁটে যাচ্ছিলো। চৌধুরী সাহেবকে দেখে, সে থামলো। বলল, এমনভাবে ফসলের দিকে তাকিয়ে লাভ নাই। এই ফসল আপনি ঘরে তুলতে পারবেন। চৌধুরী বললেন, হারামজাদা যা ভাগ এখান থেকে। পন্ডিত এসেছে। তোকে আমি গ্রাম ছাড়া করবো- এই আমি বলে রাখলাম।। সেই রাতেই ব্যাপক ঝড় হলো। বৃষ্টি হলো। পানিতে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে গেলো। বসির উদ্দিনের কথা ফলে যায়। এখন গ্রামের মানুষ বসির উদ্দিনকে অবহেলা করে না। তাকে সমাদর করে। খাতির করে।
বসির উদ্দিন শ্রীনগর পোষ্ট অফিসের সামনে বসে আছে।
নতুন পোষ্ট মাস্টার জয়েন করেছেন। সে বলল, কিরে ছাগলা এখানে বসে আছিস যে বড়। আমার পোষ্ট অফিসে কোনো পাগলের জায়গা হবে না। বসির বলল, হুজুর আমি পাগল নই। আর এটা গভমেন্টের জায়গা। এখানে যে কেউ আসতে পারেই। পোষ্ট মাস্টার রেগে বলল, হারামির পুত দেখি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কয়। বসির বলল, মাস্টার সাহেব আপনার এখানে আর কাজ করা হবে না। আপনার ট্রন্সাফার হয়ে যাবে। আগামীকাল আপনাকে নাইক্ষং ছড়ি চলিয়া যাইতে হবে। পোষ্ট মাস্টার বলল, আমি যেন তোকে আর এখানে না দেখি। দেখলে হাড় ভেঙ্গে দিবো। ফাজিলের ফাজিল। সত্যি সত্যি পোষ্ট মাস্টারের পোস্টিং হলো খাগড়াছড়ি।
লতিফার বাবা একজন কৃষক।
নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করেন। লতিফার বয়স সতের। সে মনে মনে বসির কে পছন্দ করে। একদিন লতিফা সাহস করে বলেই ফেলল, আমাকে বিয়ে করো। তাতে তোমার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। বসির বলল, আমার চাল চুলা নেই। থাকার জায়গা নেই। লতিফা বলল, সব হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি বসির লতিফা কে বিয়ে করলো। এবং দেখা গেলো বিয়ের পর সে তিন বিঘা জমির মালিক হয়ে গেলো। গ্রামের স্কুল শিক্ষক নারায়ন কর্মকার কলিকাতা চলে যাবার আগে তার জমি বসিরকে দিয়ে যায়। বসির অনেক পরিশ্রম করতে পারে। সে জমিতে সারাদিন খাটে। সাথে লতিফাও খাটে। দারুন ফসল হয়। বসিরের জীবন বদলে গেলো।
সেই সময় গ্রাম দেশে চাপকল ছিলো না।
একমাত্র ভরসা নদী, পুকুর আর কুয়োর পানি। নদী অনেক দূরে। কুয়োর পানি ছিলো একদম স্বচ্ছ। অতি মিষ্ট স্বাদ। গ্রামের সবাই এই কুয়ার পানি খায়। কথিত আছে, এই কুয়োর পানি খেলে যেকোনো রোগ ভালো হয়ে যায়। গ্রামের লোকজন অসুস্থ হয় না- কারন তাঁরা এই কুয়োর পানি পান করে। আশেপাশের কেউ অসুস্থ হলে- এই কুয়ো থেকে পানি নিয়ে যেতো। একদিন কুয়োতে সমস্যা দেখা দিলো। পানি তুলতে গেলে, বালতি কুয়োয় পড়ে যায়। শুধু দড়ি উঠে আসে। অথচ কুয়োয় পানি আছে। সবাই বসির উল্লাহ কে বলল, ভাই কি সমস্যা? পানি না খেয়ে মরতে হবে নাকি আমাদের? সবাই অনুরোধ করলো- বসির তুমি কুয়োতে নামো। দেখ ঘটনা কি? এদিকে লতিফা সাত মাসের গর্ভবতী।
বসিরের ধারনা কুয়োয় নামলে সে আর উপরে উঠতে পারবে না।
এই কুয়ো তাকে শেষ করে দিবে। অথচ গ্রামের লোকজন তাকে ধরেছে। তার স্ত্রীর বাচ্চা হবে। গর্ভবতী অবস্থায় এই কুয়োর পানি খেলে বাচ্চা প্রসবকালে কোনো ব্যথা হয় না। লতিফাকে এই পানি খাওয়াতে হবে। খান সাহেবকে বসির বলল, দাদা মনে হয় আমি কুয়োতে নামলে আর বেঁচে ফিরতে পারবো না। যদি না ফিরি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে আপনি দেখবেন। এই খান সাহেব হচ্ছেন আমার দাদা। যার ভালো নাম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। যাইহোক, বসির স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুয়োতে নামলো। কুয়ো থেকে সে আর ফিরে আসেনি।