কত যে রোগ-ব্যাধি এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে আফ্রিকায় তার হিসেব কে রাখে । খোদ মার্কিন মুল্লুকের ডাক্তাররাই স্বীকার করেন আফ্রিকার সব রোগ-ব্যাধি এখনো আবিস্কৃত হয়নি । সামান্য জ্বর হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে । আসলে এটা কি জ্বর ? না-অন্য কিছু ? এর উত্তর কোনো ডাক্তার দিতে পারেন না । আবার অনেক রোগ আছে, আবিস্কৃত হয়েছে কিন্তু চিকিৎসা নেই । আবার অনেক রোগের চিকিৎসা আছে কিন্তু সচেতনতা নেই বলে রোগি জানেই না কার কাছে যেতে হবে, কী চিকিৎসা করাতে হবে । তো আজকের এই পোস্টে আফ্রিকার জানা-অজানা কয়েকটি রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে আমরা জানব ।
হলুদ জ্বর
বিগত ২০০৭ এ আইভরিকোস্টে বছরের মাঝামাঝি সময়টাতে হলুদ জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয় । কয়েকদিনের মাঝেই বেশ কিছু মানুষ মারা যায় এই হলুদ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে । হলুদ জ্বর একটি ভয়ানক ব্যাধি , এর চিকিৎসা আছে ঠিকই কিন্তু চিকিৎসা স্বত্বেও মৃত্যুহার খুব বেশি । তবে সুখের কথা হলো এই রোগের প্রতিষেধক টিকা আছে । হলুদ জ্বর দুই রকমের । একটি জঙ্গলের হলুদ জ্বর আর অন্যটি হলো শহুরে হলুদ জ্বর । দুই ধরনের হলুদ জ্বরই ইনফেক্টেড মশা দ্বারা ছড়ায় । জঙ্গলের হলুদ জ্বর সাধারণত বানরের হয় । বানর থেকে মশার মাধ্যমে এটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । যে মশা শহুরে হলুদ জ্বরটা ছড়ায় তার নাম হলো- এইডেস এইজিপ্টি । এ জাতীয় মশা গাড়ির ফেলে দেওয়া চাকা, ফুলদানী, তেলের ড্রাম কিংবা পানির ট্যাঙ্কিতে বংশবিস্তার করে । এখন পর্যন্ত আফ্রিকা ও দক্ষিন আমেরিকা ছাড়া হলুদ জ্বর পৃথিবীর আর অন্য কোথাও দেখা যায় নি । হলুদ জ্বর দেখা দিলে মাথা ধরে, মেরুদণ্ডে ব্যাথা হয়, মাংসপেশিতে ব্যাথা হয়, বমির ভাব হয় এবং অতিরিক্ত জ্বর হয় । রোগী জ্বরের প্রকোপে শীতে থরথর করে কাঁপতে থাকে । কিছুদিন রোগে ভোগার পরে একটু ধাতস্থ হয়ে এলে হলুদ জ্বরের ভাইরাস আক্রমন করে কিডনীতে এবং কলিজায় । এর ফলে লিভার ফাংশন খারাপ হয়ে যায় । সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে হলুদ হতে শুরু করে, প্রসাব হলুদ হয়ে যায় । ইনফেক্টেড মশা কামড়ানোর তিন থেকে ছয়দিনের মধ্যেই এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে । তো এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রতিষেধক টিকা ।
লাসা জ্বর
আরকটি আসুখের নাম লাসা জ্বর । এই জ্বরের প্রকোপ নাইজেরিয়াতে বেশি । তবে আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও লাসা জ্বর দেখা যায় । সাধারণত ইঁদুরের খাওয়া খাবার খেলে অথবা ইঁদুর কোনো খাবারের ওপর হেঁটে গেলে এবং সেই খাবার খেলে এই জ্বর হয় । লাসা জ্বরের কোনো চিকিৎসা নেই বলে শুনেছি । এই জ্বর হলে মানুষ মারা যাবেই । এবং সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, লাসা জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হলে সেই লাশ আন্তর্জাতিক কোনো এয়ারলাইন্স বহন করে না । লাসা জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে ২৫ ফুট মাটির নিচে মৃত্যু হওয়া মাত্র পুঁতে দিতে হয় । নইলে মরদেহ থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের শরীরে । লাসা জ্বরে আক্রান্ত রোগী সর্বোচ্চ সাতদিন বাঁচে । এই রোগ শরীরের টিস্যুগুলি খেয়ে ফেলে ।
বিষাক্ত মাছি
আইভরিকোস্টের জঙ্গলে একধরনের মাছি আছে । এই মাছি বংশবিস্তার করে মানবদেহে । শুনে নিশ্চয়ই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে । রোদে যখন আমরা কাপড় শুকাতে দিই তখন এই মাছি কাপড়ের উপর বসে মনের সুখে ডিম পাড়ে । আমরা কাপর রোদ থেকে এনে যদি ভালোমতো ইস্ত্রি না করে পরে ফেলি তাহলে সেই ডিমগুলি কাপড় থেকে আস্তে আস্তে রোমকূপের ভেতরে চলে যাবে এবং ঠিক এর দুই থেকে তিন দিন পর চামড়ায় জ্বালা-পোড়া অনুভূত হবে এবং একধরনের ফোঁড়া চামড়ায় দেখা যাবে । সেই ফোঁড়া ক্রমেই বিদঘুটে রূপ নেবে তার সঙ্গে অসহ্য ব্যাথ্যা তো আছেই । এভাবে এক সপ্তাহ পর হঠাৎ সেই ফোঁড়া ফেটে একটা মাছি বের হয়ে আপনাকে বোকা বানিয়ে উড়ে চলে যাবে । কি ভয়াবহ ব্যাপার , তাই না ?
কাসাভা রোগ
আফ্রিকানদের দুটি প্রধান খাবারের মধ্যে অন্যতম একটি হল কাসাভা । পেস্তা আলুর মতো একধরণের শেকড় এই কাসাভা । কাসাভা দিয়ে তৈরি হয় নানান রকমের সুস্বাদু খাবার । এই কাসাভা থেকে একবার ছড়িয়ে পড়লো এক ধরনের মোজাইক ভাইরাস । এই রোগের নাম হয়ে গেল কাসাভা রোগ । ১৯৯০ সালে পূর্ব আফ্রিকার আড়াই কোটি মানুষ আক্রান্ত হল এই কাসাভা রোগে । তবে সুখের কথা হলো কাসাভা রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার তেমন বেশী না ।
এবোলা জ্বর
এবোলা জ্বরের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি । এটা একটা ঘাতক ব্যাধি । এবোলা জ্বর নিয়ে আমেরিকানরা ছবিও বানিয়েছে । সাধারণত এই জ্বর বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জী এবং মানুষের হয় । অর্থাৎ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীরই এই এবোলা জ্বর হওয়ার আশংকা থাকে । কঙ্গোর একটি নদীর নামে এই রোগটির নাম রাখা হয় এবোলা । কারন কঙ্গোর এবোলা নদীর পাড়েই এই রোগ ১৯৭৬ সালে প্রথম সনাক্ত করা হয় । চার ধরনের এবোলা ভাইরাস আছে । এর মধ্যে তিনটি মানব দেহে আক্রমন করে । এই তিনটি হচ্ছে; এবোলা জায়ের, এবোলা সুদান এবং এবোলা আইভরিকোস্ট । চতুর্থটি- এবোলা বোস্টন মানুষ ছাড়া অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রানীকে আক্রমন করে । এবোলা ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষন চোখে দেখা দিতে শুরু করে । এবোলা জ্বরের প্রাথমিক লক্ষনগুলো হচ্ছে ঘুসঘুসে জ্বর, মাথাব্যাথা, গিরায় ও জয়েন্টে ব্যাথা, মাংসপেশিতে চাবানি-কামড়ানি, গলায় প্রদাহ এবং দুর্বলতা । কিছুদিনের মধ্যাই পেটে ব্যাথা, বমির ভাব এবং ডাইরিয়া দেখা দেয় । কোন কোন ক্ষেত্রে শরীরে রাশ ওঠে, চোখ লাল হয়ে যায়, রোগী হিক্কা তুলতে থাকে এবং শরীরের বাইরে এবং অভ্যন্তরে রক্তপাত হয় । এবোলা এইচএফ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী মারা যায় । তবে দু’একজন এমনিতেই ভাল হয়ে যায় । চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনো আবিস্কার করতে পারেননি কেন কেউ কেউ ভাল হয়ে যায় আর বেশীরভাগ রোগী মারা যায় । আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যা যারা ভালো হয়ে যায় তাদের শরীরে এবোলা এইচএইফের সাথে যুদ্ধ করার মতো ন্যাচারাল প্রতিষেধক রয়েছে । এবলা জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে শুধুমাত্র রোগের লক্ষণের ওপর চিকিৎসা করা হয় । যেমন প্রেসার কমে যায়, তখন প্রেসার বাড়ানোর ওষুধ, যখন পাতলা পায়খানা বন্ধের অষুধ দেওয়া হয় ।
ম্যালিরিয়া
এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঘাতকের নাম হলো ম্যালিরিয়া । প্রতি বছর ৩০ থেকে ৫০ কোটি শিশু ম্যালিরিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার ১ কোটি মারা যায় । এই হতভাগ্য শিশুদের সিংহভাগই আফ্রিকার শিশু । এই রোগটিও ছড়ায় আক্রান্ত মশার দ্বারা । আইভরিকোস্টের পৌনে দুই কোটি মানুষের এমন একজনও নেই যার জীবনে একবার ম্যালেরিয়া হয়নি । ম্যালিরিয়া এখন আফ্রিকানদের কাছে ডাল-ভাত । আবশ্য বেশিরভাগ আফ্রিকান এখনো মৃত্যুকেই পরোয়া করে না । আফ্রিকার যেসব দেশ গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে, সেসব দেশের ৫ বছর বয়সী শিশুর হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছে বাবা-মা । অস্ত্র ঠিক মতো করে কি-না এইটা পরিক্ষা করার জন্য ওরা হয়ত একজন পথচারীকেই গুলি করে দিল । যদি লোকটা মারা যায় তাহলে হত্যাকারী আনন্দে দাঁত বের করে হাসে ।
এইডস
আরেক নীরব ঘাতকের নাম এইডস । গড়ে আফ্রিকার ২০ শতাংশ মানুষ এইচাইভি ভাইরাস বহন করছে । কোনো দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এই ঘাতক ভাইরাসে আক্রান্ত । আইভরিকোস্টের ৪৬ শতাংশ মানুষ এইচাইভি ভাইরাস বহন করছে । আরো যে কতো অজানা রোগে ছেয়ে আছে আফ্রিকা কে জানে । সেখানকার লোকজনরা ভিনদেশী মানুষদেরকে দেখলে প্রায়শই এই উপদেশটি দিয়ে থাকে যে ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে যে সন্ত্রাসীর মতো রোদ ওঠে এই রোদে কখনো হাঁটবে না , তখন আকাশ থেকে ঝরে পড়ে হাজারো রোগ-ব্যাধি । তারপরেও যখন ভিনদেশের মানুষেরা গাড়ি চালিয়ে কতযায়গায় যায় কত নয়নাভিরাম দৃশ্যই না তারা উপভোগ করে । সবুজের এতো প্রাচুর্য, এতো বৈচিত্র পৃথিবীর আর কোথায় আছে । এখানে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ । সবুজের ওপর সবুজ, তার ওপরে সবুজ আর তার ওপরে সুনীল আকাশ । আর এজন্যই বোধ হয় এতো রোগ-বালাইকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন সৌন্দর্যপিপাসু হাজার হাজার মানুষ পাড়ি জমায় আফ্রিকায় ।