সুলতানার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মাধ্যমে সুলতানাদের বার্তা পাঠালেন যে এখন থেকে তিনি তাদের ভিলাতে নিয়মিত আসবেন না। এক মাসের মধ্যেই ভাই আলীর মাধ্যমে সুলতানা ও তার বোনেরা জানতে পারলো যে তার বাবা পুনরায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার নাম রান্দা, বয়স ১৫ বছর যে ছিল সুলতানার চেয়ে ১ বছরের বড়। সে রাজপরিবারেরই মেয়ে এবং তার বাবার গোত্রীয় বোন। সুলতানা ছোটবেলায় এই মেয়ের সাথে একত্রে খেলাধুলা করেছে। অবশেষে সুলতানার মায়ের মৃত্যুর ৪ মাস পর সুলতানা তার বাবার বিয়ে খেলো। বিয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত রান্দার প্রতি তার প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল। কিন্তু বাসর ঘরে নেয়ার মুহূর্তে রান্দার ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা দেখে সে বুঝতে পারলো যে সৌদি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রান্দাও তাদের মত অসহায় একটি মেয়ে। রান্দার প্রতি তার মনে সহানুভূতি জেগে উঠলো। সৌদি আরবে বিত্তশালী পরিবারের পুরুষ ও গরীব বেদুঈন পুরুষরা একাধিক বিয়েতে বেশী উৎসাহী। কারণ বিত্তশালীদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে আর বেদুঈনদের জীবন সাধাসিধা হওয়াতে নতুন স্ত্রীর জন্য তাবু আর সামান্য খরচাপাতি করার সামর্থ্য থাকলেই চলে।
তার বাবা নতুন স্ত্রীকে নিয়ে প্যারিস ও মনটিকারলো ঘুরতে গেলো দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করার জন্য। সুলতানা রান্দার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল এবং তাকে নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে বলে মনস্থির করলো। তার মাকে এত সহজে ভুলে যাওয়ার জন্য সুলতানা তার বাবার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিল। তাই সে চাচ্ছিল রান্দার মনে নারী স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তুলতে যেন রান্দা তার স্বামীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। রান্দা ছিল ভীষণ লাজুক ও ভীতু প্রকৃতির। আর সুলতানা ছিল তার বিপরীত। রান্দার সাথে তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হচ্ছিল। রান্দার ভয় ভাঙ্গানোর জন্য সে একটা বুদ্ধি আঁটল। সুলতানার দুইজন বান্ধবী ছিল যারা ছিল তার চেয়েও বেশী সাহসী। ওদের নাম ছিল নাদিয়া আর ওয়াফা। ওরা রাজপরিবারের না হলেও সৌদি আরবের বিশিষ্ট পরিবারের ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে সুলতানা তার এই দুই বান্ধবী আর রান্দাকে নিয়ে একটা ক্লাব গঠন করলো। ক্লাবের নাম দিল ‘প্রাণচঞ্চল ঠোট’। ক্লাবের মূলমন্ত্র ছিল;
(১) নারী অধিকারে বলিয়ান হয়ে সুযোগ পেলেই তারা মুখ খুলবে।
(২) প্রত্যেকে প্রতি মাসে অন্তত ১ জন করে নতুন সদস্য জোগাড় করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
(৩) তাদের প্রথম লক্ষ্য হবে বৃদ্ধদের সাথে কম বয়সী মেয়ের বিয়ে বন্ধ করা।
সুলতানার বান্ধবী নাদিয়ার বয়স ছিল ১৭ বছর। তার বাবা ছিল একজন বড় ঠিকাদার। সে রাজপরিবারের সদস্যদের ঘুষ দিয়ে বড় বড় সরকারী কাজ হাতিয়ে নিত। নাদিয়াকে তার পরিবার ২১ বছর বয়সে বিয়ে দেবে। তাই সে চাইত এই সময়ের মধ্যে জীবনটাকে উপভোগ করে নিতে। সুলতানার আরেক বান্ধবী ওয়াফার বাবা ছিল একজন শীর্ষ মুতাওয়া ( ধর্মীয় বিষয় দেখার জন্য পুলিশের মত বাহিনী)। তার মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। ওয়াফাকে ৭ বছর বয়স থেকেই বোরকা পরতে হয়েছে।
বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হওয়ার কারণে সুলতানাকে এখন থেকে বোরকা, হিজাব ও নিকাব পরতে হবে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময়। জীবনের প্রথম বোরকা, হিজাব ও নিকাব কেনার জন্য এই চার বান্ধবী ( সৎ মা রান্দাও অন্তর্ভুক্ত) মার্কেটে গেলো একদিন। তাদের কেনা কাটা শেষে নাদিয়া আর ওয়াফা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিল। সুলতানা আর রান্দা হাসার কারণ জিজ্ঞেস করলো। ওরা বলল যে ওরা একটা লোকের কথা মনে করে হাসছে যার সাথে কয়েকদিন আগে ওদের এই জায়গাতে দেখা হয়েছে। সুলতানা আর রান্দা শুনে বিস্মিত হোল। রোদের কারণে ওরা আবার মার্কেটের দিকে গেলো। তখন নাদিয়া আর ওয়াফা সুলতানাকে বলল যে তারা একটা মজার খেলার কথা ভাবছে। চাইলে সুলতানা আর রান্দাও এতে শরিক হতে পারে। রান্দা প্রথমে রাজি না হলেও সুলতানার চাপাচাপিতে সেও রাজি হোল।
নাদিয়া আর ওয়াফা ওদের নিয়ে একটা বিল্ডিঙের নীচের পারকিং এর লিফটের কাছে আসলো। হঠাৎ নাদিয়া ও ওয়াফা সেখানে দাড়িয়ে থাকা একটা হ্যান্ডসাম সিরিয়ান লোককে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি একটু মজা করতে চান? ঘটনার আকস্মিকতায় মনে হোল লোকটা দৌড়ে পালাবে। লোকটা ডানে, বামে তাকিয়ে লিফটের বোতাম টিপ দিল। পর মুহূর্তে কি ভেবে সে জিজ্ঞেস করলো কি ধরণের মজা? ওয়াফা জিজ্ঞেস করলো তার গাড়ি আছে কি না এবং সে প্রাইভেট এপার্টমেন্টে থাকে কি না। সে হ্যাঁ বলল এবং বলল যে তার সাথে একজন লেবানিজ রুম মেট থাকে। নাদিয়া জিজ্ঞেস করলো তার রুম মেটের মেয়ে বন্ধু প্রয়োজন কি না। লোকটি বলল যে তাদের দুইজনেরই মেয়ে বন্ধু প্রয়োজন। রান্দা আর সুলতানা ওদের কাজ কর্ম দেখে হতভম্ব হয়ে পরেছিল। একটু সম্বিৎ ফিরতেই ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি চিন্তা করে ওরা বোরকা হাত দিয়ে পায়ের কাছে গুটিয়ে নিয়ে ঐ জায়গা ত্যাগ করার জন্য দৌড় শুরু করলো। আতঙ্কের কারণে এক পর্যায়ে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লেগে উভয়েই মাটিতে পরে গেলো। কিছুক্ষন পর নাদিয়া আর ওয়াফা ওদের কাছে আসল এবং ওদের দৌড়ের ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। সুলতানা আর রান্দা ওদের অনেক বকাবকি করলো কিন্তু ওরা এগুলি হেসে উড়িয়ে দিল। ওদের কথা হোল যে, বিয়ের পরে এমনিতেও তাদের কঠিন ও নির্মম জীবনে প্রবেশ করতে হবে তাই তারা এই ধরণের ঝুঁকি নিয়ে একটু আনন্দ করতে চায়। যদি ভাগ্য ভালো থাকে এভাবে একজন বিদেশী লোক তারা জীবন সঙ্গী হিসাবে খুঁজে পেতে পারে। কারণ সৌদি পুরুষের চেয়ে যে কোনো লোক উত্তম।
পরে সুলতানা তার বান্ধবীদের কাছে তাদের মজা সম্পর্কে বিস্তারিত জানলো। এই কাজ তারা আগেও করেছে। তারা এইভাবে বিদেশী (বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অন্য আরব দেশের ) ছেলেদের এপার্টমেন্টে যায় ও মজা করে। তবে ওদের দাবি সব কাপড় খুললেও নিকাব কখনও খুলতো না এবং যৌন মিলন করতো না। প্রথমে তারা লিফটের কাছে কথা বলতো। অনেকে ভয়ে পালাত আবার অনেকে ডেটিং টাইম দিত। তারা ছেলেটিকে পিকআপ জোগাড় করতে বলতো। কারণ প্রাইভেট কারে অপরিচিত ছেলে-মেয়ে এক সাথে দেখলে মুতাওয়ারা রাস্তায় ধরে। নির্দিষ্ট দিনে ওরা শপিঙের নাম করে বাইরে বের হতো এবং পিকআপের পিছনে গোপনে উঠে পড়তো।
এই কাজ ওরা চালিয়ে যাচ্ছিল। সুলতানা ওদের অনেক বার এই কাজ করতে নিষেধ করেছে কিন্তু ওরা শোনে নাই। ওরা আরও একটা পদ্ধতির কথা বলে। ওরা অপরিচিত ফোন নাম্বারে কল করে। যখন কোনও বিদেশী পায় তখন তার সাথে ভাব জমায়। লোকটাকে তার দেহের বর্ণনা দিতে বলে এবং তারাও তাদের দেহের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। এরপর উভয় পক্ষের সম্মতিতে পিকআপে চড়ে ডেটিং এ যায় এবং মজা করে। রান্দা আর সুলতানা বান্ধবীদের এই সব বিষয় নিয়ে আলাপ করার সময় ভয়ে কেঁদে ফেলত।
বছরখানেকের মধ্যে নাদিয়া আর ওয়াফা এই ধরণের ঘটনার কারণে ‘গণ নৈতিকতা কমিটি’ র এক সদস্যের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার হোল। পিকআপে ওঠার সময় ওদের হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। আগে থাকতেই গোপন তথ্য মুতাওয়াদের কাছে ছিল। এক সপ্তাহ ধরে ওরা এলাকাটার উপর নজর রাখছিল। কিছুদিন আগে ঐ কমিটির একজন সদস্য আকস্মিকভাবে তার কাছে দাড়িয়ে থাকা এক প্যালেস্টাইনের সাথে দুইজন মহিলার গোপন প্রস্তাবের কথা সে শুনে ফেলে।
নাদিয়া আর ওয়াফাকে ৩ মাসের জেল দেয়া হয় কারণ তাদের হাইমেন অক্ষত পাওয়া গিয়েছিল বলে। তদন্তে পাওয়া যায় যে ১৪ জন লোককে ওরা প্রস্তাব করেছিল। ১৪ জনের কেউই স্বীকার করেনি যে তারা এই কাজে অংশ নিয়েছিলো। ৩ মাস পরে নাদিয়া আর ওয়াফাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
ওয়াফার মুতাওয়া বাবা তাকে এই কাজের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে যে পরবর্তী জীবনের বন্দি দশা ও হতাশার কারণে সে এই কাজ করেছে। তার বাবা মেয়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। কিন্তু মেয়েকে সে বিয়ে দিয়ে দেয়। পাত্র গ্রামের একজন মুতাওয়া যার বয়স ৫৩ বছর। ওয়াফার বয়স ১৭ বছর এবং সে হবে ঐ লোকের তৃতীয় স্ত্রী।
নাদিয়ার বাবার শাস্তিটা ছিল ভয়ংকর রকমের অমানবিক। সে মেয়ের সাথে কথা বলতে রাজি হোল না এবং তাকে একটা ঘরে আটকে রাখলো যতক্ষণ না চরম সিদ্ধান্ত নেয়া হোল। কয়েকদিন পরে সুলতানার বাবা তার স্ত্রী রান্দা ও সুলতানাকে ডাকলো। তিনি জানালেন যে নাদিয়াকে পরের দিন সকাল ১০ টায় পরিবারের সব সদস্যের উপস্থিতিতে পরিবারের সুইমিং পুলে ডুবিয়ে হত্যা করা হবে। তিনি রান্দা ও সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন তারাও নাদিয়ার কাজে যুক্ত ছিল কি না। সুলতানা দাড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলো কিন্তু তার বাবা তাকে জোড় করে বসিয়ে দিলেন। রান্দা কাঁদতে কাঁদতে সেই দিনের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করলো। সুলতানার বাবা তাদের ৪ জনের ক্লাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। নাদিয়া এই ক্লাবের কথা মুতাওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বলেছিল। রান্দা আর সুলতানা যখন ওনার প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকলো তখন তিনি তার ব্যাগ থেকে ক্লাবের কাগজ বের করে ওদের দেখালেন। তথ্য পেয়ে এগুলি তিনি সুলতানার রুম থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
কাগজ রেখে উনি রান্দাকে বললেন “এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে তালাক দিলাম। তোমার বাবা এক ঘণ্টার মধ্যে তোমার জন্য গাড়ি পাঠাবে। আর তুমি আমার কোনও ছেলে-মেয়ের সাথে কখনও যোগাযোগ করবে না।“ সুলতানাকে বললেন “তুমি আমার মেয়ে। তোমার মা একজন ভালো মহিলা ছিলেন। তারপরও, যদি তুমি এই কাজে জড়িত থাকতে তাহলে আমি তোমাকেও কোরআনের নিয়ম মেনে কবরে পাঠাতাম। তুমি আমার সামনে আসবে না এবং লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করবে যতক্ষণ না আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করি।“ উনি চলে গেলেন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রান্দা তার ব্যাগ নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে চিরতরে চলে গেল।
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনীর সারসংক্ষেপ।
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব- ১)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব- ২)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্বে- ৩)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব- ৪)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব- ৫)
ছবি – ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:৩৫