নীলা... এই নীলা? তোর জামাই তো দেখি কিছুই পারে না রে। বিকালে জনি একটা অংক পারতেছিল না। জামাইরে কইলাম, বাবা তুমি যদি জনিরে অংকটা দেখাই দিতা তাইলে জনির একটু ভাল হইত? জামাই সেই অংক নিয়া দুই ঘণ্টা বইসা আছিল কিন্তু উত্তর মিলাইতে পারে নাই। সে যে বিএ পাশ বইলা তোরে বিয়া করছে, আসলে কি বিএ পাশ করছে?
নীলা কিছুই বলে না। মায়ের তীব্র আক্রমণাত্মক কথা তার দাঁতে দাঁত দিয়ে কিড়মিড় করে চেপে যাচ্ছে।
মাঃ আজকে বাসায় আসলে তোর জমাইরে জিজ্ঞেস করবি। সে কি আসলে পড়ালেখা কিছু করছে নাকি আমারে ভুংভাং বইলা তোরে বিয়া কইরা, ঘর জামাই হইয়া আমার অন্ন নষ্ট করতেছে। ক্লাস ফাইভের একটা অংক পারে না, বিএ পাশ করলো ক্যামনে?
নীলাঃ আমি কি জানি? আমি কি বিয়ের আগে তার সাথে প্রেম করছি? নাকি সে আমার ক্লাসমেট ছিল? তোমরা দেখছ, তোমরা জানো। আমার এতো কিছু দেখনের টাইম নাই। ঘরের জামাই ঠিকমত ঘরে আইসা পড়লে হইছে।
মাঃ গেছে কই হে এখন? আজকে বাসায় আইলে জিগাইবি? পাশ ফেইলের ব্যাপারটা।
নীলাঃ তারাবীর নামাজ পড়তে গেছে মসজিদে। আমি জিগাইতে পারুম না। তুমি জিগাইও।
মাঃ জিগাইবি না ক্যান? হে তোর জামাই না? তোর জিগাওনের অধিকার আছে। আর নামাজ যে পড়তে গেছে, নামাজ পারে কিনা তাও জিগাইস। নাকি মসজিদে ঢুকে ইমামের সহিত কাতার মিলিয়ে সিজদা দিয়ে বাসায় ফিরে আসে।
নীলা মনে মনে গভীর ভাবে ব্যথিত। সদ্য পরিচিত হওয়া একটা অচেনা মানুষের সাথে সবেমাত্র মন দেয়া নেয়ার আবেগঘন মুহূর্ত গুলো পার করতেছে। এসময়ে কিভাবে তাকে চোখেচোখ রাঙিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সওয়াল জওয়াব করবে। এ নিয়ে মনে ভেতর গোপন ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে অনুভূত হচ্ছে।
দরজায় কলিং বেলের শব্দে মা ও মেয়ে দুজনেই ভ্রুকুঁচকে ওঠে। নীলা কোমরে আঁচল গুছিয়ে দরজা খুলেতেই দেখে শফিক দাঁড়িয়ে আছে। টুপি হাতে এলোমেলো চুলে নির্লিপ্ত চেহারায়। শফিককে দেখে নীলার যতটা মায়া লাগছে তারচে বেশী মায়ের কথা গুলো তার গায়ে কাটার মত বিধছে।
নীলাঃ এই, কই গেছিলা তুমি? আর এই রোজা রমযানের সময় এতো রাতে বাসার বাইরে কি? হুহ!
শফিকঃ ইলেকট্রিক শকের মত নীলার বিহেভে কিছুটা বিধ্বস্ত। নার্ভাসনেস কাটিয়ে হালকা নিচু স্বরে বলে, তারাবীর নামাজ পড়তে গেছিলাম। পাশের পাড়ার মসজিদে। খিদা লাগছে, খাওন দাও।
নিলাঃ তার আগে বলো, তারাবীর নামাজ কয় রাকাত? এশারের নামাজ পরছ? পড়লে তাও বলো?
শফিকঃ এবার পুরোই তব্দা! কোথায় নামাজ পড়ে আসলাম শুনে প্রিয়তমা বউ আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিবে। ভাল মন্দ কিছু খেতে দিবে কিন্তু তা না করে উল্টো নামাজ যে পড়ে আসলাম তা নিয়ে সংশয় দেখাচ্ছে। ঘোর কাটিয়ে মুহূর্তেই শফিক জবাব দেয়, এসব কি বলতেছ তুমি? পারুম না ক্যান, তারাবীর নামাজ দশ নিয়তে বিশ রাকাত। আর এশারের নামাজ দশ রাকাত ও বিতরসহ পড়লে তেরো রাকাত।
নীলাঃ এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রয়িং রুমে মা তাদের সব সওয়াল জওয়াব শুনেছেন। শফিককে জড়িয়ে ধরার ব্যকুল ইচ্ছে থাকলেও এই মুহূর্তে তা করতে পারছে না। তার অতি রাগান্বিত চোখের কোণে ভালোবাসার জল টলমল করছে। শাড়ির আঁচল কোমর থেকে তুলে নিয়ে মাথার ঘোমটা ঠিক করে শফিককে ডাইনিং এর রাস্তা ছেড়ে দিলো।
খাওয়া শেষে শফিক খাটের কোণে কিছুটা অভিমানী হয়ে বসে রইলো। নীলা শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখে শফিক কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে বসে রইছে। কেন সে এমন হয়ে আছে তা নীলা বুঝার বাকি নেই। শফিক ঘর জামাই হয়ে নীলার জীবনে এসেছে সদ্য এক মাস হোল। মানুষটার সাথে সবে ভালোবাসার স্বপ্ন গুলো একটু একটু করে বুনে চলছে। আর তাকেই কিনা আজ চোখ রাঙিয়ে নামাজের মত একটা পবিত্র ব্যাপার নিয়ে কনফিউজড করে ফেললাম। তারপরও নীলা কিছুটা দরদ মাখা গলায় শফিককে জিজ্ঞেস করে, এই কি হয়েছে তোমার?
শফিকঃ কিছু না। এমনিতেই বসে আছি।
নীলাঃ বসে আছো ক্যান, ঘুমাবা না? নাকি সেহরি খেতে উঠবা না! মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে।
শফিকঃ নাহ! ঘুমাব না... তুমি ঘুমাও। আমি নামাজ শিখে নেয়।
নীলাঃ এবার কিছুটা দম ফেলে শফিকের হাত টেনে তার পাশে বসিয়ে বলে, আজ বিকেলে যে আম্মা তোমাকে জনির একটা অংক সল্ভ করতে দিছিল সেইটা তো তুমি পারো নাই। এইটা নিয়ে আম্মা বহুত রাগ। ক্যামনে তুমি বিএ পাশ করলা তা নিয়েও উনি খুব সংশয়। তাই তখন আম্মা আমাকে বলছে, তুমি মনে হয় নামাজও পড়তে পারো না। বাসায় আসলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে বলছে। আর ঠিক অই টাইমে তুমি কলিং বেলে চাপ দিলা। তাই আমিও রাগের মাথায় দরজার মুখে নামাজের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করে ফেলছি। আচ্ছা সরি
শফিকঃ একটু নড়েচড়ে বসে। প্রিয়তম বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, জিজ্ঞেস করছ ভাল কথা কিন্তু দরজার মুখে ক্যান? তখন যদি আমি না পারতাম তাইলে কি হইত? তুমি তো তার আগে একটা কল দিয়ে আমাকে কনফার্ম করতে পারতা, যে আমি কি নামাজের ব্যাপারটা জানি কি না। বিকালে জনির একটা অংক দিছে আম্মা। আরেহ! আমি কি এখন ক্লাস টেন এ পড়ি নাকি? যে ক্লাস ফাইভের অংক আমার মাথায় এখনো চেপে আছে। আরেহ! পড়ালেখা ছাড়ছি তো আজ আট বছর। চাকরি খুঁজতেছি দীর্ঘ সাত বছর। শেষমেশ কিছু না হয়েই তো তোমাদের এখানে ঘর জামাই হইতে হোল। ভাগ্যিস এখন নামাজটা পরতেছি বলে এইটা মনে আছে। নইলে জগত সংসারে এতো কল ক্যাচালি মনে রাখতে রাখতে কত কিছুই যে ভুলে যাচ্ছি বা যেতে হচ্ছে তা হিসেব করে শেষ করা যাবে নাকি। এখন তো রাতে কি দিয়ে ভাত খেয়েছি সেটাও সকালে ঘুম থেকে উঠে ভুলে যাই। আর তোমার মা আসছে ক্লাস ফাইভের অংক নিয়ে।
নীলাঃ ঠোঁটের কোণে মৃদু হেসে নিজের হাতে শফিকের হাতটি শক্ত করে ধরল। এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সেরা মানুষের বউ। ভাবতেই এক গাল ভালোবাসা চোখের সামনে খেলা করে। আচ্ছে শোন, নেক্সট টাইম আম্মা যদি জনির কোন অংক নিয়ে তোমার কাছে যায় তাইলে তুমি জনিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবে। আপাতত তুমি তোমার নামাজটা ঠিকমত ধরে রাখো। এইটাই লাগবে আমার আর কিছু না। এখন লাইট অফ করো। সেহরিতে আমাকে তারাতারি উঠতে হবে। গুড নাইট