পাগল রাতে ঝড়ের ভেতর...
দৌড়ায় আলোর ফানুস…
আঁধার গুলো নিংড়ে মনে…
সংসার মানে কাছের মানুষ…
কাছের মানুষ…কাছের মানুষ…
কাছের মানুষ…
স্কুলে থাকতে দেখতাম এনটিভি তে দিত সিরিয়ালটি। সেই ২০০৭/২০০৮ এর ঘটনা। তখন তো আর এতকিছু জানতাম না এটার একটা উপন্যাস আছে। আর তাছাড়া তখন মেগা সিরিয়াল দেখার অভ্যাসও ছিল না। টেলিফিল্ম আর না হয় বড় জোর ধারাবাহিক নাটক যা একটু দেখা হত। তাই এন্ড ক্রেডিটে আর লেখিকার নাম চোখে পড়েনি। তবে সামিনা চৌধুরীর এই গানটার সুবাদে অল্প কিছু পর্ব দেখা হয়েছিল। গানটা বেশ ভালো লাগতো। এর প্রায় চার/পাঁচ বছর পর ইন্টারনেটের কল্যাণে জানতে পেরেছিলাম এটা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস নিয়ে বানানো। এই ভদ্রমহিলার কোন বই তখনও পড়া হয়ে উঠে নি। একদিন লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একটি বই চোখে পড়লো। বইটির নাম ছিল ‘অন্য বসন্ত’। কাছের মানুষের লেখিকার বই দেখে নিয়ে এলাম বাসায় পড়ার জন্য। কাহিনী খুব সাদামাটা কিন্তু কী চমৎকার লেখার গাঁথুনি। পড়ে শেষ করলাম। কয়েকদিন আগে দেখলাম এটার কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। শুরু করছিলাম দেখা। কিন্তু তেমন টানলো না। তাই দেখা শেষ করতে পারিনি। সে যাই হোক, এরপর আরও একদিন লেখিকার আর একটা বই পেয়ে গেলাম লাইব্রেরি তে। এবারের টার নাম ‘ছেঁড়া তার’। নিয়ে এলাম কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর পড়া হয়ে উঠছিল না। অনেক দিন ধরে সেটা পড়ে ছিল পড়ার টেবিলে। একদিন হঠাৎ করে নিউজে দেখি সুচিত্রা ভট্টাচার্য আর নেই। চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। লেখিকার একটা বই ছাড়া আর কোন বই পড়া হয়ে উঠেনি তখন কিন্তু তাও বেশ খারাপ লেগেছিল। একটা বই পড়েই তাঁর লেখার কিছুটা ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম কিনা। তারপরের দিনই পড়া শুরু করলাম ছেঁড়া তার। এটার গল্পও আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু কী সুন্দর লেখনী! এরপর একে একে পড়লাম কাচের দেওয়াল, পরবাস, গভীর অসুখ, ভাল মেয়ে খারাপ মেয়ে, হলুদ গাঁদার বনে, তিন কন্যা ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু এত বই পড়ার পরও যেই বইটার কল্যাণে তাঁকে চিনেছিলাম সেই বিখ্যাত কাছের মানুষ আর পড়া হয়ে উঠছিল না। গত মাসে এক সকালে একটা ক্লাস ছিল আর দুপুরে ছিল একটা পরীক্ষা। পরিচিত সবাই ক্লাস করে বাসায় চলে গেল। আমি তখন কী আর করি একা একা বসে। তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নীলক্ষেতে। উদ্দেশ্য ছিল অন্য কিছু বই কেনার। সেগুলো কেনার পর এটাকে দেখতে পেয়ে ভাবলাম বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু আনার পর রেখে দিয়েছিলাম কিছু দিন। আপাতত এত মোটা উপন্যাস পড়ার সময় ছিল না। ভেবেছিলাম ধীরে সুস্থে সামনের বছর একটু ফ্রি হলে পড়া শুরু করবো। তাই অন্য বই পড়ে কিছুদিন সময় পার করলাম। কিন্তু খুব টানছিল এটা। এক্সামের পড়া আর টার্মপেপারের কাজ সব শিকেয় উঠলো। বসে পড়লাম এই ঢাউস বইটাকে নিয়ে আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে চললাম। পড়তে পড়তে এর ভিতর একদিন দেখি সামু কর্তৃপক্ষ আমাকে সেফ করে দিয়েছে। কিছু একটা পোস্ট দিতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে এটাকে পড়া শুরু করেছি। তাই আর সময় হচ্ছিল না। অবশেষে আজ পড়া শেষ হবার পর ঘোর যেন কাটছেই না। ভাবলাম এটা নিয়েই লিখে ফেলি সেফ হওয়ার পর প্রথম পোস্ট।
উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দুই নারী। ইন্দ্রাণী আর তিতির, যারা সম্পর্কে মা এবং মেয়ে। তাদেরকে ঘিরে আছে আরও একদল মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে সবাই খুব কাছের মানুষ। তাদেরকে নিয়েই এই কাহিনী। ইন্দ্রানীর স্বামী আদিত্য বাড়ির বড় ছেলে। কিন্তু হাবভাব বা কাজকর্মে বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। মদের বোতল নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে অসুখ বাধিয়ে বসে আছে। এর আগে কয়েকটি ব্যবসা শুরু করে সফলতার মুখ দেখতে পারে নি। সেই কয়েকটি ব্যবসার মধ্যে একটি ছিল ছাপাখানা। ইন্দ্রানী পরে সেটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। খুব সফল না হলেও মোটামুটি চলার মত একটি পজিশনে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আর সাথে আছে তার স্কুলের চাকুরী। আদিত্যর বাবা জয়মোহন যথেষ্ট স্নেহ করেন ইন্দ্রানীকে। একটি অপরাধবোধও তার ভেতর কাজ করে অপদার্থ ছেলের সাথে ইন্দ্রানীর বিয়ে দিয়ে। ইন্দ্রানীর ছেলে বাপ্পা কলেজে পড়ে। আর মেয়ে তিতির এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। আদিত্যর মেজ ভাই সুদীপের অবস্থা আদিত্যর মত নয়। সে বেশ কর্তব্যপরায়ণ এবং তার আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো। তার স্ত্রী রুনার বেশিরভাগ সময় কাটে তাদের ছেলে অ্যাটমকে কড়া শাসনে বড় করে তোলার পিছনে। আদিত্যর ছোট ভাইও আছে এই সংসারে যে একজন স্ট্রাগলিং ফিল্ম অ্যাক্টর। সব মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মোটামুটি একটি সুখী পরিবার। আদিত্যর একটি বোন আছে, জয়শ্রী। স্বামী শংকর আর ছেলে ঝান্টুকে নিয়ে তার ছোট সংসার। ইন্দ্রানীর বাড়ির কাহিনীও আছে তার অসুস্থ বাবা ধীরাজ আর মা উমাকে ঘিরে। তার ভাই তনুময় অনেক বছর ধরেই নিখোঁজ।
আরও আছে ইন্দ্রাণীর কলেজ জীবনের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু শুভাশিস। আদিত্যর ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান সে। তার স্ত্রী ছন্দা আর ছেলে টোটোকে নিয়ে ছোট কিন্তু অসুখী পরিবার তার। টোটো আর তিতির একই ক্লাসে পড়ে। ছোটবেলায় খুব ভালো বন্ধু ছিল তারা। কিন্তু কালক্রমে সে সম্পর্কটা বিলীন হয়ে গিয়েছে। টোটোই মায়ের কথা চিন্তা করে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। শুভাশিস আর ইন্দ্রাণীর সম্পর্ক নিয়ে অনেকের অনেক রকম কটুক্তি চোখে পরে উপন্যাসটিতে। ইন্দ্রাণীর পরিবারের রুনা আর শুভাশিসের স্ত্রী ছন্দা এর ভিতর অন্যতম। এর কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা সেটা বইটা পড়লেই বোঝা যাবে। শুভাশিসের গ্রামের বাড়ির কাহিনীও উঠে এসেছে কিছুটা। সেখানে শুভাশিসের অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকেন শুভাশিসের বাবা শিবসুন্দর। তিনিও চিকিৎসক। আরও আছে শুভাশিসের ভাই তুফান, তার স্ত্রী অলকা আর তাদের মেয়ে টুকি।
হ্যাঁ, অনেক অনেক চরিত্র। বড় উপন্যাসগুলোতে সাধারণত যেমনটি থাকে। এরা সবাই একে অপরের খুব কাছের মানুষ। কিন্তু এই চেনাজানা মানুষের ভীড়ে অনেকেই আবার খুব একলা, খুব নিঃসঙ্গ। উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার বেশিরভাগই খুব সাধারণ। একটি যৌথ পরিবারে যা যা ঘটে থাকে। সেই চিরন্তন ভাঙ্গাগড়ার খেলা। আমাদের চারপাশে যেমনটি হচ্ছে। বড় পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার গল্প। বড় বাড়ি ভেঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট উঠে যাচ্ছে তার গল্প। চির পরিচিত মানুষের মৃত্যুর পর বদলে যাওয়া বাড়ির পরিবেশের গল্প। এই সবকিছু তো আমাদের জীবন থেকেই নেওয়া। এখানেই হয়তো সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাসগুলোর সার্থকতা। তাঁর লেখায় ফুটে উঠে আটপৌরে সব জীবন কাহিনী। উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমাদের খুব কাছের আর লেখনী অনেক সুন্দর। উপন্যাসটিতে এই সব ঘটনা আবর্তিত হয়েছে ইন্দ্রানী আর তিতিরকে কেন্দ্র করে। সিরিয়ালটিতে এই দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা এবং সানজীদা প্রীতি। দুটি চরিত্রেই তাদেরকে সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছিল। সাথে অন্যান্য যারা ছিলেন প্রায় সবাইকেই ভালো মানিয়েছিল। বিশেষ করে আদিত্য চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদীর অভিনয় অনবদ্য ছিল। যদিও সিরিয়ালে ইরানী আর আদনান নামে পরিচিত ইন্দ্রাণী ও আদিত্য চরিত্র দুটি। অন্যান্য চরিত্র গুলোর নামেরও কিছু পরিবর্তন আছে কিন্তু গল্প একই। যারা সিরিয়ালটি আগে দেখেন নি কিন্তু দেখতে চান তারা আগে বইটি পড়ার চেষ্টা করবেন। সিরিয়ালটি বেশ ভালো ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন বইয়ের তুলনা আসলে কোন কিছুর সাথে হয় না। আমার খুব প্রিয় বই পথের পাঁচালী ছোটবেলায় যে কতবার পড়েছি তার কোন হিসাব নেই। কিন্তু সেটার মুভি হাতে গোনা কয়েক বার দেখেছি। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন পরিচালক সত্যজিৎ রায় ডিরেকশান দেওয়ার পরও। এটার কারণ বইয়ের তুলনা আসলে শুধু বই-ই হতে পারে। খুব কম চলচ্চিত্র দেখেছি যেটা তার বইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
অনেকে আবার এই সিরিয়ালটি দেখে ফেলায় বইটি আর পড়তে চায় না। আমি খুব বেশি পর্ব দেখে না থাকলেও ঘটনার আদ্যোপান্ত সবই জানতাম। তখন তো ছিল সেই ল্যান্ডফোনের যুগ। ফ্রেন্ডদের সাথে স্কুল আর কোচিং ক্লাস করে আসার পরও রাজ্যের কথা জমে থাকতো। সন্ধ্যার পর শুরু হত পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পালা করে সবাইকে ফোন দেওয়া। এক ফ্রেন্ড খুব সিরিয়াল দেখতো। তবে আমি সিরিয়ালে তেমন ইন্টারেস্টেড না থাকায় সেগুলোর কাহিনী আর আমাকে শুনাতে পারতো না। তবে এটা যেহেতু মাঝে মাঝে কিছু পর্ব দেখতাম তাই এটার গল্প শুনতে কোন বাধা ছিল না। কাহিনী জানার পরও পড়তে খুব ভালো লেগেছে। যাদের দেখা আছে তারা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করছি নিরাশ হবেন না। নীলক্ষেত সহ অনলাইন বুকশপ গুলোতে খুবই সহজলভ্য এটি। আর যারা দেখতে চান তাদের জন্য সিরিয়ালটির লিংক নিচে দিয়ে দিচ্ছি। কিছু কিছু পর্ব অবশ্য মিসিং আছে।
গুডরীডস রেটিং – ৪.১৪/৫
ব্যক্তিগত রেটিং – ৪.৫/৫
সিরিয়ালের ইউটিউব লিংক – কাছের মানুষ
কয়েকটি প্রিয় উক্তিঃ
১) “অনেককেই ছেড়ে থাকা যায় না, তবু ছেড়ে থাকতে হয়। এক সময় বিচ্ছেদটাই অভ্যেস হয়ে যায়।”
২) “বুকের মধ্যে রাগ বিরক্তি দুঃখ জমাট বেঁধে গেলে মানুষ তা একা একা বয়ে বেড়াতে পারে, কিন্তু খুশির চাপ বড় অসহ্য। খুশিটাকে কারুর কাছে উজাড় করে না দিতে পারা পর্যন্ত কেমন যেন শান্তি হয় না।”
৩) “খুব আপন জিনিস না হারানো পর্যন্ত মানুষ তার মূল্য বুঝতে পারে না।”
৪) “শোকের সঙ্গে সময়ের এক সূক্ষ্ম রেষারেষি আছে। তাদের মধ্যে এক চাপা লড়াই চলছে অবিরাম। এই দ্বৈরথের প্রথম দফায় শোকই জেতে, চকিত আঘাত হেনে সময়কে সে নিশ্চল করে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে সময় বলবান হয়ে ওঠে, তার অদৃশ্য শরজালে হঠে যেতে থাকে শোক। ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়ে সে। তবে তাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার শক্তি বুঝি সময়েরও নেই। এক শীতল বিষন্নতা হয়ে সে টিকে থাকে বহুকাল। অনেকটা যেন মেরুপ্রভার মতো। ক্ষীণ দীপ্তি, অথচ কী তার অপার বিস্তার।”
৫) “মন খারাপের মুহূর্তে হঠাৎ যদি কেউ হারিয়ে যাওয়া নাম ধরে ডেকে ওঠে, মনটা যেন লহমায় ভাল হয়ে যায়। সংসারের মালিন্য, বেঁচে থাকার জটিলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হাহুতাশ কিছুই যেন আর স্মরণে থাকে না। বুকের ভেতর ঘুমিয়ে আছে এক টাইম মেশিন, সোঁ সোঁ করে ছুটতে থাকে সে, হু হু করে কমে যায় বয়স।”
৬) “শৈশব যে মসলিন বুনে দেয়, বড় হয়ে তাকেই কী নিষ্ঠুরভাবে ছেঁড়ে মানুষ ! কেন ছেঁড়ে ? ছিঁড়ে কি পায় ? কথায় বলে, স্মৃতি সতত সুখের। কথাটা যে কী ভয়ঙ্কর মিথ্যে !”
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:১১