somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তোমার জন্মদাতা যদি মা হয়, তবে এই নারী তোমার জীবনদাতা। তুমি কি মানুষ ?

০৪ ঠা জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিয়ের শপথে আমরা বলি সুখে-দুঃখে পাশে থাকব। কিন্তু সেই শপথ টুনি নামের এক নারী যেভাবে পালন করেছেন, তা আজকের সমাজে অলৌকিক বললেও কম বলা হয়। ১৬-১৭ বছরের এক তরুণী, বিয়ের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। সংসার, সন্তান আর ভালোবাসার ভরপুর এক জগৎ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সন্তানও এসেছিল নাম রাখা হয়েছিল আজমাইন দিব্য। কিন্তু সুখ বেশিদিন থাকল না।

দাম্পত্য জীবনের ঠিক শুরুতে এক খবর যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিল। জানা গেল, তারেকের দুটি কিডনিই প্রায় বিকল। নিয়মিত ডায়ালাইসিস না করালে সে বাঁচবে না। যেকোনো সাধারণ মানুষ হয়তো ভেঙে পড়ত, স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়াটাই হয়তো “বাস্তবতা” মনে করত। কিন্তু টুনি ছিলেন অন্যরকম। তিনি হাত ধরলেন, চোখের পানি মুছলেন আর বললেন: "তুমি একা নও, আমি আছি।"

স্বামীর চিকিৎসার খরচ, সন্তান, সংসার— সব কাঁধে তুলে নিলেন টুনি। ঢাকায় ফিরে বিউটি পার্লার খুললেন, বুটিকস শুরু করলেন। ৪০-৫০ হাজার টাকা উপার্জন করতেন প্রতি মাসে। সব টাকা খরচ করতেন তারেকের চিকিৎসায়। বিয়ের গয়না, জমানো টাকা, এমনকি মায়ের পেনশনের অর্থ সব ব্যয় হলো স্বামীকে বাঁচাতে। বছরে ৮-১০ লাখ টাকা, এক যুগ ধরে ভারতে চিকিৎসা… কে করে এতটা ? কেবল একজন ভালোবাসার মানুষ।

২০১৯ সালে যখন ডাক্তাররা জানালেন এবার কিডনি না দিলে কিছুই করার থাকবে না, তখন পরিবারের কেউ রাজি হলো না। তখন টুনি বললেন "সে আমার স্বামী, আমার সন্তানের বাবা, আমি তাকে মরতে দেব না।" নিজের শরীর থেকে কিডনি দিলেন। ২৬ অক্টোবর, দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হলো। টুনি সাত দিন আইসিইউতে কাটালেন ব্যথা, রক্ত, দুর্বলতা সব সয়ে হাসলেন, কারণ তারেক সুস্থ হচ্ছেন। এতটাই ভালোবাসতেন।

আইসিইউ থেকে কেবিনে এসেই যেন পাল্টে গেল মানুষটা। যিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন স্ত্রীর কারণে, সেই লোকটা স্ত্রীকে বকাবকি, চিৎকার, অপমান করতে শুরু করল! অপারেশনের জন্য টাকা দিতে এক খালা দেরি করেছিলেন সেই কারণে স্ত্রীকে হেনস্তা করলেন হাসপাতালের ভেতরেই। চিকিৎসকেরাও স্তম্ভিত। অপারেশনকারী ডাক্তার বলেছিলেন : “তোমার জন্মদাতা যদি মা হয়, তবে এই নারী তোমার জীবনদাতা। তুমি কি মানুষ?” কিন্তু ততদিনে তারেকের ভেতরের পিশাচ জেগে উঠেছে।

বাংলাদেশে ফিরেই সে যেন টুনির সব স্বপ্ন ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগল। উপার্জনের সব টাকা চাইত নিজের হাতে, শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা আনতে চাপ দিত। পরে শুরু করল অনলাইন জুয়া আর পরকীয়া। আর যে নারী তাকে নতুন জীবন দিয়েছে, তাকেই মারধর শুরু করল। হ্যাঁ, টুনির গায়ে হাত তুলত, এমনকি পেটের অপারেশনের দাগে লাথি মারত যেন শুধু কিডনি না, আত্মাটাও কেড়ে নিতে চায়।

পরকীয়া চলছিল এক ডিভোর্সি নারীর সঙ্গে। মোবাইল ঘেঁটে সব প্রমাণ পান টুনি। প্রশ্ন করলে মারধরের পরিমাণ বাড়ে। একসময় বাড়ি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। থানায় অভিযোগ দিলে, পরে নাটক করে সেটাও তুলে নেয়। শেষ পর্যন্ত যখন মামলা করে, তারেক গ্রেপ্তার হয় কিন্তু জামিনে বের হয়েই ফের প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। এবং সেখান থেকেই আবার হুমকি “ডিভোর্স দাও, বাড়িটা আমার নামে লিখে দাও।”

আজ টুনি জানেন, তার শরীর আর আগের মতো নেই। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না। তবু কষ্টটা মৃত্যুর ভয় নয়, কষ্টটা এই : যাকে প্রাণ দিলেন, সেই প্রাণটাই তাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। টুনি বললেন , "আমি চাই না আমার মতো কোনো মেয়ের জীবন এভাবে শেষ হোক। আমি যেন শেষ সতর্কবার্তা হই অন্য নারীদের জন্য।"

টুনির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেক আইনজীবী। তারা বলছেন : কেবল নারী নির্যাতনের মামলা নয়, মানবদেহের অঙ্গ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগেও মামলা হতে পারে। টুনি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন, এবং নিরাপত্তা আদেশ নিতে পারেন। তবে প্রশ্ন একটাই এই সমাজ কি টুনিদের পাশে দাঁড়ায় ? নাকি এমন ঘটনা ভুলে যায় ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে ?

যে নারী তারেককে নতুন জীবন দিয়েছে, সে নারীকেই সে লাঞ্ছিত করেছে এ ঘটনা কেবল আইন ভাঙেনি, বিশ্বাস ও ভালোবাসাকেও ভেঙে চূর্ণ করেছে। তারেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই এখন একমাত্র উপায়, যেন আর কোনো পুরুষ প্রেমের মুখোশ পরে নারীর জীবন চুরি করতে না পারে। এই লেখা কোনো গল্প নয়। এটা একজন মা, এক স্ত্রীর, এক নারীর আর্তি — একটি প্রশ্ন: “ভালোবাসা কি আজকের সমাজে পাপ হয়ে গেছে?” আমরা যদি আজ টুনির পাশে না দাঁড়াই, কাল হয়তো কেউ আমাদের বোন, মেয়ে বা মা হয়ে এমন জীবন দেবে, আর ফিরে পাবে প্রতারণা।

ইত্তেফাক/এনটিএম/এমএএম
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪২
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনূস সরকার- অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫০

ইউনূস সরকার –অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?
আজকের বাংলাদেশ এক অস্থির, আতঙ্কিত ও শোষণমুখর সময় পার করছে। রাজনৈতিকভাবে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘অন্তবর্তীকালীন’ সরকার হিসেবে। আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৮০

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:২৬



প্রিয় কন্যা আমার-
সেদিন খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি এবং তোমার মা সাতার জানি না। তুমিও সাতার জানো না। বিকেলে আমরা তূরাগ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ১৬ বছরে রাজনৈতিক স্পেস না পাওয়া জামায়াতের এমন সমাবেশ ‘অবিশ্বাস্য’:

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯





বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের জাতীয় সমাবেশকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি মনে করেন, এ সমাবেশ বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউ আর সুনামির ঢেউ আলাদা

লিখেছেন অপলক , ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১



সব কিছু একটা রিদমে চলে। সেই রিদম ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস বা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীব বৈচিত্র একটা সমন্বয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

“নুহাশ পল্লীর যাদুকর“

লিখেছেন আহেমদ ইউসুফ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৮

এইখানে শুয়ে আছে স্বপ্নের কারিগর
আবেগের ফেরি করে, হৃদয়ে ঝড় তুলে
থেমে গেছে এক যাদুকর।
নুহাশ পল্লীতে মিশে আছে একাকার।

হিমুর চোখে জল, মিসিরের শোকানল
শুভ্রর শুদ্ধতা, রুপার কোমল মন,
আজও ঠিক অম্লান।

হাজারো ভক্তের মনে
মিশে আছ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×