ইসলামের ইতিহাসে কারবালা এক অবিস্মরণীয় এবং হৃদয়বিদারক অধ্যায়। এটি কেবল একটি যুদ্ধ ছিল না, ছিল সত্য ও মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের এক চূড়ান্ত সংঘাত। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র ধর্মকে যখন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কলুষিত করতে চাইছিল, তখন ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর রক্ত দিয়ে সেই পবিত্রতাকে রক্ষা করেন।
রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খেলাফতের দায়িত্বভার যখন হযরত আলী (আ.)-এর কাঁধে আসে, তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এক গুরুতর বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া, যিনি খলিফা উসমান (রা.)-এর আত্মীয় ছিলেন, উসমানের খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আলীর নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন। এই অস্বীকৃতি কেবল একটি দাবি ছিল না, বরং ছিল খেলাফতের প্রতি আনুগত্য অস্বীকারের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক সূক্ষ্ম চাল।
এর ফলস্বরূপ মুসলিম ইতিহাসে ঘটে যায় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, যা সিফফিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আনুমানিক ১০,০০০ মুসলমান নিহত হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে, যখন আলী (আ.)-এর জয় প্রায় নিশ্চিত, তখন মুয়াবিয়ার বাহিনী বর্শার ডগায় কোরআনের পাতা তুলে ধরে "আল্লাহর কিতাবের ফায়সালা" দাবি করে এক ভয়াবহ ফেতনার সৃষ্টি করে। আলী (আ.) বলেছিলেন, "এই কোরআন কাগজে নয়, বুকে বুঝতে হয়।" কিন্তু তাঁর অনুসারীদের একাংশ দ্বিধায় পড়ে যায় এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই খারেজি গোষ্ঠীর জন্ম হয়, যারা শেষ পর্যন্ত হযরত আলী (আ.)-কে শহীদ করে।
হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুয়াবিয়া আবারও যুদ্ধের হুমকি দিলে, মুসলিমদের মধ্যে রক্তপাত এড়াতে ইমাম হাসান (আ.) এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুয়াবিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে খেলাফত ত্যাগ করেন। এই চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল: "মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর নেতৃত্ব উম্মতের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।" কিন্তু মুয়াবিয়া এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তিনি প্রকাশ্য রাজতন্ত্র চালু করেন এবং নিজের পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। ইয়াজিদের জীবন ছিল মদ, নারী, গান-বাজনা এবং হত্যাযজ্ঞে পূর্ণ। ইসলামের ইতিহাসে এ ছিল প্রথম বংশগত রাজতন্ত্রের সূচনা যা নবুয়তের আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল।
৬১ হিজরি, মুসলিম ইতিহাসের সেই কালো বছর। ইয়াজিদ ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য সকল গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম নেতার কাছ থেকে বাইআত (আনুগত্যের শপথ) দাবি করে। ইমাম হোসাইন (আ.) মদিনায় ছিলেন এবং এই দাবি তাঁর কাছে আসে। কিন্তু তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন: "আমার মতো কেউ কখনো ইয়াজিদের মতো শাসকের কাছে মাথানত করতে পারে না।"ইমাম হোসাইন (আ.) বুঝেছিলেন, এটা কেবল রাজনীতির বিরোধ ছিল না এটা ছিল ইসলামের আত্মাকে রক্ষার সংগ্রাম। ইয়াজিদের প্রতি বাইআত মানে ছিল ইসলামের মৌলিক নীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করা। মদিনা থেকে মক্কা, তারপর কুফার দিকে তিনি রওনা হন, কারণ কুফাবাসীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু কুফার জনগণ ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অবশেষে, কুফার কাছাকাছি এক নির্জন মরুভূমি কারবালায়, ইমাম হোসাইন (আ.), তাঁর পরিবার এবং অনুসারীরা আটকা পড়েন।
১০ মহররম, ৬১ হিজরি। একপাশে মাত্র ৭২ জন – তৃষ্ণার্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। অন্যপাশে ইয়াজিদের ৩০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর হাতে কোনো মসনদ ছিল না, ছিল না বিশাল সেনাবাহিনী। তাঁর হাতে ছিল কেবল সত্য, আত্মমর্যাদা এবং কোরআনিক নৈতিকতা। তিনি বলেন: "আমি মৃত্যুকে আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করি, কারণ আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে পারি না।" তিন দিন ধরে পানি বন্ধ করে রাখা হয়। একে একে তাঁর শিশুপুত্র আলী আসগর (৬ মাস বয়সী), ভাই, সন্তান, ভগ্নিপতি এবং সঙ্গীরা শহীদ হন। সবশেষে, ইমাম হোসাইন (আ.) নিজেই সেজদারত অবস্থায় নৃশংসভাবে শহীদ হন তাঁর মাথা কেটে ফেলা হয়। কারবালার এই রক্তপাত ইসলামের চেতনাকে নতুন জীবন দান করে।
ইয়াজিদ হয়তো সামরিকভাবে জয়লাভ করেছিল, কিন্তু ইতিহাস তাকে ইসলামের ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারবালার শহিদদের মৃতদেহ ফেলে রেখে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পরিবারকে বন্দি করে দামেস্কে ইয়াজিদের রাজদরবারে আনা হয়। সেখানেই ঘটে এক চরম নির্লজ্জতার ঘটনা। ইয়াজিদের সামনে এক কবি একটি কুফরি কবিতা পাঠ করে: "হাশিমিরা খেলেছে ক্ষমতার খেলা। কোনো ওহি আসেনি, ফেরেশতা নামেনি।" এই কবিতা ছিল নবুয়তের সরাসরি অস্বীকার। ইয়াজিদ এই কবিতা শুনে খুশি হয়ে তালি দেয়, যা প্রমাণ করে যে তার কাছে ইসলাম একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না।
কিন্তু ঠিক তখনই, বন্দি অবস্থায়, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) জ্বরাক্রান্ত শরীর এবং ক্ষতবিক্ষত মন নিয়েও নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে যান। তাঁর কণ্ঠে বজ্রগম্ভীর সত্য উচ্চারিত হয়: "আমি সেই পরিবারের সন্তান, যাঁদের ঘরে জিবরাইল আসত, ওহি নাজিল হত। আমরা সেই ঘর, যেখান থেকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছে রাসূল। আর তুমি সেই ব্যক্তি, যার মুখ দিয়ে এখন কুফরি বের হচ্ছে।" বন্দি হয়েও ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর এই ঘোষণা ছিল সত্যের চূড়ান্ত বিজয়। এটি নবুয়তের ধারাবাহিকতা এবং সত্যিকারের ইসলামের পরিচয়পত্র ছিল।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর, বন্দি কাফেলাকে যখন কুফা ও দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে আনা হয়, তখন হযরত জয়নাব (আ.)-এর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং অদম্য সাহস দিয়ে তিনি ইসলামের প্রকৃত বার্তা ও কারবালার উদ্দেশ্যকে তুলে ধরেন। কুফাবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা জানান এবং কারবালার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। ইয়াজিদের দরবারে যখন চরম অবমাননা করা হচ্ছিল, তখন জয়নাব (আ.) পরম সাহসিকতার সাথে ইয়াজিদের সামনে দাঁড়ান।
তিনি ইয়াজিদকে সরাসরি সম্বোধন করে বলেন: "হে ইয়াজিদ, তুই কি ভাবছিস যে আমাদের হত্যা করে জয়ী হয়েছিস ? আল্লাহর শপথ! ইমানদারদের হৃদয় থেকে তুই আমাদের স্মরণ মুছে ফেলতে পারবি না, না পারবি আমাদের আয়াতসমূহ ধ্বংস করতে, না পারবি আমাদের সমমানের মর্যাদা ও গৌরবে পৌঁছতে।" তিনি ইয়াজিদকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহর বাণী স্মরণ করিয়ে দেন: "যারা কুফরি করেছে তারা যেন অবশ্যই মনে না করে যে কয়দিনের সুযোগ তাদেরকে দেওয়া হয়েছে তা তাদের সৌভাগ্যের সূচনা করেছে। না, আসলে ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। বরং এই সুযোগ তাদের পাপ ও অপরাধকে আরও বাড়িয়ে দেবে। এ কারণে তাদের জন্য পরকালে ভয়ঙ্কর শাস্তি রয়েছে।" (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৭৮) ।
জয়নাব (আ.)-এর এই ভাষণগুলো ছিল কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, বরং ইয়াজিদের কুফরি এবং বনী উমাইয়াদের ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন। তাঁকে 'কারবালার দূত' হিসেবে স্মরণ করা হয়, কারণ তাঁর কারণেই কারবালার প্রকৃত বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছিল।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর মদিনার জনগণ ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ৬৩ হিজরিতে ঘটে "হাররার যুদ্ধ", যেখানে ইয়াজিদের সৈন্যরা তিনদিন ধরে মদিনায় হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ এবং লুটপাট চালায়। ঐতিহাসিক বর্ণনায় আছে, "তিন দিন মদিনায় হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়। মসজিদে নববীতেও নিরাপত্তা ছিল না।" এই ভয়াবহ ঘটনা ইয়াজিদের প্রকৃত পরাজয় এবং তার শাসনের নৈতিক অধঃপতন প্রমাণ করে। এর কিছুদিন পরেই ইয়াজিদের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
কোরআন নিজেই মুনাফিকদের অস্তিত্বের কথা বলে: "তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা মুনাফিক তুমি চিনো না, আমি চিনি।" (সূরা তাওবা ৯:১০১)। বুখারীর মতো নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থেও এমন ঘটনা আছে যেখানে সাহাবিদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়, যেমন: ফাতিমা (রা.) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আবু বকরের সঙ্গে কথা বলেননি (বুখারী: ৬২৭০), এবং রাসূল (সা.) কাগজ-কলম চাইলেও উমর (রা.) তা প্রত্যাখ্যান করেন (বুখারী: ১১৫)। এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, ইতিহাসকে কেবল আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, বরং যুক্তি ও কোরআনের আলোকে বিচার করা উচিত।
কারবালা কেবল ৬১ হিজরির একটি ঘটনা নয়। কারবালা প্রতিদিন ঘটে যখন সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়, যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ মাথা নত করে না। ইসলামের চেতনা মসনদে নয়, বরং হোসাইন (আ.)-এর রক্তে, জয়নাব (আ.)-এর ভাষণে এবং জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর প্রতিরোধে জীবন্ত থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১২:০৪