somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় পর্বঃ জুলকারনাইন

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় অংশঃ

জুদার রাজা জেডেকিয়ার শাসনের তৃতীয় বছর জেরুজালেম আক্রমণের সময় নেবুচাঁদনেজার জেরুজালেমের অভিজাত ব্যাক্তি ও সম্মানিত পুরোহিতদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে আসেন। পুরোহিতদের মধ্যে চারজন ছিল অল্পবয়স্ক- দানিয়েল, আনানিয়াস, মিসায়েল ও আযারিয়াস। নেবুচাঁদনেজার হিব্রুদের মাঝ থেকে তার দরবারের জন্য জ্ঞানী ও যোগ্য পারিষদ খুঁজছিলেন। ব্যাবিলন তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বহুজাতিক নগরী। পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত বহু রাজ্য ও নগরের সমন্বয়ে গঠিত সুবিশাল সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের কর্ণধার তার করদ রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের পারিষদের আসনে বসাবেন সেই তো স্বাভাবিক। থিবস্ ও এথেন্সও একই প্রথা চালু ছিল, যদিও তাদের নগরী ব্যাবিলনের মত বহুভাষী ও বহুজাতিক নয়। সবার যোগ্যতা পরীক্ষা করার পর এই চার যুবক নেবুচাঁদনেজারের নজর কাড়ে। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী বড় বড় দপ্তরগুলো ছিল খোঁজাদের অধীনে। নেবুচাঁদনেজার চার যুবকের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব খোঁজা প্রধান মালাসারের হাতে তুলে দিলেন।

বছরখানেক পরের কথা, দুঃস্বপ্নে নেবুচাঁদনেজারের ঘুম ভাঙ্গলে তিনি নগরের নামকরা গুণিন ও জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠান। ব্যাবিলন ডেলফির পৃষ্ঠপোষকতা করত না, মারডুকের মন্দিরের পুরোহিতরাই ভবিষ্যদ্বাণী ও অন্যান্য দৈববাণী সংক্রান্ত বিশ্লেষণগুলো করতেন। জিউস ও এ্যাপোলোর পুরোহিতদের মত মারডুকের পুরোহিতরা সম্রাটের পর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। মিশরে এই ক্ষমতা ভোগ করতেন আমোন-রা এর পুরোহিতরা। প্রাচীন পুরাণ অনুযায়ী মারডুক ও আমোন- রা এক ও অভিন্ন দেবতা। দ্বিতীয় প্রজন্মের সুমেরীয় দেবতা এনলিল ও এনকির পুত্র শামাস ও মারডুকের মাঝে সুমার ও মিশরের শাসন ভাগ করে দেয়া হয়। মারডুক এই বিভাজনে খুশি ছিল না, সে সুমারের কর্তৃত্ব পেতে চেয়েছিল। মিশরে শাসন কায়েমের পর সে সুমার আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সুযোগ বুঝে সুমার আক্রমণ করলে পাতি দেবতাদের সহায়তায় সে শামাসকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। এ ঘটনায় দেবালয়ে বড় নৈরাজ্যের হুমকি দেখা দিলে প্রধান দেবতা আনু মারডুকের আগ্রাসনকে ন্যায্যতা প্রদান করে। এর ফলে মিশরে আমোন- রা ও সুমার/ব্যাবিলনে মারডুক নামে সে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আনু পৃথিবীকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন যার তৃতীয় অংশ ভারত ও পুব পড়েছিল আনুর পৌত্রি ইনানার ভাগে। হিব্রুদের জিওশুদ্রও তার তিন পুত্রের মধ্যে পৃথিবী ভাগ করে দেন। তার পুত্র হামের ভাগে মিশর পড়লেও হামের উত্তরসূরি নিমরূদ শামের বংশধরদের উৎখাত করে সুমার ও মিশরে নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। কালের বিবর্তনে তার সাম্রাজ্য ভেঙে দুইটি স্বতন্ত্র সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। অন্যদিকে জ্যাপেথের বংশধরেরা যেমন থিতু হতে সময় নিয়েছে, ইনানার অনুসারীরাও ইনানার উদাসীনতার কারণে সভ্যতার আশীর্বাদ লাভ করেছে বহু বছর পর।

যাই হোক, দরবারে সকল গুণিন ও জ্যোতিষী উপস্থিত হলে নেবুচাঁদনেজার তার তার চিরাচরিত গম্ভীর কন্ঠে স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করলেন, “আমি কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি চাই তোমরা এই স্বপ্নের পিছের গূঢ় অর্থটা বের কর”।

“তথাস্তু মহারাজ,” রাজ জ্যোতিষী দাঁড়িয়ে বললেন, “কিন্তু আমাদের তো আগে আপনার স্বপ্নটা জানতে হবে”।

নেবুচাঁদনেজার কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললেন, “সেটাই তো সমস্যা, স্বপ্নটা আমার মনে নেই। স্বপ্নটাও তোমাদের বলতে হবে। যদি না পারো তাহলে তোমাদের গর্দান যাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাক”।

নেবুচাঁদনেজার যে খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন তা সকলেই জানত। ধর্মের প্রতি তার তেমন কোন টান ছিল না। শুধুমাত্র প্রজাদের মন ও সিংহাসনের কূল রক্ষার্থে তিনি মারডুকের পুরোহিতদের সহ্য করতেন। তিনি ছিলেন উদারমনা। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তার আচরণ ছিল অসাম্প্রদায়িক। তার এই মানসিকতাই ব্যাবিলনকে সত্যিকার অর্থে বহুজাতিক হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও পুরোহিতরা ততটা উদার ছিল না। মন্দির ও সিংহাসনের ভেতর ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিল। নেবুচাঁদনেজার পুরোহিতদের এক হাত দেখে নেয়ার সুযোগ কখনো ছাড়তেন না। কিন্তু তারপরও রাজার এই আদেশ পুরোহিতরা হজম করতে পারলেন না। রাজ জ্যোতিষী তো বলেই বসলেন, “এ কি করে সম্ভব মহারাজ! আপনার স্বপ্ন আমরা কিভাবে জানব? এতো শুধু দেবতাদের পক্ষেই সম্ভব”।

রাজ জ্যোতিষীর কথা শুনে নেবুচাঁদনেজার খোঁটা মেরে বললেন, “তোমরা তো মারডুকের কাছ থেকে সব নির্দেশই পাও, এটাও পাবে আশা করি। আর যদি না পাও তাহলে তোমাদের ভণ্ডামিটা তো অন্তত ফাঁস হয়ে যাবে, এটাই বা কম কি। দুইদিন সময় দিলাম। দুইদিন পর ব্যাখ্যাসহ স্বপ্ন বলতে না পারলে মারডুকের বেদীতে মাথা খোয়াতে হবে মনে রেখ”।

প্রাচীন প্রথানুযায়ী রাজাকে দেবতাদের দূত মনে করা হত। সুমেরীয় পুরাণ বলে, পৃথিবী ভাগের পর দেবতারা সিংহাসনে বসতেন। লক্ষ লক্ষ বছর শাসনের পর দেবতারা মানুষের হাতে সিংহাসনের ভার তুলে দেন। দেবতাদের প্রিয় ব্যাক্তি বা মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কাধে এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হত। এই রাজারাই মৃত্যুর পর উপদেবতা হয়ে দেবালয়ে তার জন্য সংরক্ষিত আসন অলংকৃত করেন। সুতরাং রাজার সকল আদেশই শিরোধার্য। রাজাকে অমান্য করা মানে দেবতাদের আদেশ অমান্য করা। নেবুচাঁদনেজার যতই অযৌক্তিক আদেশ দেন না কেন পুরোহিতরা তা মানতে বাধ্য। আবার পুরোহিতরা যদি নতুন সমন জারির মাধ্যমে রাজার প্রতিপত্তি খর্ব করতে চায় তাহলে তারাই মারডুকের অস্তিত্বকে হেয় করবে। পুরোহিতদের হাতেই ব্যাবিলনের সিংহাসনে নেবুচাঁদনেজারের শাসন সিদ্ধ হয়। উপয়ান্তর না দেখে মাথা খোয়াবার জন্য তারা সময়সীমা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

এদিকে হিব্রু পুরোহিতদের প্রশিক্ষণও প্রায় শেষের দিকে। হিব্রুরা যেন ব্যাবিলনের সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি মিশে যায় সেই উদ্দেশ্যে নেবুচাঁদনেজার তাদের হিব্রু নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণের আদেশ দিয়েছিলেন। দানিয়েলের নাম হয়েছিল বালথ্যাজার, আনানিয়াসের নাম সিদরাক, মিসায়েলের নাম মিসাক ও আযারিয়াসের আবদেনাগো। নামের সাথে সাথে তাদের অন্যান্য আচার ও অভ্যাসও পরিবর্তনের আদেশ ছিল। হিব্রুরা বাকি সব পরিবর্তন মেনে নিলেও খাদ্যাভ্যাস বদলাতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের মতে অস্পৃশ্য খাদ্য শরীরকে অপবিত্র করে। হিব্রুরা মনে করে ইহ্ওয়া অশুদ্ধ আত্মার ডাকে সাড়া দেন না। মালাসার মারফত দানিয়েলের কাছে সম্রাটের আদেশ পৌছালে দানিয়েল নেবুচাঁদনেজারের সাথে সাক্ষাৎের আর্জি জানায়। নেবুচাঁদনেজার সম্মতি দিলে দানিয়েলকে তার সামনে পেশ করা হল। হিব্রু পুরোহিত ব্যাবিলনের সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বলে, “হে ব্যাবিলন সম্রাট, আপনার উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক।”

নেবুচাঁদনেজার দানিয়েলের সম্ভাষণ অগ্রাহ্য করে বললেন, “তোমার নাম তো বালথ্যাজার, তাই না? তুমি কি আমার স্বপ্ন ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলতে পারবে? আর না পারলে কি শাস্তি সেই ব্যাপারেও নিশ্চয়ই অবহিত আছো?”

“মহামান্য সম্রাট, আপনি যে আদেশ করেছেন তা পালন করার সামর্থ্য পৃথিবীর কোন জ্যোতিষী বা গুণিনের নেই। আমি আপনার নগরীর জ্যোতিষী বা গুণিনদের চেয়ে জ্ঞানী নই। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষের ঈশ্বর আপনার স্বপ্ন আমার কাছে প্রকাশ করেছেন। আপনার স্বপ্ন ভবিতব্যের আভাস দিচ্ছে। সম্রাট, আপনি একটি সুবিশাল মূর্তি দেখেছেন যার মাথা স্বর্ণের, বক্ষ ও হাত রূপার, উদর ও উরু পিতলের, পা লোহার এবং চরণ লোহা ও কাঁদার মিশ্রণ। একটি অদৃশ্য শক্তি পর্বত থেকে একটি পাথর কেটে সেই মূর্তিটির চরণে আঘাত করলে তা ভেঙে লোহা, কাঁদা, স্বর্ণ, রূপা ও পিতলের টুকরোগুলো মিশে একাকার হয়ে যায়। এরপর সেই মিশ্রণের উপাদানগুলো তুষের মত বাতাসে উড়ে যায়। মূর্তিটির স্থানে শুধু পাথরটি রয়ে যায়, এবং ধীরে ধীরে তা পুরো পৃথিবীতে ছেয়ে যায়।”

দানিয়েলের বক্তব্য শুনে নেবুচাঁদনেজার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, “একদম ঠিক বলেছ, বালথ্যাজার। আমার স্বপ্নটা এরকমই ছিল। তুমি তো আমাকে তাজ্জব করে দিলে! তুমি কিভাবে জানলে? আর এর ব্যাখ্যাটাই বা কি?”

“আমার পূর্বপুরুষের ঈশ্বর মারফত জেনেছি সম্রাট। এখন আমি আপনাকে এর ব্যাখ্যাটা দেব। সমগ্র সৃষ্টির স্বামী আপনাকে সাম্রাজ্য দিয়েছেন, শক্তি, সামর্থ্য ও যশ প্রদান করেছেন। অন্যান্যদের চেয়ে উঁচু স্থানে আপনাকে জায়গা দিয়েছেন। যুগে যুগে ঈশ্বর বিশেষ ব্যাক্তির প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ করেন, আপনি সেই গণ্যমান্যদের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। কিন্তু স্মরণ রাখবেন সম্রাট, যিনি দিতে জানেন তিনি নিতেও জানেন। আপনার স্বপ্নের মূর্তির সোনালী মস্তকটি আপনি ও ব্যাবিলন। ব্যাবিলনের পর একে একে দুইটি সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটবে, রূপা ও পিতল সেই সাম্রাজ্যগুলোকেই নির্দেশ করছে। লোহা চতুর্থ সাম্রাজ্যের আভাস দিচ্ছে। লোহা সব ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। চরণের লোহা ও কাঁদার মিশ্রণ সেই ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত। চতুর্থ সাম্রাজ্য থেকে ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান ঘটবে। অবশেষে ঈশ্বরের সাম্রাজ্যের উদয় হবে যার স্থিতি হবে অনন্তকাল।”

দানিয়েলের ব্যাখ্যা শুনে নেবুচাঁদনেজার হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, “সত্যই তোমার ঈশ্বর মহান। বাকি সবার কাছে যা অসম্ভব ছিল তুমি তা করে দেখিয়েছ৷ বালথ্যাজার, এই মূহুর্ত থেকে তুমি আমার প্রধান পার্ষদদের একজন। সিদরাক, মিসাক ও আবদেনাগোর মধ্যে রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হবে। আমাকে শেষ একটা কথা বল, বালথ্যাজার, স্বপ্নে আমি কি স্বর্ণ?”

“জ্বী সম্রাট।”

কিছুদিন পর নেবুচাঁদনেজার নিজের স্বর্ণমণ্ডিত মূর্তি তৈরির নির্দেশ দিলেন এবং ঘোষণা করলেন যেন নির্দিষ্ট দিনে ডঙ্কা বাজানো হলে সবাই যেন সেই মূর্তির দিকে মাথা নত করে সম্রাটকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দেবতা হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক হিব্রু এই আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। সম্রাটের কাছে এই সংবাদ পৌছালে তিনি সিদরাক, মিসাক ও আবদেনাগোকে দরবারে ডেকে পাঠান, “শুনেছি তোমরা নাকি আমাকে উপাসনা করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছ? এতদিন তোমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে রেখে উঁচু পদে জায়গা দেয়ার এই প্রতিদান দিলে আমাকে?”

সিদরাক সম্রাটকে কুর্নিশ করে বলল, “ঈশ্বর সম্রাটের প্রতি সদয় হোন। আপনি আমাদের সম্রাট বটে, কিন্তু আমাদের ঈশ্বর মহান। আমরা তার ছাড়া আর কারো উপাসনা করি না, সম্রাট। এতে যদি আপনি আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেন তাহলে তাই সই৷ ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে আমরা মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত।”

সিদরাকের ধৃষ্টতায় নেবুচাঁদনেজার অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি সেনাপতি আরিয়োখকে আদেশ দিলেন, “এক্ষুণি এই উদ্ধত হিব্রুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ কর। আমি নিজ চোখে এদের মৃত্যু দেখতে চাই। অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত কর, তা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে সাতগুণ বেশি উষ্ণ হয়।”

অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত করা হল। হিব্রুরা তিনজন একে একে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করল। নেবুচাঁদনেজার নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর হিব্রু পুরোহিতদের অগ্নিকুণ্ড থেকে বের হতে দেখে হতবম্ভ হয়ে গেলেন। তিনি হিব্রুদের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়নি? তোমরা বেঁচে ফিরলে কিভাবে?”

হিব্রুরা উত্তর দিল, “ঈশ্বর পরম করুণাময়। আমাদের পিতা আব্রাহামকেও এই ভূমিতেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ঈশ্বর অগ্নিকে আদেশ দিয়েছিলেন তার মিত্র আব্রাহামের জন্য শীতল হবার জন্য। ঈশ্বর আমাদের প্রতিও একই করুণা প্রদর্শন করেছেন।”

হিব্রুদের উত্তর শুনে নেবুচাঁদনেজার বললেন, “তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা হেতু দূত প্রেরণ করেছেন। আর কোন দেবতা এইরূপ করত না। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে কেউ হিব্রুদের উপাসনায় বাঁধা দেবে না, তাদের ঈশ্বরের নামে কুকথা উচ্চারণ করবে না। তাদেরকে উত্যক্ত করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের গর্দান নেয়া হবে।”

নেবুচাঁদনেজারের রাজত্বে হিব্রুরা সীমিত স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিল। তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম, আচার, প্রথা পালন করছিল। দানিয়েল সম্রাটের অন্যতম প্রধান পারিষদের স্থান পেয়েছিল। যে কোন সমস্যার সমাধানে নেবুচাঁদনেজার দানিয়েলের পরামর্শ বেশি গুরুত্বের সাথে নিতেন। এর ফলে দরবারে দানিয়েলের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছিল। দানিয়েল নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে নেবুচাঁদনেজারের মৃত্যুর পর হিব্রুরা আবার নিপীড়িত হবে। মারডুকের পুরোহিতরা তো বটেই ভবিষ্যত শাসকেরাও হিব্রুদের নিগ্রহে পিছপা হবে না। এরকম সময়ে সম্রাট নিজে দানিয়েলের গৃহে পদার্পণ করেন। সম্রাট খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি ব্যগ্র কন্ঠে বললেন, “বালথ্যাজার, কয়েক দিন থেকেই মন খুব উতলা হয়ে আছে। সেদিন আরেকটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখি আকাশচুম্বী বিশাল একটা গাছ। এর ডাল-পালা পাতা ও ফলে পরিপূর্ণ। পশুরা এর ছায়াতলে বিশ্রাম করছে, এর ফল দিয়ে উদরপূর্তি করছে, পাখিরা এর ডালে নীড় বাধছে। হঠাৎই একটা দৈববাণী হল। তাতে বলা হল গাছের পাতাগুলো যেন ঝরে যায়, ফলগুলোতে যেন পচন ধরে। প্রাণীরা যেন এর আশ্রয় থেকে দূরে সরে যায়। গাছের কাণ্ড যেন লোহা ও পিতল দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। এর যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় এবং সাত বছরকাল তা নির্বাসিত থাকে। এর অর্থ কি, বালথ্যাজার?”

দানিয়েল কিয়ৎকাল চিন্তা করে বলল, “সম্রাট, এই স্বপ্ন আপনার কোন শত্রুর জন্য হলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হত না। স্বপ্নে গাছটি আপনি নিজে। ঈশ্বর আপনাকে মর্ত্যের যাবতীয় সুখ-শান্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি দান করেছেন। তার হুকুমেই এই সাম্রাজ্যের সকল প্রাণী আপনার ছত্রছায়ায় জীবন যাপন করছে। কিন্তু সম্রাট, আপনি সেই ঈশ্বরের প্রতি নতি স্বীকার করেননি। এর শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর সাময়িকভাবে আপনার সিংহাসন ছিনিয়ে নিবেন। আপনার মতিভ্রম করবেন। সাত বছর আপনি পশুর ন্যায় মানব সমাজ থেকে দূরে জীবন কাটাবেন। এরপর ঈশ্বরের প্রতি নতি স্বীকার করলে তিনি আবার সব ফিরিয়ে দিবেন।”

সম্রাট উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে এখন আমার কি করা উচিৎ?”

“ঈশ্বরের প্রতি নতি স্বীকার করুন, সম্রাট।”

“তবে তাই হোক, বালথ্যাজার। পয়মন্ত দিন দেখে আমি তোমার ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করব…”

কিন্তু নেবুচাঁদনেজারের সেই পয়মন্ত দিন আর এলো না৷ এর মধ্যে বছরখানেক পার হয়ে গেছে। একদিন রাজপ্রাসাদের জানালা দিয়ে নগরীর শোভা দেখতে দেখতে সম্রাট তার প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, “দেখ আমি নিজের চেষ্টায় কি তৈরি করেছি। এরকম বাগান আর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সামর্থ্য কি আর কারো আছে? কিংবা এরকম সুবিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার যোগ্যতা? দেবতাদের চেয়ে কোন অংশে আমি কম? আমিও তো সৃষ্টিই করেছি…”

এর কিছুদিনের মধ্যেই নেবুচাঁদনেজারের মতিভ্রম হয়। লোকে বলে জেরুজালেমের সম্পদ লুট করার জন্য হিব্রুদের ঈশ্বর তার এই দশা করেছেন। পরবর্তী সাত বছর তার পুত্র আমেল মারডুক ব্যাবিলনের সিংহাসন পরিচালনা করেন। ষড়যন্ত্রে আমেল মারডুকের মৃত্যু হলে এ মহান সাম্রাজ্যের পতনের পথ খুলে যায়। ঘন ঘন শাসকের পরিবর্তন হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ক্ষমতায় আসেন নেবোনিডাস। সম্রাট হিসেবে নেবোনিডাসের সফলতা হল ব্যাবিলনের দক্ষিণের যাযাবর জাতিকে তার ধ্বজাতলে নিয়ে আসা। শাসনের চেয়ে নেবোনিডাস প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী ছিলেন। পুত্র বালসাজারকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি নব দখলকৃত রাজ্যের মন্দির পুণঃসংস্কারের কাজে মন দেন। অধিকাংশ সময় তিনি ব্যাবিলনের বাইরেই থাকতেন। বালসাজার যোগ্য শাসক ছিলেন না। পূর্বপুরুষেরা যা তৈরি করে গেছেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। তার উপর তিনি ছিলেন চরম অমিতব্যয়ী। নেবোনিডাস ব্যাবিলনে নতুন কূল দেবতার প্রচলন করেছিলেন, চন্দ্রদেবতা ‘নারাম-সিন’। এ কারণে মারডুকের পুরোহিতরা সিংহাসনের উপর চরম অসন্তুষ্ট ছিল। নারাম-সিন এর উদ্দেশ্যে উৎসব ও পার্বণের নামে রাজকোষের সৎকার করা ছিল নতুন সম্রাটের হালের খেয়াল। এতে রাজকোষ প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। বালসাজারের প্রতি সবচেয়ে রুষ্ট ছিল হিব্রুরা ও ব্যাবিলনের বণিকেরা। রাজকোষ চালানোর জন্য তাদের উপর বেশি কর আরোপ করা হয়েছিল৷ নিটোক্রিস নাম্মী একজন ব্যাবিলনীয় সম্রাজ্ঞী ছিলেন, তিনি বালসাজারেরই মাতা। নগরের অভ্যন্তরে ইউফ্রেটিসের খাল নির্মাণ মূলত তারই পরিকল্পনা। মৃত্যুর আগে তিনি এক অদ্ভুত কাজ করলেন। তিনি তার উত্তরাধিকারীদের পরামর্শ দিলেন যাতে কখনো রাজকোষ খালি হয়ে গেলে যেন তার সমাধি খোলা হয়। এর মাঝে গুঞ্জন ওঠে যে সম্রাট সেই সমাধি খোলার কথা ভাবছেন, কিন্তু পুরোহিতদের বিরোধিতার কারণে পারছেন না। কারণ সমাধি খোলা হলে সিংহাসনের গুমর ফাঁস হয়ে যাবে। মারডুকের পুরোহিতদের খুশি রাখতেই বিশেষ জাত ও পেশার মানুষের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছিল। ফলে বণিকদের মধ্যে ধীরে ধীরে বিদ্রোহের দানা বাঁধতে শুরু করে।

হঠাৎ করেই খবর এল পারসিকরা সীমান্ত পেরিয়ে নগরের অভিমুখে রওনা দিয়েছে। পারসিকদের আগমনের খবর ব্যাবিলনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অদম্য পারসিক বাহিনী, যাদের পরাক্রমের সামনে লিডিয়ার সম্মিলিত বাহিনী হার মেনেছে, তাদের ভয়ে ভীত নাগরিকেরা নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য সম্রাটের দ্বারে উপস্থিত হয়। কিন্তু সম্রাট নিজে বিচলিত ছিলেন না। ব্যাবিলনের সুরক্ষা কবচ, সুউচ্চ প্রাচীরের প্রতি তার দৃঢ় আস্থা ছিল। তার মতে যে কোন অদক্ষ সৈন্যও প্রাচীরের উপর থেকে নগর রক্ষা করতে সক্ষম। নগর অবরুদ্ধ করে দিলে নগরবাসী পোষণের জন্য অন্তত দশ বছরের রসদ মজুদ করা রয়েছে। নগর মাসখানেক অবরুদ্ধ করে রাখলে পারসিকরা নিজেরাই ফিরে যাবে। শীত আসন্ন, পারস্য সম্রাট যত বড় সেনাবাহিনী নিয়ে আসবে শীতে মৃতের সংখ্যা তত বেশি হবে। সুতরাং দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। পারসিকদের আগমনে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল হিব্রুরা। ভাবি স্বাধীনতার আশায় তারা পারসিকদের জয়ের দিন গুণছিল। এরূপ কলিল পরিস্থিতিতে বালসাজার নতুন কূল দেবতার উদ্দেশ্যে পার্বণের আয়োজন করেন।

কূল দেবতাকে খুশি করার কোন প্রচেষ্টাই বালসাজার বাকি রাখেননি। রাজপ্রাসাদে সহস্র সানকিতে খাবার ও সহস্র পিপে ভর্তি মদিরা আসছিল। সকলেই এত পানোম্মত্ত ছিল যে কার জায়া কার অঙ্ক অধিকার করেছেন আর কার নাথ কার ক্রোড় দখল করেছেন তা ঠাওর করা দুরূহ। এর মাঝেই হঠাৎ করে সম্রাটের কাছে মদিরার স্বাদ তেতো ঠেকে। তিনি প্রমত্ত কণ্ঠে সাকীকে ডেকে বললেন, “মদিরা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি? কোন স্বাদ পাচ্ছি না কেন? বিষ-টিষ মেশানো নেই তো?”

“মদিরাতে কিছু মেশানো নেই সম্রাট। আপনি বরং ক্ষান্ত দিন। এর বেশি পান আপনার স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হবে…”

সাকীর কথায় বালসাজার জ্বলে উঠলেন, “তুমি আমাকে উপদেশ দেয়ার কে? তুমি জানো না আমি সম্রাট? আমার পূর্বপুরুষেরা পুরো রাজপ্রাসাদের মদিরা এক বসায় শেষ করতে পারতেন, জানো?” তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, “মনে হয় পাত্রটাতে সমস্যা আছে, ঠিক কেন জানি নেশা হচ্ছে না। এক কাজ কর, জেরুজালেমের মন্দির থেকে যে পাত্রগুলো আনা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে এসো। পবিত্র পাত্রে পান করলে নেশাটা ভাল জমতে পারে…”

ভাল-মন্দ বিচার করার পরিস্থিতি ছিল না। আর কেই বা করবে? উম্মত্তদের আসরে সুস্থ ব্যাক্তিই সবচেয়ে বড় শৌণ্ড। তাছাড়া সম্রাটের হুকুম, না মেনে উপায় নেই। জেরুজালেমের মন্দিরের পবিত্র পাত্রগুলো আনা হল। পাত্রগুলো উপাসনার কাজে ব্যবহার করা হত। এগুলো ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা পশুর রক্ত ধারণ করত। বালসাজার সেই পাত্র মদিরাপূর্ণ করে উপস্থিত অতিথিদের স্বাস্থ্য কামনা করলেন। এমন সময় আসরে নারী চিৎকারের নিনাদ উঠল। মত্তরা কোনভাবে ধাতস্থ হয়ে কি হয়েছে দেখার চেষ্টা করতে লাগল। দেয়ালে রক্তমাখা অপরিচিত হরফ “מנא מנא תקל ופרסין.” অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় অপ্রাকৃত পরিস্থিতি সামাল দেয়া দুষ্করই বটে। আর কারো না হোক কিন্তু সম্রাটের নেশা কেটে গেল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন, “কেউ কি আছ যে এর অর্থ বের করতে পারবে?” মত্ত অতিথিদের ঘোলাটে নয়ন দেখে সম্রাট বুঝতে পারলেন এভাবে কাজ হবে না। তিনি ঘোষণা করলেন, “যে ব্যাক্তি এই লেখার অর্থ বের করতে পারবে তাকে স্বর্ণের কণ্ঠহার ও অরূণ আলখাল্লা প্রদান করা হবে। তাকে সাম্রাজ্যের তৃতীয় ক্ষমতাবান ব্যাক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হবে। আছো কেউ এমন?”

অরূণ বর্ণ ব্যাবিলনে রাজকীয়তা, আভিজাত্য, বিলাসিতা ও ক্ষমতার প্রতীক। প্রস্তাবটি লোভনীয় হলেও উপস্থিত কারো পক্ষে উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। ভাষাটি সম্পূর্ণ অচেনা। অতিথিদের একজন প্রস্তাব দিলেন দানিয়েলকে ডাকা হোক, সম্রাট নেবুচাঁদনেজারের আমলে সে এরকম অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। আমেল মারডুকের মৃত্যুর পর হিব্রুদেরকে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। দানিয়েলও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। দানিয়েলকে আনা হলে বালসাজার তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। দেয়ালের লেখাটি দেখে দানিয়েল বালসাজারকে বললেন, “মহামান্য সম্রাট, ভাষাটি আমার পরিচিত।”

“এর অর্থ কি বালথ্যাজার? এটা কি কোন দৈববাণী?” বালসাজারের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

দানিয়েল শান্তস্বরে বললেন, “সম্রাট এর অর্থ প্রকাশ করলে পুরষ্কার পাবার কোন সম্ভাবনাই নেই। পুরষ্কারের প্রতি আমার লোভ নেই। আমার ভয় ঈশ্বর প্রদত্ত এই প্রাণ হারাতে পারি।”

বালসাজার দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “আমি কথা দিচ্ছি তোমার প্রাণের কোন শঙ্কা নেই। আমি শুধু অর্থটা জানতে চাই…”

“সম্রাট, এটি আপনার উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের অশনী সংকেত। ‘মেনে মেনে টেকেল উপহারসিন'- এর অর্থ হল আপনার সাম্রাজ্যের অন্ত ঘনিয়ে এসেছে। আপনার কর্মফল মেপে পাপের ঘড়া পূর্ণ পাওয়া গেছে, এবং শেষ অংশটি পারসিকদের আশু আক্রমণের বার্তা প্রকাশ করছে, যে কোন মুহূর্তে তারা নগরী দখল করে ফেলবে…”

দানিয়েলের ব্যাখ্যা শুনে বালসাজার রীতিমত ভেঙে পড়লেন। কোনভাবে অন্তরের বাষ্প রোধ করে বললেন, “তাই সই। কিন্তু আমি আমার জীবনের শেষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে যেতে চাই। তোমার প্রাপ্য পুরষ্কার নিয়ে যাও, বালথ্যাজার…” বালসাজারের বক্তব্য শেষ হবার আগেই পারস্য সম্রাটের জামাতা দারিয়ুস সৈন্য সামন্ত নিয়ে ভোজনশালায় প্রবেশ করে।



ব্যাবিলন- পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ও সমৃদ্ধশালী নগরী। ইউফ্রেটিসের কল্যাণে এর দুই পাড়ে বিস্তৃত ব্যাবিলন সাম্রাজ্য অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে সুজলা-সুফলা। প্রাকৃতিকভাবে তো বটেই মানুষ দ্বারা কাটা খালগুলো ধমনীর মত পুরো সাম্রাজ্যে ছড়ানো। বিশেষভাবে তৈরি করা গোলাকার নৌকাই এখানে মূল বাহন। একটি বড় খাল ব্যাবিলনের আকাশচুম্বী দেয়ালের নিচ দিয়ে নগরে প্রবেশ করে বিস্তৃত এই নগরীকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। একভাগের কেদ্রে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ, অন্য অংশে বেলুসের মন্দির। এই দুই কেন্দ্রকে সংযুক্ত করেছে পাতালের একটি গোপন রাস্তা। নগরীর সবচেয়ে নজরকাড়া স্থাপনা ঝুলন্ত বাগানটি প্রথম অংশে রাজপ্রাসাদের সাথে অবস্থিত। নেবুচাঁদনেজারের রাণী অ্যামিটিস ছিলেন একজন মিড। একবাটানা ত্যাগের পর তার অন্তর সুজলা-সুফলা মিডিয়ার জন্য কাঁদছিল। রাণীর এই হাল দেখে নেবুচাঁদনেজার ব্যাবিলন নগরীর শুষ্ক ভূমিতে ইউফ্রেটিসের ধারে নৈসর্গিক কৃত্রিম বাগান স্থাপন করার নির্দেশ দেন। পৃথিবীর চার প্রান্ত থেকে বীজ এনে বাগানে বোনা হয়। বাগানটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে ইউফ্রেটিস প্রাকৃতিকভাবে তা সেচন করতে পারে। সাধারণ নাগরিকদের আবাসগুলো গড়ে উঠেছিল এই দুই অংশকে কেন্দ্র করে। নগর না বলে ব্যাবিলনকে মহানগর বললে অত্যুক্তি হবে না। দেয়ালের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুই স্তরবিশিষ্ট, সেগুলো আবার মাটিতে পোড়ানো ইট ও আলকাতরা জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। এই তেলতেলে পিচ্ছিল পদার্থগুলো পৃথিবীর আর কোথাও তেমন দেখা যায় না। ভূ-গর্ভ বা ডোবার ভেতর থেকে উত্তোলন করে ব্যাবিলনীয়রা তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত।

আমি ও কুরুশ নগর থেকে একটু দূরে তোলা শিবিরের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। কুরুশ তার জামাতা দারিয়ুসকে সৈন্য সমেত নগর দখল করতে পাঠিয়েছে। কুরুশ পায়চারি করে তার উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছিল। হঠাৎ থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি মনে হয় টায়ারসিয়াস? দারিয়ুস কি পারবে?”

আমি রসিকতা করে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম, “কেন, নিজের জামাতার উপর বিশ্বাস নেই?”

কুরুশ হালকা রেগে গিয়ে বলল, ঠাট্টা কোরো না, টায়ারসিয়াস। এই বিয়েতে আমার যে মত ছিল না তা তুমি ভাল করেই জানো। আমি পারসিক জামাই চেয়েছিলাম। আট্টোসার জেদের জন্যই একজন মিডের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে হল। মেয়েটা এত জেদি…”

“আপেল গাছে কি আর বেগুণ ধরে? তোমার মেয়ে আট্টোসা বাবা-মা দুইজনেরই ভাল গুণগুলো পেয়েছে। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় ভাই ক্যাম্বিসেসের চেয়ে সেই ভাল শাসক হবে। আর দারিয়ুস মিড হয়েছে তো কি? তোমার মা ম্যান্ডেনও একজন মিড। তার মত নারী আমি দুইটি দেখিনি। দারিয়ুস যোগ্য পাত্র, দক্ষ যোদ্ধা। একজন পুরুষে আর কি চাও তুমি?”

কুরুশ হাত নেড়ে বলল, “এগুলো তুমি বুঝবে না। সারাজীবন সামরিক দায়িত্ব পালন করেছ, সাংসারিক দায়িত্ব তো বোঝ না। বুঝলে এ কথা বলতে না…”

আমি না হেসে পারলাম না, “তুমি অযথা বিচলিত হচ্ছ। দারিয়ুস তার দায়িত্ব ঠিকভাবেই পালন করবে।”

“ছেলেটা একটু বেশিই উচ্চাভিলাষী। মাঝে মাঝে ওর এই স্বভাব আমি সহজভাবে নিতে পারি না।”

“সেনাপতি উচ্চাভিলাষী না হলে যুদ্ধে জয় আসে না, কুরুশ। হারপাগাস কি কম উচ্চাভিলাষী ছিল? তার সফলতা তো তুমি নিজের চোখে দেখেছ। সেই আমলে হারপাগাসের সমকক্ষ একজন সেনাপতি দেখাতে পারবে?”

কুরুশ তার দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তোমার কথাটা হয়ত ভুল না। উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে যোগ্য যোদ্ধার কি দশা হয় তা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়, শিকড়হীন কচুরিপানা…”

কুরুশের রসিকতা উসকে দিয়ে বললাম, “তাহলে এই ভরসাতেই পরকালে যেয়ো যে মেয়েকে কোন কচুরিপানার সাথে পানিতে ভাসিয়ে দাওনি…”

কুরুশ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “অনেক সময় পার হয়ে গেছে, এতক্ষণে তো নগর দখলের সংবাদ চলে আসার কথা। কম হ্যাপা পোহাতে হল না ব্যাবিলন দখল করার জন্য…”

বাস্তবিকই ব্যাবিলন আক্রমণ সহজ ছিল না। উপকূলীয় গ্রীক নগরগুলো দখল করার পর সে সব জায়গায় পারসিক প্রশাসন চালু ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ঝঞ্জাটপূর্ণ কাজ ছিল। মিডিয়া, পারস্য ও নব দখলকৃত এলাকায় যোগাযোগপূর্ণ মহাসড়ক তৈরি করাটাও একটি পেল্লায় শ্রমের ব্যাপার। ব্যাবিলন সুবিশাল এক সাম্রাজ্য, যে কোন এক প্রান্ত ধরে না এগিয়ে অন্তরে আঘাত করা সম্ভব ছিল না। প্রথমেই সুসা দখল করেছিলাম। এক সময় সুসা পারস্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নগরীর ইতিহাস খোদ সভ্যতার সমান। সুমারে সুসার কৌশলগত গুরুত্ব অদ্বিতীয়। সুসা আক্রমণের সময় নেবোনিডাস সেখানে অবস্থান করছিলেন। পারসিক বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে তিনি দক্ষিণে যাত্রা করেন। খুব সহজেই সুসা আমাদের দখলে আসে। এর পরের কাজ ছিল সুসার সাথে আনশানের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। পরিকল্পনা ছিল সুসাকে প্রধান ঘাটি করে ব্যাবিলনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাতে সেখান থেকে সহজেই ত্রাণ সামগ্রীর সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়। সুসাতে বালসাজারের প্রতি রুষ্ট ব্যাবিলনীয় বণিকেরা আমাদের সাথে যোগ দেয়। ব্যাবিলনীয় বণিকদের সাথে করে আমরা ওপিসের দিকে রওনা হই। পথে গুটিয়াম নগরের প্রশাসক গোবরিয়াস আমাদের আগমন বার্তা পেয়ে নিজে থেকে কুরুশের প্রতি তার আনুগত্য স্বীকার করে। ওপিস টাইগ্রিসের প্রান্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী। এটিই ছিল ব্যাবিলনের আগে শেষ বড় ঘাটি। বালসাজারের সেনাবাহিনী ওপিসে শক্ত লড়াইয়ের চেষ্টা করেও টিকতে পারেনি। নগর পতনের আগেই তারা ব্যাবিলনে ফিরে যায়। ওপিস দখলের পর তাদের পিছে পিছে আমরাও রাজধানীতে হাজির হই।

রাজধানীর বাইরে বালসাজার কোন প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেননি। তিনি নগর অবরুদ্ধ করে পারস্য সেনাবাহিনীর ফিরে যাবার অপেক্ষা করছিলেন। তার এতটুকু বিশ্বাস ছিল যে সম্রাজ্ঞী নিটোক্রিস ও অন্যান্য সম্রাটরা নগরীকে যতটা দুর্ভেদ্য করে তুলেছিলেন তা বিদীর্ণ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। পারস্য শিবিরে প্রচ্ছন্ন অধীরতা বিরাজ করছিল। কুরুশ ও ব্যাবিলনের সিংহাসনের মাঝে সুউচ্চ দেয়াল দম্ভের সাথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়েছিল। ব্যাবিলন সারডিস নয়, সুবিশাল নগরীর চতুর্দিক ঘুরেও কোন দুর্বল স্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয় ইনানার মত নভোযান দিয়ে গগন থেকে আক্রমণ করতে হবে নতুবা এনকির মত মর্ত্য ফুড়ে। হঠাৎ করেই ফন্দিটা মাথায় এল, মর্ত্যতলেই অভিযানটা সারা যায় কিনা। ইউফ্রেটিসের সাহায্যে নিটোক্রিসের স্থাপত্যশৈলীকে তার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ধরণের কাজ যে সম্ভব তা থ্যালেস তো শিখিয়ে দিয়ে গেছে। কাজটি নগররক্ষীদের অজান্তে করতে হবে, নতুবা ভেতরের সৈন্যরা সতর্ক হয়ে যাবে। কুরুশকে পরিকল্পনাটা খুলে বললাম। গোবরিয়াস জুতসই একটা পরামর্শ দিল। কুরুশের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সে সৈন্যদের নিয়ে ইউফ্রেটিসের আশে-পাশে বিক্ষিপ্তভাবে পরিখা খনন করতে লেগে গেল। নগররক্ষীরা কি ভাবল জানি না, কিন্তু তারা আমাদের কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। পরবর্তী এক মাস খোড়াখুড়ির কাজেই লেগে গেল। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, উপযুক্ত সময় হলেই খালের মুখ খুলে দিয়ে আক্রমণ করা হবে।

সময়টা শরৎকাল, শীত আসন্ন। গোবরিয়াসের কাছে জানা গেল বছরের এই সময়টাতে চন্দ্র দেবতার উদ্দেশ্যে পার্বণের আয়োজন করা হয়। আক্রমণের জন্য সেই দিনটিই হবে সবচেয়ে উপযুক্ত। একদিন রাতে সৈন্য শিবিরগুলো তদারকি করে নিজের শিবিরে ফেরার সময় কুরুশ, দারিয়ুস ও গোবরিয়াস পথ আটকালো। কুরুশ খানিকটা উত্তেজিত, “আজকেই সেই রাত, টায়ারসিয়াস। সৈন্যদের প্রস্তুত করার নির্দেশ দাও।”

কুরুশের কথা শুনে অবাক হলাম। নগরীর ভেতরের খবর জানার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেছি, কিন্তু তারা আমাকে এ ধরণের সংবাদ দেয়নি, “আজকে কেন? রক্ষীরা তো প্রহরায় আছে। আমাদের গতিবিধি ওদের চোখে পড়ে যাবে।”

“আজ রাতে কাজ সারতে হবে, নতুবা আর হয়ত হবে না…”

বিরক্তি চেপে রাখতে পারলাম না, “আজকে রাতেই কেন? তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক যৌক্তিক ঠেকছে না, কুরুশ, কেন জানি জেদের মত লাগছে। ব্যাপারটা খুলে বল তো…”

কুরুশ চাপাস্বরে বলল, “আমি শিবিরে বসে সমর কৌশলগুলো নিয়ে নাড়া-চাড়া করছিলাম। হঠাৎ কে যেন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘আজ রাতেই সময়, পারস্য সম্রাট। নিজের নিয়তি সিদ্ধ কর। তোমার আরো কর্ম অবশিষ্ট রয়ে গেছে, সেগুলোও সমাধা করতে হবে।’ এটা ঈশ্বরের বাণী নয় কি?”

“সব অপার্থিব বাণীই ঈশ্বর প্রদত্ত হবে এ ভাবনা ভুল। মানব আর ঈশ্বরের মাঝে অন্য সত্তাও আছে। তারা তোমাকে ভুল পথে পরিচালনা করছে না তার নিশ্চয়তা কি?”

“তুমি যাই বল আমার মন বলছে আজকেই আক্রমণের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তুমি নির্দেশ দিলেই সৈন্যরা খালের মুখ খুলে দিবে।”

“আমাকে কিছুক্ষণ ভাবার সময় দাও, কুরুশ,” হয়ত কুরুশ ঠিক, কিন্তু তাই বলে যে কোন ধরনের প্রত্যাদেশের উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। একে তো সৈন্যদের জীবন-মরণের ব্যাপার, তার উপর অভিযান ব্যর্থ হলে ব্যাবিলনীয়রা সতর্ক হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে তারা নিশ্চিন্ত আছে, আমিও পরিস্থিতি সেরকমই রাখতে চাই, নতুবা অতর্কিত আক্রমণের চমকটা কাজে লাগানো যাবে না। রক্ষীদের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে খাল খোলার কাজটাও সহজ হবে না, খাল খুলতে সময় লাগবে। একবার খালের আশে-পাশে ঘুরে আসলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে। সুযোগ হলে ছোট ছোট দল পাঠিয়ে নগর দখল সম্ভব। দারিয়ুস ও গোবরিয়াসকে বললাম, “তোমরা ছোট দুইটা পল্টন নিয়ে তৈরি থাকো। আমি সংকেত দিলে কোন আওয়াজ ছাড়া খালের কাছে চলে আসবে,” কুরুশকে নিয়ে খালের ধারে চলে আসলাম। পরিষ্কার আকাশ, নভোমণ্ডলে জলধারক দীপ্তমান, কিন্তু চন্দ্রের আভা কেমন যেন নিষ্প্রভ মনে হল। আমরা ব্যাবিলনের উত্তর প্রান্তে এসে দাড়ালাম। ঠাণ্ডা বাতাস শীতের আগমনের বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। নগরীর প্রাচীরে প্রতিদিনের মত কর্মচাঞ্চল্য চোখে পড়ছে না, প্রহরীদের অনুপস্থিতি বরং অশুভ লক্ষণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সব পর্যালোচনা করে কুরুশ আমাকে বলল, “কি? আমি বলেছিলাম না? হয়ত আজকেই ওদের পার্বণ।”

“বালসাজার এতবড় গাড়ল জানলে এতদিন অপেক্ষা করতাম না। সুস্থ মানুষ কিভাবে রাজ্যের বিপদের সময় এই ধরণের আয়োজনের কথা ভাবতে পারে?” খালের ধারে প্রহরারত রক্ষীদের একজনকে পাঠালাম দারিয়ুসদের ডেকে পাঠানোর জন্য, বাকিদের খাল খোলার নির্দেশ দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই দারিয়ুস ও গোবরিয়াস হাজির হল। গোবরিয়াসকে জিজ্ঞেস করলাম, “বালসাজারকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

“রাজপ্রাসাদের ভোজনালয়ে। ভোজগুলো সাধারণত সেখানেই হয়।”

“তুমি দারিয়ুসকে ভোজনালয়ের পথ চিনিয়ে নগরের গুরুত্বপূর্ণ ফাঁড়িগুলো দখল করবে। তারপর উত্তরের ফটক খুলে দিবে। ফটক খোলা হলেই আমি বাকি সৈন্য পাঠিয়ে দেব। দারিয়ুস, তুমি বালসাজারকে বন্দী করার চেষ্টা করবে। রক্তপাত যত কম হয় ততই ভাল। অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষে যাবে না। মনে রেখ, অভিযান সফল হলে এরাই কুরুশের প্রজা হবে।” দুই সেনানায়ককে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমরা কুরুশের শিবিরের দিকে রওনা হলাম।

পুবে সূর্য নতুন দিনের ঘোষণা করতেই দারিয়ুসের পল্টনের একজন সৈন্য আমাদের কাছে বার্তা নিয়ে আসলো, “মহামান্য সম্রাট, ব্যাবিলন দখল সফল হয়েছে। তবে বালসাজারের মৃত্যু এড়ানো যায়নি। সেনানায়ক দারিয়ুসের অস্ত্র তার বক্ষ ভেদ করলে তৎক্ষনাৎ তার মৃত্যু হয়। সেনানায়ক গোবরিয়াস ব্যাবিলনের সৈন্যদের নিরস্ত্র করেছেন। তিনি সম্রাটকে অনুরোধ করেছেন যেন বাকি আমাদের সৈন্যদের নগরের ভেতরে পাঠানো হয়। আরেকটা ব্যাপার সম্রাট, দানিয়েল নামের একজন হিব্রু আপনার সাথে সাক্ষাৎের আর্জি জানিয়েছে।”

“কেন?”

“জানি না, সম্রাট। সে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।”

আমাকে কুরুশ জিজ্ঞেস করল, “চেনো?”

“নাম শুনেছি, নেবুচাঁদনেজারের পারিষদ ছিল। জ্ঞানী ব্যাক্তি। আসুক না, দেখা যাক কি বলে…”

“ঠিক আছে, ভেতরে পাঠাও। অন্যান্য সেনাপতিদের বল সৈন্যবাহিনী নিয়ে নগরে প্রবেশ করতে। শুধু টায়ারসিয়াসের বাহিনী এখানে থাকুক।”

দূত বের হবার কিছুক্ষণ পর একজন বৃদ্ধ ঢুকে কুরুশকে সম্ভাষণ জানালো, “ঈশ্বর পারস্য সম্রাটকে দীর্ঘজীবী করুন। অবশ্য ব্যাবিলন দখলের পর আপনি শুধু পারস্য না, ব্যাবিলন সম্রাট, পৃথিবীর চার প্রান্তের বাদশা…”

“আসন গ্রহণ করুন, রাজজ্ঞ। আপনার আগমনের কারণ ব্যক্ত করুন।”

“আমি একটা গল্প শোনাতে এসেছি, সম্রাট।”

দানিয়েলের কথায় কুরুশ খুব অবাক হল, “গল্প? কিসের গল্প?”

“রাজাদের গল্প…”

দানিয়েলের গল্প যখন শেষ হল ততক্ষণে সূর্য তার প্রাত্যহিক ভ্রমণের আধা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। এর মাঝে কুরুশকে নগরে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানিয়ে দারিয়ুস বার বার দূত প্রেরণ করেছে। কিন্তু কুরুশ গল্পের শেষ না জেনে উঠতে নারাজ। গল্প শেষ করে দানিয়েল কুরুশের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। কুরুশ তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। খানিকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে বলল, “আমার কথা আপনাদের পূর্বপূরষেরা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন? আর নেবুচাঁদনেজারের স্বপ্নের রূপা পারস্য?”

“জ্বি সম্রাট, আর আপনার নাম উল্লেখ করা হয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে।”

“এত নিখুঁতভাবে নাম ধরে! মাফ করবেন রাজজ্ঞ, রূপার ব্যাপারটা যদি মেনেও নেই, কারণ আপনি সেখানে ব্যাক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু দেড়শ বছর আগের ভবিষ্যদ্বাণী… নাহ্, ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না…”

“ওটা ঈশ্বরের বাণী। ঈশ্বর পুরোহিত ইজাইয়াহর মাধ্যমে আমাদের জাতির ভবিষ্যত প্রকাশ করেছেন। সেখানে স্পষ্ট আমাদের দাসত্বের কথা ও মাসিহা হিসেবে আপনার নাম উল্লেখ করা আছে। আমি কি ভবিষ্যদ্বাণীটি পড়ে শোনাবো?”

“শোনান,” কুরুশের হতবিহ্বল ভাব কাটতে চাইছিল না।

“আমি ঘোষণা করছি, জেরুজালেম দখল করা হবে…কুরুশ আমার মনোনীত রাজা, আমার পূজারীদের মেষপাল। আমি তার দক্ষিণ বাহু বলবান করে দিব। আমার দান করা শৌর্যে যে অন্যান্য জাতিদের পরাহত করবে। যারা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিবে আমি তাদের হাতেই শৃঙ্খল বেধে দিব। তার জন্য আমি শত্রু নগরের দুয়ার খুলে দিব এবং তাকে আদেশ দিব, 'এগিয়ে যাও, ভয় নেই, আমি তোমার রক্ষাকবচ হয়ে আছি। প্রয়োজনে তোমাকে বাধাসৃষ্টিকারী পর্বতকে মাটিতে মিশিয়ে দিব, লোহার দুয়ারকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিব। আমি তোমাকে পৃথিবীর বক্ষঃস্থলে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধনের সন্ধান দিব…’ আমিই কুরুশকে নির্দেশ দিব যুদ্ধ পরিচালনা করার, আমিই তাকে জয়ী করব। সেই জেরুজালেম পুণঃপ্রতিষ্ঠা করবে। আমার আরাধকদের সেই শৃঙখল মুক্ত করবে…”

“আমাকে মেষপাল বলেছে। শৈশবে অন্তত আমি তাই ছিলাম…”

দানিয়েল কুরুশকে জিজ্ঞেস করল, “সম্রাট কি এটাকে কাকতালীয় ভাবছেন?”

কুরুশ সোজা হয়ে বলল, “আমি কিছুই ভাবছি না, রাজজ্ঞ মহোদয়। আমি রাজ পরিবারের সদস্য তা জানার এবং এর তাৎপর্য কি হতে পারে বোঝার পর থেকে আমার মধ্যে এক রকম তাড়না কাজ করত। সেই তাড়নাই আমাকে আজকে এখানে নিয়ে এসেছে, এই তাড়নাই হয়ত আমাকে মৃত্যুর পথ দেখাবে। তা দেখাক, কিন্তু এই তাড়না, এই উদ্দীপনা যদি আমাকে পৃথিবীতে পরিবর্তন আনার সুযোগও দেয় তাতেই আমি খুশি। মাঝে মাঝে যে অপার্থিব শক্তির হস্তক্ষেপ অনুভব করিনি তা নয়…,” তারপর হেসে বলল, “আমার মাতামহ অবশ্য আমাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার স্বপ্ন দেখেছেন…”

“সম্রাট, যুগে যুগে ঈশ্বর তার মনোনীত মানুষদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়েছেন, তাদেরকে শক্তি-সামর্থ্য, ধন-সম্পদ, সিংহাসন দান করেছেন। কিন্তু তাদের উপর সভ্যতাকে ঠিক পথে পরিচালনা করার গুরুভারও প্রদান করেছেন। যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা প্রশংসিত হয়েছেন, আর যারা পারেনি তারা শাস্তি ভোগ করেছেন। সম্রাট নেবুচাঁদনেজারকেও আমি এই কথাটি বলেছিলাম, আফসোস তিনি তা আমলে নেন নি।”

“আপনি আমাকে কি করতে বলেন?”

“আপনি সম্রাট, আপনাকে উপদেশ দেবার ধৃষ্টতা আমার মানায় না। আমি অনুরোধ করব আপনার যা ভাল মনে হয় তা করবেন। অন্তত মানব জাতিকে সঠিক পথ দেখানোর চেষ্টা করুন। ”

কুরুশ হেসে বলল, “আপনি ভাল কূটনৈতিকও বটে। আমি আপনার কাছে একটা দাবি রাখতে চাই, আপনি আমার দরবারে পারিষদের পদ গ্রহণ করবেন। আপনার মত বয়োজ্যেষ্ঠ পারিষদ আমার কাজে লাগবে। এর বিনিময়ে ঈশ্বরের যদি আমার জন্য কোন অভিপ্রায় থাকে তা পালনের আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব, কি বলেন?”

দানিয়েল দাঁড়িয়ে কুরুশকে কুর্নিশ করে বের হয়ে গেলেন, “আপনার আদেশ শিরোধার্য, সম্রাট।”

দানিয়েল বের হয়ে যাবার পর রসিকতা করে কুরুশকে বললাম, “পৃথিবীর চার প্রান্তের বাদশা? হিব্রু পুরোহিত ভাল উপাধি দিয়েছেন। আমি অবশ্য তোমাকে অন্য একটা উপাধি দিব ভেবেছিলাম।”

“কি সেটা?”

“জুলকারনাইন।”

(চলবে)
প্রিন্স অফ পার্সিয়াঃ প্রথম অংশ প্রিন্স অফ পার্সিয়াঃ দ্বিতীয় অংশ জুলকারনাইনঃ প্রথম অংশ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×