(১)
রওনক শিকদারের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে শিকদার বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য। চারদিকে জমজমাট অবস্থা তবে শোকের ছায়া বিন্দুমাত্র নেই কোথাও, বরং উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে সবখানে ।
এক কথায় যাকে বলে হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার।
স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে এক বছরের চলমান গ্রুপিং লবিং,মনকষাকষি মিশ্রিত গুমোট পরিবেশ, কিছুটা হলেও চাপা পড়েছে আজ, নকল হাসিতে। ছদ্ম ভালোবাসা দিয়ে সবাই ব্যস্ত আছে নিজের ভাগটাকে একটু বাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাতে বা সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছাতে।
শুধুমাত্র ব্যতিক্রম কামরুন্নাহার । সুপ্রাচীন এই পরিবারটি এলাকার নামকরা যৌথ পরিবারের মধ্যে একটি এবং বেশ প্রভাবশালী।
এলাকার লোকদের ধারণা আজকের পর এই এত এত প্রভাব,দাপট বা সম্মান অনেকটাই বিলীন হয়ে যাবে শিকদার বাড়ির । এত বছরের ঐতিহ্য হারাবে এই পরিবারটি, বেশ কয়েকটি খন্ডে ভাগ হয়ে যাবে যা তাদের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে ভবিষ্যতে । কারণ তাদের অতীত রেকর্ড খুব একটা সুবিধার না। এটা নিয়ে এই পরিবারের সদস্যদের তেমন কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়েই ।
বিভেদের প্রাচীর তো উঠেছে অনেক আগেই,শুধু রওনক সাহেবের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি এতদিন ।আর সে কারণে রওনক শিকদারের মৃত্যুর পর পরই ভাঙনের খেলা শুরু হয়েছে জোরে সোরেই। নতুন পানির মাছের মতো খলবলিয়ে উঠছে কম বেশি সবাই। যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখার প্রধান শর্ত হচ্ছে স্বার্থত্যাগ আর পরিবারের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। যা আজকালকার মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।
আজকালকার যুগে অবশ্য তা আশা করাও বাতুলতা মাত্র। এখনকার যান্ত্রিক যুগে সবাই স্বার্থের শৃঙ্খলে বন্দী, কমবেশি সবাই চায় নিজের মত করে থাকতে।নিজের মত করে বাঁচতে। এই পরিবারের লোকজনও তার ব্যাতিক্রম নয়।
আর তাই এই বিশেষ দিনটি উপলক্ষে ঢাকা ও অন্যান্য শহর থেকে জমি জমার মালিকানা বুঝে নিতে তড়িৎ গতিতে প্রায় সকলে এসে পৌছেছে নিজের গরজেই।
এদিকে এ শহরে যারা আছে অর্থাৎ বাস করে, তাদের কাছে নিজের অংশের জমি জিরাত বিক্রি করে নগদে বিশ্বাসী বাইরে অবস্থানকারি প্রায় সকলেই,কেউ ফ্ল্যাট কিনতে চায়,কেউ ভালো ব্রান্ডের গাড়ী কিনতে আগ্রহী বা অন্যান্য ।আর এই কারণে তথাকথিত হাজার কাজ ফেলে ছুটে
এসেছে যার যার হিসাব মিলিয়ে নিতে, নিজের অংশটুকু পরিপূর্ণভাবে বুঝে নিতে।
কামরুন্নাহারই একমাত্র শরিক যার কোন রকম তৎপরতা চোখে পড়ছে না। কেনা বেচার প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই, নেই কোন দৌড় ঝাঁপ। তিনি এমনই একজন শরিক যার দাপট বা প্রতিপত্তি তেমন একটা নেই এ বাড়িতে বা সম্পত্তিতে, বুদ্ধির দৌড়েও তিনি পিছিয়ে।
তিনি রওনক সিকদারের ঔরস জাত সন্তান হয়েও কোথায় যেন সুক্ষ্ম তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার দেয়াল দিয়ে তার অধিকারকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সুচাতুরতার সাথে।
অসুস্থতার অজুহাতে তার অধিকার টুকুও কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে বারংবার।
কামরুন্নাহারের এসব নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। তিনি বরাবরই নিতান্ত সহজ সরল।নিজের মত করে থাকতেই ভালোবাসেন।
আর সে রওনক শিকদারের তৃতীয় পক্ষের একমাত্র ও শেষ সন্তানও বটে । তার মায়ের বংশ ততটা উন্নত নয় বলে তার স্বীকৃতিটাও কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা সবসময়ই হয়েছে এ বাড়িতে ।
তবে এ বাড়িতে তাঁর আশ্রয় মিলেছে এটাই তার সৌভাগ্য বলতে হবে। অন্তত এ বাড়িতে বয়োবৃদ্ধ সকলে তাই মনে করে। বাড়ির বড়রা তাকে যে চোখে দেখুক না কেন, বাড়ির ছোটদের সবার প্রিয় ফুফু সে।নাহার ফুফু। তার কাছেই যত আবদার বা বায়না সকলের। তিনিও মাতৃস্নেহে বাচ্চাদের হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসাতে কোন খাদ নেই নেই কোন স্বার্থ ।
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
ছবিঃ গুগোল
ফুটনোটঃ পরভৃত ১. /বিশেষণ পদ/ পরপুষ্ট, পরের দ্বারা প্রতিপালিত। ২. /বিশেষ্য পদ/ পরের দ্বারা প্রতিপালিত এইজন্য. কোকিল। /পর+ভৃত/। /বিশেষণ পদ/ স্ত্রীলিঙ্গ. পরভৃতা।
গল্পটি সাত পর্বে সমাপ্ত। আশা করি সবাইকে পাশে পাবো। শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:১০