somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি 'হাসব নাকি কাঁদব' বাস ভ্রমণ!!!!!

০১ লা জুন, ২০১৮ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সে অনেক দিন আগের কথা। যখন ফখরদ্দিন নামের এক রাজা এক অজানা রাজ্যের অপরাজনীতির কুশীলবদের মুরগিদৌড়ের উপর রেখেছিলেন। সেসময় চট্টগ্রাম টু নওগাঁ যাত্রা।

বাসের টিকিটের মহা সংকট। অনেক কষ্টে শাইন মামার সহায়তায় তিনজনের আমি, শোভন ও শাইন মামার টিকেটের ব্যবস্থা হল। হানিফ, শ্যামলীর কোন টিকিট না পাওয়ায় শাইন মামার ভাষায় মধ্যম মানের কেয়া পরিবহন। কে জানত এই কেয়া পরিবহন নামটা চিরজীবনের জন্য মনে স্থায়ী আসন নেবে?

সন্ধ্যা ৭টায় বাস ছাড়বে। অলংকার মোড়ের কাউন্টারে বসে আছি। ৮টা। বাস আসার কোন লক্ষণ নেই। অবশেষে মহারানী কেয়া ঢিমেতালে রাত্রি ৯টায় উনার নুয়ে পড়া, ক্ষয়ে যাওয়া অস্তমান যৌবন নিয়ে আমাদেরকে উনার ভেতরে প্রবেশের ছলনাময়ী আহবান জানালেন। আমরা এই তরুন বয়সে প্রৌঢ়ার সাদর আহবানে সাড়া দিব-কি-দিব-না এই নিয়ে কিঞ্চিত দ্বিধান্বিত ছিলাম। তারপরে যখন বুঝলাম এটাই আমাদের নিয়তি। কি আর করা! নিদারুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পড়লাম।

বয়সের ভারে ন্যূজ মহারানী কেয়া ছুটে চলেছে সীতাকুন্ডের মহাসড়ক ধরে। তার চলন দেখে যে কারো মনে হতে পারে কোন কারণে উনি ত্যাক্ত-বিরক্ত। মহাকাল যেন উনাকে গ্রাস করেছে। এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে পারলেই বুঝি উনার চিরশান্তি। আমরা যারা উনার ভিতরে নিজেদের সঁপে দিয়েছি তারা যারপর নাই বিরক্ত, উনার এই খামখেয়ালিতে। তাই ভিতর থেকে কেউ কেউ সহ্য করতে না পেরে ক্ষণে ক্ষণে খেঁকিয়ে উঠছে আচম্বিতে। এরপরে একটু উন্নতি হলেও কিছুক্ষণ পরে যে লাউ সেই কদু। তাই কোনপ্রকার হেঁসেলে না গিয়ে মচৎকার একটা ঘুম দেওয়ার পরিকল্পনা করে যেই না গা টা একটু এলিয়ে দিয়েছি, অমনি ফটাসসসসসসসসস, শশশশশশসশশ...কিড়িড়িড়িড়ততততত। ঠাস্ করে লাফিয়ে উঠলাম। মহারানীর কিছু হল নাকি!! :||

অবগত হলাম মহারানী একসাথে এতলোকের ভার সহ্য করতে না পেরে হাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। দিবেনই তো। বয়স হয়েছে। উনারও তো নেওয়ার একটা সীমা আছে নাকি। যৌবনে হয়তবা উনি এটা অনায়াসে পাড়ি দিতে পারতেন। আমাদের মনুষ্যকুলেরও একটু আক্কেল থাকা দরকার ছিল। সামান্য লাভের আশাই এই পড়ন্ত যৌবনেও উনাকে একটুও ছাড় দিতে নারাজ।

সীতাকুন্ডের পরে এক পেট্রল পাম্পে উনার সেবা শুশ্রুসার ব্যবস্থা করা হল। দুব্বল শরীল (গ্রামের ভাষায়)। ঘন্টা খানেক লাগল সেরে উঠতে। রাত প্রায় ১২টা। আবার আমাদের মহাকালের পথে যাত্রা শুরু হল। শীতের রাত। বাইরে কনকনে শীত। উনার ছিঁড়ে যাওয়া (পড়ুন জানালা) বস্ত্রের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ঘুম নামক মহা উপাদেয় বস্তুটাকে হীরের হরিণ বানিয়ে দিয়েছে। যা শুধু কল্পনায় পাওয়া যায়, বাস্তবে পাওয়ার আশা বৃথা। তাই বৃথা সে চেষ্টা করতে করতে মহারানীর সওয়ারি হয়ে ফেনী পার হয়ে কুমিল্লার দিকে ছুটে চলা কিংবা বিপরীত দিক থেকে আসা অল্পবয়সী রুপসীদের (পড়ুন নতুন বাস) চোখ-ধাঁধানো রুপ অবলোকন করতে লাগলাম।

আমি ও শোভন মাঝামাঝি বসা। শাইন মামা সামনের দিকে। শোভন জানালার পাশে মনে হচ্ছে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। বাইরে কুঁয়াশা খুব একটা নেই। রাত্রির শেষ প্রহর। হঠাৎ সামনের জানালাটা একটু ফাঁক হল এবং বাইরে আধা-তরল জাতীয় কিছু একটা ফেলে দেওয়া হল। ঠান্ডা হিম বাতাসে আমরাসহ পিছনের লোকজন হৈ হৈ করে উঠলাম। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে জানালার পাশে বসা শোভন আধো-ঘুমে থাকা অবস্থায় বলল,'উমমম...দোস্ত, দেখত মুখে নরম এগুলো কি পড়ল'। আমিও টের পেলাম আমার জ্যাকেটের কাঁধে, চোখমুখেও অতি অল্প পরিমাণে কিছুর আভাস। তাৎক্ষণিকভাবে টের পেলাম 'ইহা তাহাই (হলুদ জাতীয় পদার্থ তবে সোনা নয় :-P !!!) যাহার উপস্থিতিতে মনুষ্যপ্রকৃতির নাকের অভিনয় প্রতিভা বিকশিত হয়'। আমাদের তখন অবস্থা 'ইহা কি হইল? এমনতো কথা ছিল না'। :( :( :((

বাংগালীরা অতি অল্প সময়েই ঠিকঠাক বুঝে নেয় চারপাশের বিপথ। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটে নি। চারিদিকে (আমাদের সিট থেকে পিছন দিকে) হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল। যেন হাওড়ে মাছ ধরা উৎসবে আধা মণের বোয়াল মাছ ধরা পড়েছে। এদিকে জানালা বন্ধ থাকায় পিছনের দিকের গুমোট পরিবেশটা শীতের ভারী বাতাসের সাথে কটূ গন্ধের মিশ্রণে এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি। লোকজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের চরম অবনমন। কেউ কেউ এই গন্ধের বাড়াবাড়ী রকম কারবারিতে টিকতে না পেরে পিছন থেকে উঠে গিয়ে সামনে ইঞ্জিন কাভারে গাদাগাদি করে বসে পড়েছে। কেউবা আবার সামনের আসনগুলোর পাশে দাড়িয়ে আছে। আমাদের অবস্থা তথৈচব। আমারাও টিকতে না পেরে শাইন মামার আসনের পাশে দাড়িয়ে গেলাম।

হৈ চৈ এর মাঝে দেখি বাসের সুপারভাইজার এয়ার ফ্রেশনার নিয়ে পেছনে যাচ্ছে আর বলছে 'এটা দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে'। আমি মামাকে বললাম 'দেখেন এই ফ্রেশনার পাঁচ মিনিটও টিকতে পারবে না'। শাইন মামাও বলল 'এবার ঠিক হয়ে যাবে'। আমি মামাকে বললাম 'পুকুরে বড় বোয়াল মাছ থাকলে যতই পোনা মাছ ছাড়ো না কেন নিমেষেই ঐ ব্যাটা তা সাবাড় করে দেবে। এখানে পিছনে বোয়াল মাছ অপেক্ষা করছে। ফ্রেশনার দিয়ে আসুক। কয়েক মিনিটও টিকবে না'। যা ভাবা তাই। যারা এয়ার ফ্রেশনারের পেছনে পেছনে নিজেদের সিটে বসতে গিয়েছিল। একটু পরেই বিড়বিড় করতে করতে উঠে আসছে। আমি মামার দিকে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিলাম।

এদিকে ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছে মহারানী। ভোরের সূর্যও আড়মোড়া ভেংগে কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঠার পাঁয়তারা শুরু করেছে। আমরা হচ্ছি সবচেয়ে বড় ভুক্তভুগি। ঢাকা পৌঁছানোর অপেক্ষা করছি। ধোয়া-মোছা করে শরীরটাকে যদি একটু ঐ অবাস্তব পরিবেশ থেকে টেনে বের করা যায়। ও দিকে কিছু লোকজন বিশেষ করে মহিলারা বমি-টমি করে একাকার অবস্থা। এক মহিলাকে বলতে শুনলাম 'খোদার গজব নেমে এসেছে এ বাসে। এ আমাকে কি আজাবে ফেললে হে পরোয়ারদেগার'।

কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। কেউই এই পরিবেশের জন্য দায়ী মাঝবয়সী মহিলাকে গালাগালি করছে না। কারণ উনি সত্যিই খুবই অসুস্থ। অসহায় হয়েই এই বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছেন।

তবে অনেকে মহারানীর এই শম্ভুক গতি ও চালকের অবিমৃষ্যকারীতার জন্যই বেশি সোচ্চার। যার জন্য এত দেরী হচ্ছে। বাচ্চাসহ এক মহিলাকে দেখছি খুব বেদনাবিধুর কন্ঠে ফোনে কাকে যেন অভিযোগ দিচ্ছে 'দুনিয়াতে এই খাটাস বাসটি ছাড়া আর কোন বাস ছিল না'। ক্লান্ত-শ্রান্ত । মুখদিয়ে জোরছে কথাও আসছে না। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না উনি কেন এই বাসটাকে ‘খাটাস’ বাস বললেন? অবস্থার প্যাঁচে পড়ে ভাষাও গিট্টু লেগে গেছে মনে হয়!!

অবশেষে বেলা দুইটাই ঢুলতে ঢুলতে মহারানী কেয়া নওগাঁ সদরে পৌঁছিলেন। আমরাও এই সতের ঘন্টার মহাযাত্রার পরিসমাপ্তিতে যারপরনাই আপ্লুত হলাম। আর শাইন মামাকে বললাম 'কেয়া রানীর এক চিমটি পায়ের (চাকার) ধুলা নেন। এই গর্বিত যাত্রার সহযাত্রী কিনা আমরা'। উনি স্বভাবসুলভ হাসিতে প্রতিউত্তরে বললেন 'জামাই (উনার মেয়ে...বুকিং ;) !!!) কি যে বল?

#এবারে ঈদের যাত্রায় মনে হচ্ছে চম্পা-চামেলী-কেয়া রানীর সওয়ারিদের ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। রাস্তার যে খবর পাচ্ছি তাতে গজবে হামেরিয়া না নামলেই হয়। :(

@শুভ হোক সকলের যাত্রা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩২
৪৯টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×