"When a man steals your wife, there is no better revenge than to let him keep her."--Sacha Guitry
হাওড়ে বহুবছর বাদে হঠাৎ দেড় মণ ওজনের বাঘা আইড় ধরা পড়লে মানুষ যেমন দেখার জন্য পঙ্গপালের মতো উষ্ঠাউষ্ঠি করে, ঠিক তেমনি আমাকে দেখার জন্য হাসপাতালেও একই অবস্থা। সেটা আমি স্পেশালভাবে বানানো ঢাকা মেডিকেলের কেবিনে শুয়েও টের পাচ্ছি। দেশের সব কয়টি টিভি চ্যানেলে আমাকে লাইভ দেখাচ্ছে কিংবা দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিখ্যাত সংগীত শিল্পী কলিজা খান আমাকে নিয়ে নাকি ইতিমধ্যে গান বেঁধে ফেলেছে। সেই গান কখগ রেডিওর মাধ্যমে সারাদেশে নাকি ভীষণ হিট। এদিকে শুনলাম সাতাত্তর টিভি আমাকে নিয়ে এর মধ্যেই হৃদয়বিদারক আর্ট ফিল্ম বানিয়ে ফেলেছে। দেশের সঙ্গীত শিল্পী-রেডিও-টিভি চ্যানেলগুলোর এই করুণ অবস্থা দেখে এই কষ্টের মাঝেও হাসি পেল আমার। বহুদিন পর তাদের টিআরপি বাড়ানোর সুযোগ এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। দেশে না হলে বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। উনি নিয়মিতই হোমড়াচোমড়াদের জন্য এই নীতি চালু রেখেছেন। আমিও তাহলে জনগণ থেকে বের হয়ে ঐ বিশেষ কাতারে সামিল হলাম। যদিও টাকা আমার জন্য সমস্যা না। বরং সমস্যা এখন জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা সেখানে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে আর কি! নানাজন নানা মত দিচ্ছে কীভাবে এ অবস্থা থেকে আমার মুক্তি মিলবে।
শুধু ভাবছি আর ভাবছি! নায়লা কীভাবে পারল আমার উপর এইরকম ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিতে? আমি ঘুনাক্ষরেও একটিবারের জন্যে টের পাই নি। পেলে কি এই জীবন-মরণ অবস্থায় পড়তে হয়? তিরিশ বসন্ত পার না হতেই ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার দশা! যদিও ডাক্তারেরা বলছে এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারি, তবে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে সে জন্য। তো আসুন, শুনি কি ধরনের প্রতিশোধ নিল নায়লা আমার উপর।
২
নায়লা আমার বউ। একতরফা ভালোবাসার বউ। অবশ্য এখন আর নেই। বউয়ের সামনে ‘সাবেক’ শব্দটি জুড়ে গেছে। খবর পেয়েছি পাখি উড়ে অষ্ট্রেলিয়াতে মানিকের ডেরায় হাজির হয়েছে। সাত বছর সংসার করার পর ঘন্টি বাজিয়ে চলে গেল। আমার অবশ্য আক্ষেপ করাও মানায় না। যে অপরাধ করেছিলাম তার সাজা তো পেতে হবে। অথচ এই সাতটা বছর মনে হয়েছে কী স্বর্গ সুখেই না ছিলাম? নায়লার ব্যবহারে কখনও এতটুকু বোঝার উপায় ছিল না কি কঠিন প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে সে আমার উপর।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় নায়লা ছিল আমাদের তিন বছরের জুনিয়র। আর মানিক ছিল আমার বুজম বন্ধু। মেধাবী মানিক বরাবর প্রেমের ব্যাপারে অপদার্থ গোছের হলেও পদার্থবিদ্যাতে সবসময়ই টপার হিসেবে থাকত। গোপনে গোপনে অনেকে তাকে পছন্দ করলেও ওর ঐ গোমড়ামুখো স্বভাবের কারণে কেউ প্রেম করার সাহস করত না। আমরা তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় নায়লা প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। অসম্ভব সুন্দরী এই মেয়ে ডিপার্টমেন্ট তথা গোটা ক্যাম্পাসে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল রূপের জৌলুসে। আমি আবার কিছুটা ‘হেই ড্যুড’ টাইপের ছিলাম। নায়লাকে দেখার পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি বিয়ে যদি কখনও করি একেই করব। যদিও আমি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সাথে পুরোপুরি জড়িত নয়। বরং বাপের অঢেল টাকার সুবাধে ক্যাম্পাসে 'হাতেম তাঈ' উপাধি পেয়েছি। মানিক আবার আমার জিগারের দোস্ত। সেই আমার পড়াশুনার নোটপত্র সরবরাহকারী।
মানিকের এই নোটপত্র পরের জেনারেশনরাও গ্রোগ্রাসে গিলত। ফলে রমণীমহলে ওর একটা বিশেষ অবস্থান ছিল। সেই সূত্র ধরেই নায়লাও মানিকের কাছাকাছি চলে আসে। তবে সেটা যে এতটা কাছাকাছি তা কেবল আমার ভালোবাসা প্রকাশ করার দিন বুঝতে পারি। আর হতাশ হয়ে তখনই মনে মনে ষড়যন্ত্রের বীজটা বুনে ফেলি।
৩
মানিক ছিল গ্রামের এক অতি সাধারন ঘরের ছেলে। বাড়ি থেকে ঠিকমত টাকা পাঠাতে পারত না ওর বাবা। আমিই ওকে অনেকবার টাকা দিয়েছি। নায়লাও মফস্বল শহর থেকে পড়তে আসা।
পাশ করে বের হয়েই বাবাকে নানা উপায়ে বুঝিয়ে দিলাম যে ছেলে নালায়েক হয়ে গেছে। ছেড়ে দেওয়া পাঁঠার মতো যার-তার ক্ষেতে মুখ দেওয়ার চেয়ে স্থায়ী একটি ফসল ঘরে তুললে কেমন হয়? বাবা-মা খুশি হল। তাদের একমাত্র পোলা বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করেছে। এরপর পাত্রীর সন্ধান দিলাম। নায়লা তখন সবেমাত্র তৃতীয় বর্ষে উঠেছে।
বিয়ের এন্তেজাম পাঠানো হল ওদের বাসায়। নায়লা এ কথা জানার পর আমার সাথে ভীষণ রাগারাগি। এদিকে মানিক তখন সদ্য পাশ করা বেকার। এই সুযোগটাই আমি সুকৌশলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। জানি, শীঘ্রই ও চাকরি পেয়ে যাবে। আর তখন আমার জোরটাও কমে যাবে। আমি তখন দেশের অন্যতম বড় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর। আমার পরিবারের ইতিহাস জেনে নায়লার পরিবার সটান খাড়া কন্যা সম্প্রদানে। কিন্তু নায়লা বসেছে বেঁকে।
একদিন মানিক আমাকে ডেকে হু হু করে কান্না। কাকুতি মিনতি। ওরা দুজন-দুজনে দিওয়ানা। ফিল্মি ডায়লগ দিচ্ছিল একে অপরকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না। এগুলো শুনে আমার হাসি পাচ্ছিল। যে যাই বলুক আমার সোনার হরিণ চাই। আমি জানি মানিকের বেশি কিছু করার সামর্থ নেই। এখন ও টিউশনি করে নিজে চলে আবার দেশের বাড়িতে টাকা পাঠায়। ওর পক্ষে নায়লাকে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব না। আর সে ঐ মাপের সাহসী ছেলেও নয়।
শেষে মাস দুয়েক কচলাকচলির পর নায়লা বিয়ে করতে বাধ্য হয়। বাসররাতে আমি ‘সোনাবউ’ বলে ডাকতেই নায়লা দাঁত চিবিয়ে বলেছিল, ‘তুমি যে ক্ষতিটা আমার করলে এর জন্য একদিন তোমাকে পস্তাতে হবে। আমি এমন প্রতিশোধ নিব, এমনই প্রতিশোধ নিব যে তুমি বিন্দু পরিমাণ টের পাবে না কোথা থেকে কি ঘটে গেল। এরপর ঠিকই আমি মানিকের সাথেই ঘর করব। ও আমার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ওকে তো তুমি চিন’।
এটা ঠিক। মানিক যে ধরণের ছেলে, পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে নায়লা উপস্থিত হলেও খুশিতে বগল বাজাতে বাজাতে মাগুর মাছ কিনতে বাজারে যাবে। যেন বউ রাগ করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে? এই ছেলেগুলো এত ভালো হয় কেন?
তবে নায়লার ঐ হুমকী শুনে আমি মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ‘সে দেখা যাবে ক্ষণ! এখন না হয় তুমি আমার পিতল বউ হয়েই থাকলে। আস্তে আস্তে ঠিকই সোনাতে পরিনত হবে’।
হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘ভ্রমণ করে তুমি ক্লান্ত! আজকে ঘুমাও। আমার কোনো জোর জবরদস্তি নাই বাসররাতে বিলাই মারার চেষ্টাতে। তুমি আমার পাশে শুয়ে আছ, এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি সারাজীবন পার করে দিতে পারি’। বলে আমি ওর গালটা একটু টিপে দিয়েছিলাম। আর নায়লা গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে উঠে ঝামটা দিয়ে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়েছিল।
আমি জানি আমার টাট্টু ঘোড়া ঠিকই একদিন পোষ মানবে। অপেক্ষা ও ধৈর্য। এই দুটি শব্দ এখন আমার ভীষণ প্রিয়। পরের দিন দেখি নায়লা মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছে। আমার সাথেও মুখে হাসি নিয়ে কথা বলছে। আমি একটু অবাক এবং অবশ্যই বিস্মিত হলাম!
৪
কিছুদিন পর জানতে পারলাম মানিক বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। যাক, কাছের আপদটা বিদায় হল তাহলে। আমার এই স্বার্থপর চিন্তার কথা শুনে নায়লার কোনো প্রকার ভাবলেশ ছিল না।
নায়লাও পিতল বউ থেকে সোনাবউতে রূপান্তরিত হয়েছে। পড়াশুনার পাশাপাশি বেশ ভালো রান্না-বান্না শিখেছে। স্যোসাল মিডিয়াতে রীতিমত সেলিব্রেটি রান্না-স্পেশালিস্ট হিসেবে।
আমি অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে আসি সোনাবউয়ের সাথে কুট্টুসকাট্টুস করার জন্য। বাসায় নানা পদের বাহারী রান্নায় ভরপুর থাকত। নায়লার আমার প্রতি এই টান আমি মারাত্মক উপভোগ করতাম। ভীষণ সুখের সংসার ছিল আমাদের।
দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে ও নানা প্রকার খাবারের রেসিপি শিখে আসত। সেই আইটেম রেঁধে খাওয়াত। ওর ইউটিউবে বেশ জনপ্রিয় একটি রান্নার চ্যানেলও রয়েছে । নানা পদের রান্নার বাহার। আমি হচ্ছি ওর প্রধান ভোক্তা। এত যত্ন করে ও আমাকে খাওয়াত ভাবাই যায় না। যে মেয়ে এত ভালোবাসা নিয়ে আমার যত্ন নিত, সেই মেয়ে কীভাবে এরকম প্রতিশোধ নিতে পারল।
কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত রান্না করত? গরু-খাসি-মুরগীর চর্বি দিয়েই হরেক রকমের পদ। স্পেশাল রেসিপি খাসির চর্বির সাথে আফ্রিকান মাগুরের দোঁপিয়াজো। মুরগীর চর্বি দিয়ে মালাইকারী। ওফ, কি স্বাদ! আসলে নায়লাকে এত বেশি ভালোবাসতাম যে সব খাবারকেই অমৃত মনে হত! নায়লা পরম ভালোবাসায় এগুলো রান্না করত। এত ভালোবাসা তার প্রিয় মানুষটির জন্য। অথচ সেই ভালোবাসাকে কিনা...। হতভাগা আমি। বুঝি নি! কিছুই বুঝি নি!
এভাবে একদিন আমি সমাজে ভোজনরসিক উপাধি পেয়ে গেলাম। গত সাতটা বছর ধরে এভাবে খেয়েই যাচ্ছি। খেয়েই যাচ্ছি। গত কয়েক বছর থেকে ঘর থেকেও বের হই না।
এভাবে সাত বছর পর আমার ওজন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কেজিতে। আমিই এখন দেশের সবচেয়ে মোটামানুষ। তিন দিন আগে আমাকে গুহা মানে বাসা থেকে জানালা কেটে ক্রেন দিয়ে টেনে বের করে এই হাসপাতালে...।
নির্লিপ্ত ও বিষন্ন ভঙ্গিতে মুঠোফোনের খুদেবার্তাটির দিকে তাকিয়ে আছি। ‘এসব কিছুই সুপরিকল্পিত, ডিয়ার হিপ্পো অয়নবাবু'।
কৌতূহলী তথ্যমন্ত্রীকে ইঁদুরের মতো উঁকি দিতে দেখলাম। সাথে বাইরে টিআরপিওয়ালাদের হুলুস্থুল হট্টগোল।
.
.
.
পুনশ্চ- মানিকেরা কি বাস্তবে এতটাই ভালো মানুষ? আমিও লক্ষ রাখছি অষ্ট্রেলিয়াতে পরবর্তী…! হায়রে ভালোবাসা!
************************************************************************************
আখেনাটেন/২০১৯
ছবি: অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৪১