-ওয়াও এমেঝিং…হোয়াট অ্যা……
সাহারার বুকে বালির ঢিবি বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে লাল টকটকে সূর্য্যি কাকু রাগী একটি ভাব নিয়ে উঠার পাঁয়তারা করছে। ঐ দৃশ্য দেখে দুই কোরিয়ান রূপবতীর উচ্ছসিত ভাব প্রকাশে লি (জোনাথন লি) ও আমি মুগ্ধ হয়ে কাকুরে বাদ দিয়ে কাকুর ভাতিজিদের দেখছি। বহুদিন পরে পুরান বান্ধবীরে দেখে যেমন ‘সখী গো’ বলে মেয়েরা মোচড়ামুচড়ি করে এদের অবস্থাও দেখছি সেরকম। চারিদিকে থৈ থৈ বালু। লি আমার কানে কানে জানালো, সে মূত্র বিসর্জন করার জায়গার খোঁজে জরাজীর্ণ দোকান ঘরটার পেছনদিকে যাচ্ছে। আমিও কানে কানেই বললাম, দেখে ঢালিস, ওদিকে দেড় জোড়া নেফেরতিতির খুড়তুতো বোনকে যেতে দেখলাম। লি আমার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রওয়ানা হলো বিসর্জনে।
ইতোমধ্যেই দুই রূপবতীর একজন কাছে এসে, আমার আর জরিনার দুটা ফটো খিঁচে দিত রে কুদ্দুইস্যা, বলে ঠাস করে ক্যামেরাটা আমার হাতে গুঁজে দিল। গৌড়ের ফ্যারাও-এর বয়স এতটা বেশি নয় যে ‘না’ বলার মতো বুকের...। মাগুর মাছের ন্যায় একটি হাসি দিয়ে ডিএসএলআরে লাল কাকাকে পিছে রেখে গ্যাংনাম স্টাইলে কাকুর ভাতিজিদের সাহারার বুকে ছবি খিঁচে দিলাম। এর কয়েক মিনিট পরে আবার রওয়ানা হলাম কাকুর আরেক ভাতিজি নেফেরতিতিরে মোলাকাত করতে আবু সিম্বলে।
সাহারার বুকে লাল কাকুকে দেখার জন্য মোচড়ামুচড়ি নীলের বুকে এভাবেই জটাধরেরা গলাগলি করে বসবাস করছে
২
জোনাথন লি। সিঙ্গাপুরিয়ান। উইন্টার ভেকেশনে সোলো ট্রাভেলার হিসেবে এই ডিসেম্বরে মিশর সফর করছে। কায়রো থেকে আসওয়ান যাত্রা পথে ট্রেনে ওর সাথে পরিচয়। এরপর ‘যেখানে রাত, সেখানেই কাত’ বিবেচনায় কায়রোর বাইরে আসা আমরা আসওয়ানে মোটামুটি মাথা গোঁজার মতো এক হোটেলে উঠেছি। আগে হোটেল বুক না করায় হুলুস্থুল বিপদ। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া, লুক্সরে অবশ্য বুকিং ডট কমেই ভরসা ছিল। মিশরের শেষ প্রান্তে সুদানের দিকের এই শহর আসওয়ানে ইচ্ছে করেই হোটেল বুক করা ছিল না। ধারণা ছিল ঐ তপ্ত সাহারার বালুতে মুখ গোজার জন্য আর কতইবা আমাদের মতো বেয়াক্কল যাবে। কিন্তু গিয়েই টের পেলুম...দুনিয়াই বেক্কলের সংখ্যা ঊর্ধবমুখি...মাঝারি মানের হোটেলগুলোতে একটা রুমও খালি নেই। ফলে চান্দি ছিলা ইউছেপ কাকার হোটেলেই ঠাঁই নিতে হলো। সেটাও ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রুম খালি হওয়া সাপেক্ষে। হোটেলে গিজগিজ অবস্থা। এই পক্ষী-হাগা (কবুতর) বিগত যৌবনা হোটেলে সাদা-বাদামী-কালো চেহারার বৈদেশিদের দেখে টাস্কিই খেলাম। ডিসেম্বরের এই সময়টা বৈদেশী পর্যটকের খাউজানি-দৌড়ানি মিশরে মনে হয় চরমমাত্রায় পৌঁছায়। কারণ বছরের অন্য সময় সাহারার মাথা আউলানো রাগ-ভৈরবী।
একপাশে বালুর পাহাড়...নীলের বুকে ফেলুক্কা... আসওয়ানে একদল ভারতীয় পর্যটকের সাথে দূর থেকে মোলাকাত...নৌকাতে...দেখেই চিনে ফেলেছে...এরপর হৈ হৈ...
এদিকে দুপুরের ছুটি নেয়ার পালা। পেটের ভেতরে হাঙ্গরেরা ভীষণ ঢোল পেটাচ্ছে। পাশের এক রেস্তরাঁ থেকে তোহোমা কিনে এনে সকলে গ্রোগ্রাসে গিল্লাম। এই তোহোমা ওদের অন্যতম প্রধান খাবারও বলা চলে। ভেটকি মাছের মতো পেটমোটা ফুলানো তন্দুরি রুটির--মেশিনে বানানো--ভেতরে বেগুন ভাজি, ডিম, ফ্রেঞ্জ ফ্রাই, চিকেন ইত্যাদি পুরে স্যান্ডউইচ স্টাইলে খাওয়া। রুটিগুলো ফটাফট মেশিনে বানাচ্ছে। বানিয়েরা গাচ্ছে। খাচ্ছে। অন্যরা নিয়ে যাচ্ছে।
নেফেরতিতির ভিলেইনাস খুড়তুতো ভাই আইসিসের মন্দিরের প্রবেশ মুখ
মাঝ বিকেলে হোটেলের ম্যানেজার ইউছেপ কাকা একটি প্রাগৈতিহাসিক ট্যাক্সি ঠিক করে দিল। ঘটাং ঘটাং স্টাইলে ছুটলাম দেখতে টেম্পল অব ফিলে। নীল নদের পানি আসওয়ানে এতটাই স্বচ্ছ যে নদীর অনেক গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। রাস্তার ডান পাশে নীল নদের পাড় ধরে ছুটে চলছে পঙ্খিরাজ। নদীর মাঝের দ্বীপে হাজার বছরের এলিফেন্টাইন পার্ক সাথে ফাইভ স্টার হোটেল। নীলের বুকে ঐতিহ্যবাহী ফেলুক্কা মানে পাল তোলা নৌকা। একপাড়ে সারি সারি খেজুর গাছ। একদিকে সাহারা মরুভূমির লক্ষ বছর ধরে সিনা টান টান করে দন্ডায়মান বালির পাহাড়। মাঝদিয়ে ত্রস্ত হরিণের মোহনীয় রূপ নিয়ে ছুটে চলেছে অপরূপ নীল। এক মায়াময় দৃশ্য। কেন লোকজন এসব জায়গায় ছুটে আসে অনুমান করা যায়।
টেম্পল অব ফিলের একপাশে হেলে যাওয়া লাল কাকুর রাগী অভিব্যক্তি টেম্পলের ভেতরে হাজার বছরের পুরান এই সব লেখাজোকাওয়ালা পিলার টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে
বিশ্বখ্যাত আসওয়ান ড্যাম দেখে ফেরার পথে টেম্পল অব ফিলে দেখতে গেলাম। সারাদিন তেতে থাকা লাল কাকা ততক্ষণে বিছানাপত্র বিছিয়ে শোয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এই কয়েক হাজার বছরের পুরাতন মন্দিরটি লো-ড্যাম ও হাই-ড্যাম এর মাঝখানের লেকের ভিতর অবস্থিত। প্রায় কিলো খানেক নৌকা বেয়ে সেখানে যেতে হয়। টিকিট কেটে নৌকা ঠিক করতে গিয়ে ফ্যারাও এর খুড়তুতো ভাইয়েরা আমাদের পকেট থেকে বাড়তি পাউন্ড খসানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকাতে বেচারারা হাল ছেড়ে দিয়েছে। নৌকা ভাড়া ১৫০ মিশরীয় পাউন্ড রিজার্ভ। কিন্তু এক দালাল জনপ্রতি ১৫০ পাউন্ড খসার ধান্ধা করেছিল। যাহোক, হেলে যাওয়া সূর্যের মিঠা আলোর মাঝেই প্রায় জনমানবশূন্য টেম্পলে পৌছালাম। অথচ এই জায়গায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পর্যটকে গিজগিজ করে স্থানীয়দের মুখেই শুনলাম। কারণ প্যাকেজ ট্যুর গ্রুপগুলো ঐ সময়েই দাপাদাপি করে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ট্রাভেলার হওয়ার এই এক সুবিধা। নিজের ইচ্ছে মতো ঘোরা যায়।
নেফেরতিতির টেম্পলের ভেতরে দেয়ালে নানা আঁকিজুকি... নেফেরতিতির সাথে মোলাকাতের আবেগঘন দৃশ্য...
দেবী আইসিসের মন্দির। মন্দিরের ইতিহাস দেয়ালের গায়ে লিপিবদ্ধ। হাজার হাজার বছর ধরে লিখে রেখেছে মিশরীয় আর্টিজনেরা। বিস্ময়কর অঙ্কন। কয়েক হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতার অন্যতম আদি নিদর্শন নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও এই মন্দিরটা আগে অন্য জায়গায় ছিল। কিন্তু ড্যাম তৈরি করার সময়ে স্থানান্তর করে এই উঁচু দ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে। সেও এক প্রযুক্তির অভিনব কাজ।
টেম্পল অব ফিলে থেকে আসার পথে নৌকা ঘাটে গেটের বাইরে সারি সারি দোকান। সন্ধ্যা হওয়ায় দোকানিরা আজকের মতো ঝাঁপি বন্ধের এন্তেজামে ব্যস্ত। মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোককে কৌতূহলী চোখে তাকানো দেখে সালাম দিলাম। আলাপ হল। তাদের জীবিকার উৎস এই টুরিস্ট। মাঝে আরব স্প্রিং ও এর পরের কয়েকবছর তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। এখন আবার কিছুটা গতি ফিরছে। আসওয়ান বা এই এলাকাতে খেজুর চাষ ও কিছু গম, সবজি-ফলমূল বাদে কিছু হয় না। চারিদিকে ধূ ধূ সাহারার হাঁ নিশ্বাস। ভদ্রলোককে বৃষ্টি-বাদলের কথা জিজ্ঞেস করায় বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে চেয়েছিল। জানালো চার বছর আগে একবার পলকা বৃষ্টি হয়েছিল। এবার আমি দেড় মণি বাঘা আইড়ের মতো হাঁ করে চেয়েছিলাম। ভাবা যায়। আকাশে মেঘ নেই। বছরের পর বছর এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। বছরের বেশির ভাগ সময় ৪০ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা। এভাবেও প্রায় বিশ লাখ মানুষ এই শহরে টিকে আছে শুধুই নীলের উপর ভরসা করে। এজন্যই নীলকে বলা হয় মিশরের ধমনি।
আমি উনার সাথে মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করতেই উনি জানালেন এ বিষয়ে উনি কিছু জানেন না। এ পর্যন্তু মিশরে যে কয়েকজন লোককে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি, কেউই উত্তর দিতে রাজি হয় নি। খালি মনে হয়েছে, এমন দমবন্ধ পরিবেশে দশকের পর দশক কীভাবে ইনারা…? এ কারণে মাঝে মাঝে মিশরে জনবিস্ফোরণ দেখি তাহরির স্কয়ারে। অর্থাৎ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তাঁরা মাঠে নামে। আবারও সেই ভয়ের সংস্কৃতি...।
মরুভূমির বুকে নাসের লেকের স্বচ্ছ পানি... সন্ধ্যায় পৃথিবীর প্রাচীনতম ভিলেজের অন্যতম নুবিয়ান ভিলেজে যাত্রা
৩
টেম্পল থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে দ্রুতই শুয়ে পড়লাম। ইতোমধ্যে ২৮০ কিলোমিটার দূরের আবু সিম্বলে টেম্পল অব আবু সিম্বল ও টেম্পল অব নেফেরতিতি দেখতে যাওয়ার বন্দোবস্ত পাকা। এখানেই সেই দুই সুন্দরী কোরিয়ান এসে হাজির। মানে মাইক্রোবাস ভাড়া করে শেষ রাতে রওয়ানা হয়ে সকালে আবু সিম্বল পৌঁছানো। আবার ঘন্টা তিনেক সেখানে অবস্থান করে পুনরায় ফিরে আসা বিকেলের মধ্যে। সাহারার বুক চিরে এই যাত্রা। রাত পৌনে চারটায় রওয়ানা হলাম। সকাল আটটার মধ্যে পৌছানোর লক্ষ্য। আর সেই যাত্রাপথেই গ্যাংনাম কন্যাদ্বয়ের সাথে আলাপচারিতা। দুজনে মিলেই এবছর মাসাধিক কাল ধরে মিশর চষে বেড়ানোর প্লান নিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। মাইক্রোবাসে আরও এক ভদ্রলোক ছিল। ইউরোপীয়ান মনে হয়। পরিচয়ও হয় নি। মাইক্রোবাসে উঠেই দে ঘুম। আসার পথেও ঘুম। ব্যাটা কুম্ভকর্ণ। মাঝে টেম্পল দেখেছে কিনা সেটাও জানি না। মনে মনে ভাবলুম, এ কি মিশরে ঘুমানোর জন্য এসেছে নাকি!
আবু সিম্বলে যাত্রাপত্রে সেই দুই কোরিয়ান রূপবতীর সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা হল। তাদের মুখে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা। বিশেষ করে, বাংলাদেশের একজনের নাম বলেছিল (মনে পড়ছে না) ভদ্রলোক নাকি কোরিয়াতে সিনেমায় অভিনয় করে।
থাকা খাওয়ার খরচ কম হওয়াতে অসংখ্য পর্যটকে মিশর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস গমগম করে। বিকেলে ফিরেই একটু গড়াগড়ি করে সন্ধ্যার আগে নীল নদের পানিতে উষ্ঠাউষ্ঠি করার জন্য গেলাম। সন্ধ্যায় একটি নৌকা ভাড়া করে পাঁচ কিলোমিটার উজানে হাজার বছরের পুরান নুবিয়ান ভিলেজ দর্শন।
সভ্যতার আদিতম এই ভিলেজে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে উমাইর ভাইয়ের ডিঙ্গিতে ডিং ডং ‘ইয়া হাবিবি’ আরবী গানের তালে তালে শহরে ফিরেই নুবিয়ানদের উত্তরপুরুষদের দেখার জন্য বের হয়ে গেলাম।
নেক্সট সকালেই ট্রেনে চেপে লুক্সরের পথে যাত্রা। সেখানে বৃহত্তম ও প্রাচীনতম কারনাক টেম্পল কমপ্লেক্স ও ভ্যালি অব কিংসে ফ্যারাও তথা ফেরাউনদের বিস্তির্ণ এলাকার পাহাড় কেটে শতমিটার গভীরে হাজারো বছর ধরে কীভাবে মণি-মাণিক্যসহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেটা চাক্ষুষ করতে………!!!
টেম্পল অব ফিলের পাশে দন্ডায়মান ট্রজান'স কিয়স্ক বা ফ্যারাও'স বেড সাহারার বুকে লাল কাকুর তেড়ে আসার দৃশ্য...
**************************************************মিশর নিয়ে আরো পড়তে চাইলে...
@আলেকজান্দ্রিয়া কড়চাঃ ক্লিউপেট্রা যেখানে হেঁটেছিল…!!!
@নেফারতিতির দেশেঃ মিশরের পিরামিডের বালুভূমিতে !!!
********************************************************************
আখেনাটেন/জুন-২০২১
ছবি: লেখক
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২১ রাত ১১:১১