গতপরশু ইউটিউবে ধর্মীয় উগ্রতা নিয়ে ভারতের দুজন নামকরা বুদ্ধিজীবীর এক বিশ্লেষণমূলক ভিডিও দেখে তাতে একটি আঁতেলীয় মন্তব্য করলাম। যেহেতু ভারতীয় চ্যানেল, সেখানে ভারতের নানাধরণের মানুষের নানামুখি আলোচনা। একটি উগ্রতাকে (ছাত্রভাই বা তালেবান) ব্যাখ্যা করতে, আরেকটি উগ্র গোষ্ঠীর (রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক বা আরএসএস) উল্লম্ফনে রীতিমত কুরুক্ষেত্র। মন্তব্যে যেহেতু দুই উগ্র গোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনার কঠিনভাবে দ্বিমত পোষন করেছি। আর যাই কোথায়। পান্ডব ও কৌরব যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে একত্রে চেপে ধরেছে। দুই বিলাইকে ঝগড়ারত অবস্থায় গায়ের উপর পানি ছিটিয়ে দিলে নাকি মহামারামারিতে রূপ নেয়। এখানে আমার মন্তব্য পানির কাজ করেছে, তবে তা নিজেদের মধ্যে নয়...আমি কেন মন্ত্রপূত পানি ছিটিয়ে দুই দলের মসৃন ও ত্যালত্যালে ব্যাটলফিল্ড কর্দমাক্ত করলাম? তাই আমাকেই...পালিয়ে বাঁচলুম? কুরুক্ষেত্র থেকে পশ্চাদ্দেশের চামড়া সহিসালামতে বজায় রেখে পশ্চাদপসরণ করলেও এখন দেখছি দুইপক্ষের বাণে সামান্য কিছু সংখ্যাক খোলা আকাশের উদারতা নিয়ে আত্নাহুতি দেয়ার জন্য আমার পক্ষ হয়ে লড়ে চলেছে। কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা?
এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যনীয় যে, এই সামাজিক মাধ্যমগুলো কীভাবে হিউম্যান সাইকিকে প্যারানয়েড করে দিচ্ছে দিনকে দিন তা যেন ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত! আগে শুধু পরিবার ও সমাজ থেকেই এই ভয়ঙ্কর বীজ বপন হত। এখন এটার গ্লোবালাইজেশন ঘটছে সামাজিকতার ভার্চুয়াল আচ্ছাদনে। এক তালেবানী মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা ভারতসহ বিশ্বের কয়েক কোটি লোককে আরো বেশি ইসলামবিদ্বেষী করে তুলছে। প্রতিক্রিয়ায়, আরএসএস/জায়নিস্ট/পশ্চিমা হেইট স্পিচ গোষ্ঠীর উগ্র কর্মকান্ড বিশ্বের কয়েক কোটি মুসলিমকে আরো বেশি অন্যধর্মবিদ্বেষী করে গড়ে তুলছে। এ যেন ‘ভিসাস সার্কেল’।
এইসব উগ্রতার মাঝে সেইন ভাবনার মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত টপাটপ পটল তুলছে টিকতে না পেরে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও বলতে গেলে অসহায়। কারণ জনমতের উপরই গণতান্ত্রিক সরকারগুলো প্রতিষ্ঠিত, সেই জনমত ‘উগ্র নাকি সৌম্য’ তা রাষ্ট্র নামের বিমূর্ত এনটিটি জানার কথাও নয় (তাই বলে বাংলাদেশের মতো উচ্চমার্গীয় গণতন্ত্র এখানে বিবেচ্য নয়?)।
২
হিউম্যান সাইকির একটি বড় গুণ(!) হচ্ছে নিজের প্রোথিত মতামতকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনায় নিয়ে অন্যকেও তা মন্ত্রপাঠ করানো। গুটিকয়েক মহামানব বাদে আমরা কেউই এর বাইরে নেই। এ যেন নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্রিডের হর্স বিবেচনায় নিয়ে (যদিও আদতে খচ্চর!) অন্য সকল ব্রিডকে নিজের দলভুক্ত করা। না চাইলে লাথথি গুতো কিংবা ধাক্কাইতে ধাক্কাইতে স্বর্গ দেখাতে চাওয়া। এখানে ‘তোমরা’ ও ‘আমরা’ গোষ্ঠী ভালো ও মন্দের ফারাকের চেয়ে নিজেদের মতকেই অধিষ্ঠান করার জন্য সর্বসব শক্তিতে নিয়োজিত।
কিন্তু আমরা ভাবি না, যে চিন্তায় সমাজের অসহিষ্ণুতা কমবে; যে ভাবনায় মানুষের জীবনযাত্রার সামষ্ঠিক উন্নতি ঘটবে; যে কর্মকান্ডে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে বেগ পেতে হবে না; যে ধারণায় সমাজের কূপমূণ্ডুকতা দূর হবে; যে বিশ্বাস সমাজ ও জাতির দুষ্টুক্ষতগুলো দূরীভূত করে এক সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের পাথেয় হবে, সে সকল চিন্তা, ভাবনা, কর্মকান্ড, ধারণা ও বিশ্বাস যেন কর্পূরের মতো উবে যেতে বসেছে সমাজ থেকে।
অশ্বডিম্ব সদৃশ চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব, কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বাস্তবে আমাদের যে আরো অধিক নিম্নস্তরের মনুষ্যগোষ্ঠীতে পরিণত করছে তা ভেবে বের করার মতো মেধা বা প্রজ্ঞাও অবশিষ্ট নেই। কারণ মেধা, মনন, প্রজ্ঞা কিংবা জ্ঞান অর্জনের জন্যেও আপনাকে পড়তে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। আর এই পড়া, জানা, বুঝার জন্যও দরকার একটি অতি উদারনৈতিক বিস্তৃত বিশাল খোলা আকাশের মতো মন। আর এই খোলা আকাশসম মনটার বীজ বপন হবে পরিবারে। এখন একটি প্রশ্ন, আমাদের পরিবারগুলো কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা কী এই ধরনের বীজ সরবরাহ করছে জাতির মাঝে? উত্তর সকলের জানা।
আর এই কারণেই আমরা শিক্ষিত হচ্ছি দুভাবে: সুশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত। এই কুশিক্ষিত দল এখন ডেসটিনির ডান-বাম হাতের মতোই চক্রাকারে বাড়ছে। এর প্রতিফলন হিসেবেই দেখছি সামাজিক মাধ্যমে অসামাজিক রেসলিং-এর ক্যারিকেচার। আর এর ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে এরা ভার্চুয়াল রেসলিং থেকে মাঝে মাঝেই বাস্তবের দুনিয়াতেও তার বাস্তব প্রতিবিম্ব প্রতিষ্ঠা করছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে প্রতিনিয়ত! এ থেকে মুক্তির পথ কী হতে পারে…?
******************************************************************
আখেনাটেন-সেপ্টেম্বর/২০২১
ছবি: pexels.com
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৩৭