অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন ভালোবাসাবাসিতে ব্যাকরণেও যে বুৎপত্তি থাকতে হত সেটা কে জানত? একদিন জানালার গরাদে মুখটা শক্ত করে লাগিয়ে গলি ধরে হন্টনরত নীলাকে ইব্লিসি হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ‘নিলটু মণি, তুই অনেক বিদোষী ও মিষ্টি’। একটু পরেই নীলার মা-ফুফুর বিরাট চিৎকারসহ পাড়ামাত। এ পক্ষে কম কীসে? মুষলধারে হাউকাউ চলছে। বর্ষণ শেষে হোম মিনিস্টার আমার রূমে এসে কান ইলাস্টিকের মতো করে টেনে ধরে, ‘বদের ছাও বদ, এখনই ইভটিজিং এ নাম ল্যাখাইসিস। তোর কলজা-গুদ্দা যদি পিষে ছাতু না বানাইচি…’?
আমি নাকি নীলাকে বলেছি, ‘হাঁটা চলায় বড্ড দোষী ও খাইস্টি’। আমি জানাই ওটা বড্ড দোষী নয় বিদোষী (আসলে বিদুষী-পন্ডিত মেয়ে)। বেগম রোকেয়ার একটি রচনা পড়ে ভুলভাল মেরে দিয়েছিলাম মনে হয়।
নীলা। পাশের বাসার করিম চাচার স্কুল পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে। আমি এসএসসির ফাঁড়া কাটাতে যাচ্ছি। দুই পরিবারে বাড়ির সীমানাপ্রাচীরসহ নানা ইস্যুতে গলাবাজি ও ঘেউঘেউ একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমি সাক্ষীগোপাল হরিদাস পাল। রূপবতী নীলা ও আমার সম্পর্কও টম অ্যান্ড জেরি পর্যায়ের।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা। মাথায় প্রচুর উকুন হওয়ায় বাবা-মা-আপা মিলে মৈত্রিজোট করে ন্যাড়া করে দিয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে নতুন জ্বালা। প্রতিদিন নীলা আমার রূমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, ‘ওহে নাড়ু, মাথায় ত্যাল দিছিস’। প্রথম প্রথম কিছু মনে হয় নি। কিন্তু দিনে দশ-বিশবার ‘ওহে নাড়ু, মাথায় ত্যাল দিছিস’ শুনতে শুনতে মেজাজ তিরিক্ষিতে উন্মুক্ত চান্দি এখন এমনিতে ত্যালত্যালে হয়ে উঠছে। মশার গুনগুনানির মতো ‘ওহে নাড়ু, মাথায় ত্যাল দিছিস’, ‘ওহে নাড়ু, মাথায় ত্যাল দিছিস’ ২৪/৭ বেজেই চলেছে।
একমাত্র মুক্তির উপায় হিসেবে একদিন চাচাতো ভাই রাসেলকে বললাম, ‘এই রাসেইল্লা, নীলাকে একটা প্রেমপত্র লিখব’। শুনেই রাসেইল্লা ঝাঁপ দিয়ে খাট থেকে নেমে, ‘আমারে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে, পাড়ায় গজব নেমে আসবে ধরা পড়লে। চাচা-চাচী জানতে পারলে হামানদিস্তাতে যেমন সুপারী ভাঙে আমাদের ঐরকম সুপারী ছেঁচা...’। ওর উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছে, কদিন আগে লাদেন্না যেমন বিমান-বোমা মেরে টুইন টাওয়ার ফেলছে, আমিও তেমন চিঠি-বোমা মেরে করিম চাচার বাড়ি উড়ানোর ব্যবস্থা করছি।
বললাম, ‘আরে ধুর পাগল, প্রেমে এত ডরলে চলে নাকি’-আমার দিলখোলা প্রতিউত্তর। রাসেইল্লা অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে, হামানদিস্তায় সুপারী ছেঁচাটা এক্সাক্টলি কোন সময় থেকে শুরু হবে?
২
শেষে ঠিক হল কিছু ফুলের সাথে একটি চিঠি। মফস্বল টাউন। ফুল পাওয়া মুশকিল। অবশেষে বাসার পেছনে জঙ্গলের মতো জায়গাতে সাদা সাদা বাঁশির মতো রূপবতী জংলী ফুলগুলিকে বেছে নিলাম।
এরপর মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখলাম,
‘ডিয়ার নীলাবতী,
আমাকে তুই ছারপোকার মতোই বড্ড জ্বালাস। টিপে মারতে গিয়েও কোলবালিশের চিপায় সযতনে রেখে দেই। পাগলী, প্রেম করবি? মিষ্টি ফুল পাঠালাম। ফুলের রসে মজা পেলে আমাকে জানাস?
ইতি তোর নাড়ু’।
রাতের খাওয়া সেরে রাসেইল্লাকে দিয়ে ফুল ও চিঠি নীলার জানালা গলে ভেতরে ফেলে দিয়েই দুজনেই বহুদিন পর পড়াশুনায় কঠিন মনোযোগী হলাম। রাত দশটার দিকে বাসার মেইন গেটের কাছে তুমুল হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। টুকরো টুকরো কিছু কথা ‘ধুতরা’, ‘ফুলের রস’, ‘পাগলী’ কানে ঢুকছে। গুটি গুটি পায়ে কাছে গিয়ে যা শুনলাম তাতে প্রথমেই মনে হল ‘খিঁচে একটা পাগলা দৌড় দিয়ে বাড়ি থেকে সোজা আসামের কামুক্ষ্যাতে গিয়ে সন্নাসীর জীবন যাপন করি’। কারণ সম্ভাব্য বিপদ থেকে মুক্তির ওটাই একমাত্র রাস্তা। মানে হচ্ছে, নীলার মা’র অভিযোগ আমরা নাকি উনার মেয়েকে ষড়যন্ত্র করে ধুতরা ফুলের রস খাইয়ে পাগলী বানাতে চাই। তাই সুপরিকল্পিতভাবে আমার বাবা-মা ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছেন উনার মেয়ের পেছনে। একবিংশ শতাব্দীতে কোনো প্রেমিকের বিপক্ষে মনে হয় ঐটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিযোগ!
আমি উনাদের যতই বুঝায় ওটা যে ধুতরা ফুল তা তো আমি জানতাম না। আর ধুতরা ফুলের যে এত মাজেজা তাই-বা এই বয়সে ক্যামনে জানব? এখানে একটি স্থুল কারচুপি হয়েছে। আর আমার তো ওকে বাস্তবে পাগলী বানানো উদ্দেশ্য নয়, প্রেমের পাগলী বানানো…। কে শোনে কার কথা? রাতে বিনা সতর্ক সংকেতে শতমাইল বেগে ‘আইলা’ বয়ে গেল।
পরের দিন গিরায় গিরায় ব্যথা নিয়ে বিছানায় শুয়ে কোঁকাচ্ছি। জানালার কাছে এসে নীলা জিহ্বাটা বের করে সাপের মতো নাড়াতে নাড়াতে, ‘ঠিক হয়েছে, ত্যালকা নাড়ু, আমাকে ধুতরার রস খাইয়ে পাগলী বানাবে। ক্যামন মজা। হি হি!!’।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘ওরে পাষাণী, ওরে বাটপাড়, তুই শুধু ধুতরার রসের ঐ খারাপ দিকটাই দেখতে পেলি। ঐ রসের ভেতর যে একজনের প্রথম ভালোবাসার রসও সঞ্চিত ছিল তা তোর চোখ ও মন দেখতে পেল না। আপসোস। নিঠুর দুনিয়া রে’?
কিন্তু খেঁকিয়ে উঠে মুখে বললাম, ‘দূর হ এখন চউক্ষের সামনে থেকে শয়তানের শয়তানী মালেকা হামেরিয়া!’। বলেই কোলবালিশের চিপায় লুকিয়ে থেকে কুটকুট করে কামড়ানো ছারপোকাটার গলা টিপে ধরলাম! দফারফা!!
*****************************************************
***পরিবর্ধিত, পরিশোধিত, পুন:পরিকল্পিত ও পুন:পরিবেশিত!
*****************************************************
©আখেনাটেন-জুলাই/২০২২
ছবি: এখানে
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০২২ দুপুর ১:৫১