ইন্দোনেশিয়া সিরিজ - ১ঃ মেদানের পথে পথে
আমার অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা লেক টোবা (Lake Toba) দেখার। এর মূল কারণ মানব জাতির গত পঁচাত্তর হাজার বছরের ইতিহাসে এই লেক খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পৃথিবীর বিশেষত পূর্ব আফ্রিকা ও ভারতের সব মানুষের বর্তমান জিনেটিক প্যাটার্ণের পিছনে লেক টোবার ভূমিকা অনস্বীকার্য। Toba catastrophe theory অনুসারে এই লেকের কারণে মানবজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে বসেছিল। কারণ এই প্রায় পঁচাত্তর হাজার বছর আগে এই লেকটি একটি আগ্নেয়গিরি ছিল যেটা বিস্ফোরিত হয়ে পুরো পৃথিনীতে এমন অবস্থা তৈরি করেছিল যে মানবজাতির জন্য তা এক বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিভাবে একটা লেক মানবজাতিকে পুরো বিলুপ্ত করে দেয়ার উপক্রম করেছিল? কিভাবে বিজ্ঞানীরা একটার পর একটা সূত্র জোড়া দিয়ে Toba catastrophe theory তৈরি করেছেন সেটার গল্প কোন রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনীর চেয়ে কম উত্তেজনাপূর্ণ না। সে গল্পে পরে আসছি।
মেদান শহর থেকে লেক টোবা প্রায় একশত কিলোমিটার দূরে। তাই ভাবলাম, মেদান যখন আসছি তখন লেক টোবাও দেখে যাই। একদিন সকালে মেদান লেক টোবার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। যাবার পথেই পড়বে বেরাস্তাগি শহর। যদিও এটাকে শহর না বলে ছোট টাউন বা গ্রামের মাঝামাঝি কিছু একটা বলা যায়। আমার সেখানেও একটু ঢু মারার ইচ্ছা। কারণ, এই শহরের মূল আকর্ষণ দুটো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি যাদের একটার নাম মাউন্ট সিবায়েক আর আরেকটার নাম মাউন্ট সিনাবুং। কপাল ভালো থাকলে একটু দূর থেকে ধোঁয়া-ফোঁয়া দেখে আসব। তাছাড়া, বেরেস্তাগি শহর আগ্নেয়গিরির পাশে হওয়ার কারণে এর মাটি খুবই উর্বর হওয়ার কথা। তাই এই এলাকা ফুলে-ফলে শোভিত হওয়াটা স্বাভাবিক।
ডাচেরা বেরাস্তাগি শহরের পত্তন করেছিল উনিশ শতকের প্রথমভাগে। এই শহরের নামটাও এসেছে ডাচ শব্দ “ব্রাস্তাগি” থেকে যার মানে “চালের গুদাম”। যদিও এই শহরে এসে চালের গুদাম নামের কোন স্বার্থকতা পাইনি। এই শহরের নাম হওয়া উচিত ছিল “ফল আর ফুলের গুদাম”।
বেরাস্তাগি শহর সেই অর্থে আহামরি না হলেও নিরিবিলি। শহরের প্রবেশদ্বারে লম্বা তোরণ যেটা শহরের ইতিহাস অনেকটাই তুলে ঘরছে। তবে মূল শহরটা যথারীতি ছোট আর ঘনবসতিপূর্ণ। সরু সরু রাস্তার পাশে ঘিঞ্জি দোকানপাট। তারপরে বেশ শান্ত গ্রামের মত জায়গা। এতই শান্ত যে গাছ থেকে পাতা পড়লেও তার শব্দ শোনা যায়। শহরের দিগন্ত ছুঁয়ে আছে মাউন্ট সিবায়েক আর মাউন্ট সিনাবুং। আর অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় আর টিলা। এসবের ফাঁকে-ফাঁকে ছোট ছোট জনবসতি। আমার এমন জায়গাই ভালো লাগে।
মেদান থেকে বেরাস্তাগির দূরত্ব প্রায় পয়ষট্টি কিলোমিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেরাস্তাগির উচ্চতা এক কিলোমিটারের বেশি। তাই আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। পাহাড়ি রাস্তা, তাই মেদান থেকে গাড়িতে বেরাস্তাগিতে পৌছাতে প্রায় ঘন্টাখানিক সময় লাগবেই। মেদান থেকে রওয়ানা দিয়েছি বেশ সকালে। তাই দুপুরের বেশ আগেই বেরাস্তাগিতে পৌছে গেলাম।
আমার কপাল ভালো। শহরে ঢুকার সাথে সাথে একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখলাম। ধোঁয়া তখনো আকাশময় ছড়িয়ে পড়েনি। হয়ত আমি আসার কিছুক্ষণ আগেই আমাকে স্বাগত জানানোর জন্যই মাউন্ট সিনাবুং জেগে উঠেছে।
আমার হাতে যেহেতু অঢেল সময়, আমি বেরেস্তাগির মূল শহর পার হয়ে গ্রামের মত জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি।
চারিদিকে স্ট্রবেরি আর ফুলের বাগান। ফুলের নার্সারির অভাব নেই। এমন কিছু ফুল যেগুলো দেখতে একেবারেই অন্যরকম আর কোনদিন ওরকম ফুল দেখিনি। সে সময় আমার ফুল গাছের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। কুয়ালালামপুরের বাসাতে অনেক রকমের অর্কিড, গোলাপ আর গারবেরা ডেইজির গাছ ছিল। যদি ইমিগ্রেশনের ঝামেলা না থাকত থাকলে একটা আস্ত নার্সারি কিনে নিয়ে কুয়ালালামপুর ফিরে আসতাম।
স্ট্রবেরি বাগানগুলোতে নিজের পছন্দমত স্ট্রবেরি গাছ থেকে পেড়ে কিনে নেয়া যায়। দাম খুব সস্তা আর স্ট্রবেরিগুলো বেশ টসটসে রসালো। বেরাস্তাগিতে এত বেশি ফল-মূল হয় যে এখানে শুধু ফলের জন্যই আলাদা বাজার আছে যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে ফল-মূল কিনতে।
পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে ঘোড়ার প্রচলন ছিল এক সময়। তাই শহরে রয়েছে ঘোড়ার খামার। সেখানে সস্তাতে মেলে ঘোড়ার দুধ।
সত্যি কথা বলতে কি আমার শহরের চেয়ে গ্রামের মত জায়গা বেশি ভালো লাগে ঘোরাঘুরির জন্য। কারণ, সব বড় শহরগুলো একই রকম। ব্যস্ত রাজপথ, সুউচ্চ অট্টালিকা আর হাঁস-ফাঁস জীবন। অন্যদিকে রেরাস্তাগির মত গ্রামগুলো শান্ত, নির্জন। অনেক বই আর অলস দুপুরগুলোতে চা দিয়ে এমন গ্রামে নিজেকে হারিয়ে দেয়া যেতেই পার। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য সবারই এমন জায়গায় কিছুদিন থাকা উচিত।
***
---চলবে---
ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানতে ও দেখতে আমার চ্যানেলগুলোতে চোখ রাখতে পারেন।
ফেসবুকঃ দেশে বিদেশে ট্রাভেলিং
ইউটিউবঃ লিটল ট্রাভেল
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:২৪