গোয়া এসে যেদিন পানজির হতে মিরামার রেসিডেন্সি’তে এসেছিলাম; সেদিন ট্যাক্সি করেই এসেছি। কিন্তু তিনদিন গোয়ায় কাটিয়ে দেখেছি এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এর সার্ভিসও বেশ ভাল। তাইতো, গোয়া হতে মুম্বাই যাওয়ার দিন রাতের বেলা হোটেল এর রিসিপশন হতে লাগেজ নিয়ে আমরা মিরামার রেসিডেন্সি’র গেইট হতেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পেয়ে গেলাম লোকাল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। লাগেজসহ উঠে গেলাম, ডবল সিটে লাগেজ সমেত বসে দশ রুপি জনপ্রতি ভাড়া দিয়ে মিরামার থেকে চলে এলাম পানজির বাস স্ট্যান্ড এলাকায়। এখান হতেই আমাদের বাস জার্নি শুরু হতে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে। গোয়া এসে আমরা প্রথমে উঠেছলাম পানজির এ অবস্থিত গোয়া ট্যুরিজম এর পানজির রেসিডেন্সি’তে। কিন্তু এখানে রুম খালি না পেয়ে আমরা এখানকার ম্যানেজার ইনচার্জ এর সহযোগীতায় গোয়া ট্যুরিজম এরই মিরামারস্থ রিসোর্ট “মিরামার রেসিডেন্সি”তে তিনদিনের আবাস নিশ্চিত করেছিলাম পানজির এ বসেই। সাথে ভদ্রলোক তার রিসিপশন এ বসিয়েই করে দিয়েছিলেন গোয়া হতে মুম্বাইগামী ভল্ভো বাসের টিকেট।
তো আমরা পানজির বাস স্ট্যান্ড এসে আমাদের বাস খুঁজে পেতে যথেষ্ট হয়রানির শিকার হলাম বলা যায়। ভারতের ইন্টারসিটি বাসগুলো খুঁজে পেতে আসলেই খুব ঝামেলা হয়। তখন তো অভিজ্ঞতা ছিল না, পরে দেখেছি; প্রায় সকল রুটেই বাসগুলো নির্দিষ্ট কোন স্থান হতে যাত্রী তোলে; যেখানে নেই কোন বাস কাউন্টার; নেই কোন ডেস্ক বা সাহায্যকারী কেউ। আমাদের বাংলাদেশে আমরা বাসের কাউন্টার হতেই গাড়ীতে উঠতে অভ্যস্ত বলেই কি না; ভারতের ইন্টারসিটি বাসে উঠতে আমি সবসময়ই অস্বস্তি বোধ করি। গোয়া হতে মুম্বাই জার্নির পর উটি, ব্যাঙ্গালোর, কোদাইকানাল, পুরি, ধর্মশালা, ডালহৌসি সহ নানান রুটে জার্নি করেছি; প্রতি বারই বাসে উঠতে গিয়ে আমাদের দেশের মত কাউন্টার খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। যাই হোক, গোয়ার সেই ঘটনায় ফিরে যাই।
গোয়ার পানজিরের সেই মুম্বাই-গোয়া বাস স্ট্যান্ড এ গিয়ে আমাদের বাস টিকেট এর রিসিট বের করে বাসের নাম খুঁজে পেতে পড়লাম ঝামেলায়। কিছুই বুঝতে না পেরে আশেপাশের যাকেই জিজ্ঞাসা করি কেউ বলতে পারে না। শেষে একটু দূরে দেখি কন্ডাক্টার এর উর্দি পরিহিত এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে; আমার ভ্রমণ সঙ্গী রনী’কে পাঠালাম তার কাছে খোঁজ করতে। একটু পরেই সে রাগত ভঙ্গীতে গালাগাল করতে করতে আমাদের কাছে ফিরে এল। ঘটনা হল, সেই লোককে যখন জিজ্ঞাসা করল, রিসিট দেখিয়ে, আমাদের বাসটি কোনটি বা কোথা হতে ছাড়বে কিছু বলতে পারে কি না? ভদ্রলোক নাকি রাগত স্বরে বলেছেন, “পাড়িলিক্ষি নাহি আতি? ইধার লিক্ষা হ্যায় না, ধুনধলো...”
বেশ কিছু সময় খোঁজাখুঁজি করে আমরা অবশেষে খুঁজে পেলাম আমাদের বাসটি। গোয়া এসে পানজির রেসিডেন্সির ম্যানেজারের হেল্পফুলনেস এ যে গুড ইম্প্রেশন তৈরী হয়েছিল গোয়া সম্পর্কে; নিমিষেই তা উবে গেল। কিন্তু সামনে যে আরও ভোগান্তি বাকী, তা কি জানা ছিল? সারারাত বাস জার্নি করে গোয়া হতে মুম্বাই এসে পৌঁছে নামলাম দাদার স্টেশন এর কাছে। সবাইকে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি লাগেজ রেখে বের হলাম হোটেল এর খোঁজ করতে। মাত্র একরাত থাকবো মুম্বাই; আর গোয়ায় ছিলাম দুই রাত। তাই কেরালার নয়দিনের ট্রিপের জন্য হোটেল, গাড়ী সব ঢাকা থেকে বুক করে এলেও মুম্বাই-গোয়া’র জন্য আবাসন ঠিক করে আসি নাই। গোয়াতেও খুব সহজেই হোটেল পেয়ে গেছি বলে মুম্বাই নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না।
যাই হোক সবাইকে বসিয়ে আমি হাঁটা শুরু করতেই এক দালাল এই ভোরবেলাই আমার পিছু নিল। আমি যতই তাকে বলি, আমার কোন সাহায্যের দরকার নাই; সে পিছু পিছু হাঁটতেই থাকলো। একবার বিরক্ত হয়ে কিছু বলতেই সে বলল, “আমি তোমার পিছু হাঁটছি না; রাস্তা আছে, আমি হাঁটছি, তোমার সমস্যা কি?” কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, এ ব্যাটা হল আঠা টাইপ পাবলিক, সহজে পিছু ছাড়বে না। আর আমিও কয়েকটি হোটেলে ঢুকে ব্যর্থ হয়ে বের হয়ে এসেছি, রুম না পেয়ে। কারন, তাদের নাকি ফরেন গেস্ট রাখার পারমিশান নেই, বিশেষ করে বাংলাদেশী নাগরিক!
হ্যাঁ, আমি সেই সময়টার কথাই বলছি, যখন খেলা কাভার করতে কিছু বাংলাদেশী সাংবাদিক মুম্বাই গিয়ে হোটেল না পেয়ে স্টেশনে রাত কাটিয়েছিলেন। আসলে মুম্বাই এর হোটেলওয়ালাদের কোন দোষ নাই; দোষ আমাদের; আমরা আগে হতে মুম্বাই এর হোটেল রুম পাওয়ার ঝামেলা সম্পর্কে অবগত না হয়েই মুম্বাই গিয়েছিলাম। মুম্বাই এর তাজ হোটেলে হামলার পর থেকে মুম্বাই এর সিকিউরিটি নিয়ে মহারাষ্ট্র পুলিশ বেশ কিছু উদ্দ্যোগ নিয়েছিল। তার একটি ছিল হোটেল-মোটেলে বিদেশী পর্যটক রাখার উপর বিধিনিষেধ। এমনিতেও ভারতে কোন হোটেলে কোন বিদেশী পর্যটক থাকলে, হোটেল কর্তৃপক্ষকে “সি ফরম” পূরণ করে নিকটবর্তী থানায় রিপোর্ট করতে হয়; যা কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ প্রসিডিউর এবং সকল হোটেল এর এই বিদেশী পর্যটক রাখার অনুমতিও নাই। আবার অনেক হোটেলের থাকলেও; অতিরিক্ত ঝামেলার জন্য এড়িয়ে যায়। আর পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ বেশ কিছু দেশের নাগরিকদের জন্য রয়েছে বিশেষ নজরদারি মহারাষ্ট্র পুলিশের। ফলে সেখানে হোটেল পেতে ঝামেলা হয়। এজন্য অনেকে কটু কথা বলে থাকেন; কিন্তু আমি এর কোন দোষ দেখি না। আপনার বাড়ির সিকিউরিটির জন্য আপনি ডবল তালা, কেচি গেইট, সিসি ক্যামেরা অনেক কিছুই লাগাতে পারেন; এটা আপনার এখতিয়ার, আপনার স্বাধীনতা; আপনার বাসা-বাড়ি’র নিরাপত্তা বিধানের জন্য আপনি যে কোন উদ্যোগ নিতেই পারেন। তা কারও পছন্দ হোক বা না হোক। তাই মহারাষ্ট্র পুলিশ নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে এমনটা করতেই পারে। একজন ভিনদেশী পর্যটকের উচিত কোন দেশের কোন এলাকায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সে এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি, নিয়মকানুন সবকিছু অবগত হয়েই উক্ত এলাকায় ভ্রমণ এ যাওয়া।
এরপর সেই দালাল নিয়ে গেল বেশ কয়েকটি হোটেল এ। এর মধ্যে যে হোটেল পছন্দ হল, সেখানে এডভান্স করে রুম নেয়ার সময় ডকুমেন্টস সিগনেচার করার সময় হুট করে রিসিপশন থেকে জানালো, ‘তারা কোন বাংলাদেশী নাগরিক রাখতে পারবে না!”। এবার আসলেই মেজাজ গরম হয়ে গেল; কেননা প্রথমেই আমি বলেছি যে, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। মেজাজ খারাপ করে বের হয়ে এলাম, আমার সাথে সেই দালালও। এবার সে আর আমার পিছু পিছু হাটলো না; আমি আমার দলের কাছে ফিরে গেলাম। তাদের সাথে কথা বলছি, এমন সময় বিপরীত দিকের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে হাত ইশারায় ডাকছে দেখলাম। আমি রাস্তা পেরিয়ে তার কাছে গিয়ে “ক্যায়া হুয়া” বলতেই সে জানালো, সেও মুসলমান। সকালবেলা আমরা নামার পর থেকেই দেখেছে আমাদের। আমরা ঐ এলাকায় হোটেল পাব না বলেও জানালো। কোথায় পাব, জিজ্ঞাসা করতে বলল, গ্রান্ড রোডের হোটেল শালিমার এ পেতে পারি। তার গাড়ী করে ডবল ভাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছলাম; যদিও সে পুরো রাস্তা সে বলতে লাগলো, আমাদের কাছ থেকে সে অনেক কম ভাড়া রেখেছে। কিন্তু বিকেলবেলাই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম উনি আমাদের থেকে কত কম নিয়েছেন...
নানান ভোগান্তি শেষে কেরালা-গোয়ার আনন্দদায়ক ভ্রমণ শেষে মুম্বাই এ এসে ব্যাগপত্তর রাখার ঠাই পেলাম। হোটেল শালিমার এ দেখলাম বহু মুসলিম এবং বাঙ্গালী লোক আছে। কিন্তু এখানেও যে ব্যবহার পেলাম, তা পছন্দ হল না। আমাদের সাথে একজন মেয়ে গেস্ট ছিল, তার রুম দিল উপরের ফ্লোরে। সবাই ফ্রেশ হয়ে আমাদের রুমে বসে প্ল্যান করছিলাম আজ এবং আগামীকাল; এই দুদিনে মুম্বাই কিভাবে ঘুরবো তা নিয়ে। হঠাৎ হোটেল বয় এসে বলল, “ম্যাডাম, আপনি আপনার রুমে যান”!!! আমি অবাক, কেন কি হয়েছে? সে বলল, না উনি এই রুমে আসতে পারবেন না; আর আপনারাও উনার রুমে যেতে পারবেন না। হাসবো না কাঁদবো? গেলাম রিসিপশনে, কি সমস্যা? জিজ্ঞাসা করতে বলল, না এটাই আমাদের হোটেলের রুলস... দাঁতে দাঁত কামড়ে কিছু বললাম না। বিগত তেরদিন ধরে কতগুলো হোটেলে ছিলাম, সব জায়গাতে স্পেশাল খাতির পেয়ে অভ্যস্ত আমরা বেশ আপসেট হলাম এহেন পরিস্থিতিতে। তারপরও মেনে নিলাম, এক রাত দুই দিনের মাত্র ব্যাপার। কোন মত পার করে দেয়া যাবে। এরপর যে যে যার যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়লাম মুম্বাই দর্শনে। সেই গল্পে আসছি আগামী পর্বে।
আগের ভারত ভ্রমণের সিরিজগুলোঃ
কাশ্মীর ভ্রমণ সিরিজ-২০১৫
দিল্লি-সিমলা-মানালি সিরিজ-২০১৫
কেরালা ভ্রমণ সিরিজ-২০১৬
গোয়া ভ্রমণ সিরিজ-২০১৬
কম খরচে ভারত ভ্রমণ সিরিজঃ
কম খরচে ভারত ভ্রমণ - প্ল্যান ইউথ বাজেট ডিটেইলস সিরিজ
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৪৩