somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বালাপুর জমিদার বাড়ি - নরসিংদী (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২৩)

১৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০২১ সালের শেষ দিনে আমরা কয়েকজন বন্ধু স্বপরিবারে গিয়েছিলাম আড়াইহাজার বেড়াতে, উদ্দেশ্য রাতে বারবিকিউ আর আড্ডা; সকালে সর্ষের মাঝে ভূত খোঁজা, ;) থুক্কু সর্ষে ক্ষেতে ভ্রমণ। বেলা এগারোটা নাগাদ সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও আমি রয়ে যাই আশেপাশের কিছু জমিদার বাড়ি দর্শনের উদ্দেশ্যে। আগের এক পর্বে বলেছিলাম সদাসদী জমিদার বাড়ীর গল্প। আজ চলুন ঘুরে দেখি বালাপুর জমিদার বাড়ি।

ব্লগার সাদা মনের মানুষ, কামাল ভাইয়ের বাড়ি নরসিংদী। বন্ধু মনার মাধ্যমে জানতে পারলেন আমি আছি নরসিংদী। ফোন করলেন দেখা করতে। দুপুরের পর বিকেলবেলা কামাল ভাইয়ের গাড়ী নিয়ে তুহিন ভাই সহ বের হলাম দুটি জমিদার বাড়ি দেখতে। তার একটি ছিলো বালাপুর জমিদার বাড়ি। শেষ বিকেলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখে যথারীতি হতাস হতে হলো। জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে দুঃখ হয়, কিভাবে অবহেলায় এসব নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।

কামাল ভাইয়ের সাথে "সাতগ্রাম জমিদার বাড়ি" হতে ফেরার সময় জানলাম মাধবদীতেই আছে আরেকটা জমিদার বাড়ী, নাম "বালাপুর জমিদার বাড়ী"। সূর্যাস্ত'র আধঘণ্টা মত বাকী ছিল। কামাল ভাই এর ড্রাইভিং এবং রুট পরিচিত হওয়ার কল্যাণে সন্ধ্যা হওয়ার মিনিট দশেক আগে গিয়ে পৌঁছলাম বালাপুর। কিন্তু বিধিবাম, ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ একেবারে শুন্য... বিকেলবেলা কামাল ভাইয়ের অফিসে মোবাইল চার্জ দিলেও ক্যামেরার ব্যাটারির কথা মনে ছিলো না। তো কি আর করার, লো রেজুলেশন এর মোবাইল ক্যামেরা দিয়েই কিছু ছবি তুলে নিলাম।

নরসিংদীর শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, শান্ত গ্রাম বালাপুর। এই গ্রামের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন নিদর্শন— বালাপুর জমিদার বাড়ি। চারপাশে সবুজ ফসলের মাঠ, পুরনো গাছপালা আর গ্রামের মায়াময় নিস্তব্ধতার মধ্যে এই বাড়িটি যেন ইতিহাসের এক নির্বাক প্রহরী— সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।



বালাপুর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বাবু নবীনচন্দ্র সাহা। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয় তা জানা যায়নি। প্রায় ৩২০ বিঘা জমির উপর এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এখানে একটি একতলা ভবন, একটি দোতালা ভবন ও একটি তিনতলা ভবন তৈরি করা হয়েছিল যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাবু নবীনচন্দ্র ছিলেন সংস্কৃতিমনা। সন্ধ্যা নামলেই জমিদার বাড়িতে প্রতিদিন ডাক ঢোলের বাজনা বাজা শুরু হত। বিভিন্ন ধরনের নাটক, পালা গানসহ আরো অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে তারা তাদের জমিজমা মন্দিরের নামে উইল করে দিয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যান।

৩২০ বিঘা জমির উপর একটি একতলা, একটি দুইতলা ও একটি তিনতলা ভবন রয়েছে। তিনতলা ভবনটি একশত এক (১০১) কক্ষ বিশিষ্ট ভবন। ৯২ শতক জমি জুড়ে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটিতে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘাট রয়েছে। এছাড়াও একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপ রয়েছে। আর জমিদার বাড়ীর পাশেই দেখতে পেলাম ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। বর্তমানে বাড়ীটির বেশীরভাগ অংশে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে; আর জমিদার বাড়ীর অবশিষ্টাংশ যা রয়েছে; তার অবস্থাও জরাজীর্ণ ভগ্নাবস্থায়।



বালাপুর জমিদার বাড়ি কেবল একটি বাসভবন নয়, এটি ছিল রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক। তিনতলা বিশিষ্ট মূল ভবনটির সম্মুখভাগে ছিল উঁচু স্তম্ভ, বিশাল খিলানযুক্ত বারান্দা এবং অলঙ্কৃত রেলিং। দেয়ালে রঙিন মোজাইক ও ফুলেল নকশা, ছাদের নিচে কাঠের কড়িকাঠে সূক্ষ্ম খোদাই— সব মিলিয়ে বাড়িটি এক শিল্পকর্মের মতোই মনে হয়।

বাড়িটির কেন্দ্রভাগে ছিল দোতলার নাচঘর, যেখানে ব্রাহ্মণ সংগীতজ্ঞরা রাজপরিবারের অতিথিদের সামনে পরিবেশনা করতেন। পাশে ছিল ‘অন্দরমহল’, যেখানে জমিদার পরিবারের নারীরা থাকতেন। বাড়ির দক্ষিণ অংশে ছিল একটি ছোট মন্দির, যেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলতো। বালাপুর জমিদার বাড়ি শুধু শাসনের কেন্দ্র ছিল না— এটি ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্রও। জমিদার পরিবার স্কুল স্থাপন, দান-খয়রাত ও উৎসবের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল।



দুর্গাপূজা, দোলযাত্রা, বা নবদ্বীপের রাস উৎসব— প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে অংশ নিত। জমিদার বাড়ির উঠোনে সেই সময় বাজত ঢাক-ঢোল, আলোকসজ্জায় ঝলমল করত সমগ্র এলাকা। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে ‘পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট’-এর অবসান ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বালাপুর জমিদার পরিবারের প্রভাবও হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা বিলোপ আইনের পর তাঁদের জমির অধিকাংশই সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। ধীরে ধীরে রাজপরিবারের সদস্যরা কলকাতা, ঢাকা বা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি পড়ে থাকে অবহেলায়, সময়ের আঘাতে ভেঙে যেতে থাকে এর প্রাচীর, ছাদ ও দরজা-জানালা।

বর্তমানে বালাপুর জমিদার বাড়ির মূল ভবনটির একটি অংশ এখনো টিকে আছে। অনেক কক্ষ ভেঙে পড়েছে, কিছু জায়গায় স্থানীয় পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। পুরনো ইটের দেয়ালে গাছের শিকড় গেঁথে আছে— যেন প্রকৃতি তার অধিকার ফিরে নিচ্ছে।







"বাংলার জমিদার বাড়ী" সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০১)
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি -বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০২)
মহেড়া জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৩)
লাখুটিয়া জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৪)
দুবলহাটি জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৫)
ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৬ )
তেওতা জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৭)
দালাল বাজার জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৮ )
দত্তপাড়া জমিদার বাড়ীর খোঁজে - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৯ )
ভৌতিক সন্ধ্যায় কামানখোলা জমিদার বাড়ী প্রাঙ্গনে - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১০ )
কালের সাক্ষী - শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ী (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১১)
খুঁজে পেলাম 'ইসহাক জমিদার বাড়ী' - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১২)
বলিয়াদি জমিদার বাড়ী - চারশত বছরের ইতিহাস (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৩)
ভুলে যাওয়ার পথে কাশিমপুর জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৪)
করটিয়া জমিদার বাড়ী (টাঙ্গাইল) (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৫)
কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ির খোঁজে (বাংলার জমিদার বাড়ি - পর্ব ১৬)
মুরাপাড়া জমিদার বাড়ীর আঙ্গিনায় (বাংলার জমিদার বাড়ি - পর্ব ১৭)
"ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ী" যেখানে যেতে যেতে রাত হয়ে যায় ;) (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৮)
হাবড়া জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৯)
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২০)
সদাসদী জমিদার বাড়ী - গোপালদী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২১)
নাগরপুর জমিদার বাড়ি - টাঙ্গাইল (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২২
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:৪৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×