somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রশীদ হলের চিড়িয়াখানা - ৫ (অথঃ চোর সমাচার)

১৬ ই মে, ২০০৮ সকাল ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

------
[পর্ব ১] [পর্ব ২] [পর্ব ৩] [পর্ব ৪]
-----

রশীদ হলের কথা আসলেই মনে পড়ে সেখানকার বিচিত্র সব চোরের উৎপাত। তাই রশীদ হলজীবনের স্মৃতি এই চোরদের উপাখ্যান ছাড়া অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। আজকের লেখা সেই চোরদের কাহিনী নিয়েই।
----

চোর কত প্রকার ও কী কী
বুয়েটের সব হলের মতোই রশীদ হলে চোরদের প্রচন্ড উৎপাত। ছিঁচকে চোর, ভদ্র চোর, ঘাপটি মারা চোর, এমনকি ছাত্রবেশী চোর থেকে শুরু করে নানা রকমের চোরেরা আনাগোনা করে। ম্যানেজার চোরকে না হয় গনার বাইরেই ধরলাম।

হলবাসী ছেলেপেলেদের সম্বল সীমিত। টেবিলে কিছু পাঠ্যবই, ক্যালকুলেটর, আর হয়তো কম্পিউটার। আর সৌখিন জিনিষ বলতে আঁতেলীয় সম্বল বাহারী দামী ফ্রেমের চশমা। কাপড়চোপড়ে হলবাসীরা বঙ্গজীবী, তাই দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া চুরি করার মতো কাপড়ও নেই।

ও হ্যাঁ, আরেকটা জিনিষ ব্যাপক জনপ্রিয় চোর মহলে, তা হলো ক্যালকুলেটর। ক্যাসিওর সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর হলো মিস্তিরি মহলে বাধ্যতামূলক -- সবার কাছে একটা থাকবেই। আমাদের সময়ে জাপানী ক্যালকুলেটরগুলো ছিলো মহার্ঘ ... ৯০০- ১২০০ টাকা দাম ওগুলোর। ক্যাসিওরই মালয়েশীয় সংস্করণগুলো ছিলো বেশ সস্তা, ৬০০-৭০০ টাকাতেই fx-570v টাইপের বেশ কার্যকর ক্যালকুলেটর পাওয়া যেতো। যাহোক, রুমে চুরি হলে অবধারিত ব্যাপার, সবার আগে যাবে এই ক্যালকুলেটর।

ভোরপার্টি
আমাদের রুমে চুরির গল্প আগে করেছি। আমরা রুমমেট তিনজন ছিলাম কুম্ভকর্ণের ভাগ্নে গোছের ... ঘুমালে নাক ডাকা ছাড়া তিনজনেরই সাড়া শব্দ মিলতোনা। এহেন কুম্ভকর্ণ পার্টিদের রুমে চুরি করার জন্য চোরেরা যা করতো, এরকম -- হলের রুমে রুমে ভোরবেলাতে দরজা টেনে দেখতো কেমন অবস্থা ঘরে, রুম খালি বা কেউ ঘুমাচ্ছে দেখলেই জলদি করে টেবিল থেকে জিনিষপত্র হাতিয়ে পগার পার। যে দিন আমাদের রুমে হানা দিলো এহেন ভোর-পার্টি, আমার গেলো ক্যালকুলেটর, আর বয়েলস্টেডের ইলেক্ট্রনিক্সের বইটা, রমণীমোহন রুমমেটের মানিব্যাগ /বই, আর শিল্পপতির গেলো সোনালী ফ্রেমের চশমা!!

ব্লেজার পরা চোর, পড়বি তো পড়, মালির ঘাড়ে ...
এরকম চোরেরা অনেক সময়ে নানা ছদ্মবেশ ধরে আসতো। ছাত্রবেশে আসতো তো বটেই, চশমা লাগিয়ে আঁতেল ব্যক্তি সেজে হলের জনসমূদ্রে মিশে যেতে সময় লাগতোনা। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো এক চোর, ভর বিকালে ব্লেজার লাগিয়ে বিশাল সুটেড বুটেড হয়ে চুরি করতে এসেছিলো আমাদের হলে। ক্যালকুলেটর হাতিয়ে বেরিয়েও এসেছিলো, কিন্তু ঘটনা চক্রে বাথরুম ফেরতা কারো সামনে বমাল পড়ে যাওয়াতে ধরা পড়ে হাতে নাতে।

আর তার উপরে, চোরের ভাগ্যটাও খারাপ। চুরি করবি তো কর, গোবেচারা পোলাপানের রুমেই কর!! তা না করে, হয়তোবা না জেনে শুনেই চোর গিয়ে হাজির হয়েছিলো মুকি ভাইয়ের রুমে। মুকি ভাইকে যাঁরা চেনেন, দ্বিতীয়বার আর বলা লাগেনা, যাঁরা চেনেননা তাঁদের জন্য বলি, ইনি হলেন পরবর্তীতে সনি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত (পরে বিএনপি সরকারের কল্যাণে তা রদ হয়ে যাবজ্জ্বীবন প্রাপ্ত) আসামী - ছাত্রদলের ক্যাডার।

বেচারা চোর, ব্লেজার লাগিয়ে টাগিয়ে কিনা চুরি করতে গেছিলো মুকি ভাইয়ের রুমে!! তখন সেখানে না থাকলেও চোর ধরা পড়ার পরে মুকি ভাইয়ের আবির্ভাব ঘটলো। হলের গেস্ট রুমে বেটাকে বেঁধে ছেদে রাখা হয়েছে মুকি ভাইয়ের অপেক্ষায়। চোর মুকি ভাইকে না চিনলেও সবার মুখে শুনছে "মুকি ভাই আইলো" - আর তা শুনে চোরের মুখ শুকিয়ে চুন। যথারীতি মুকি ভাই ভয়ংকর চেহারা করে হাজির, আর গর্জনেই চোর প্রায় আধমরা। মুকি ভাই অবশ্য কিছুক্ষণ হাতের সুখ মিটিয়ে তার পর ক্লান্ত হয়ে খ্যামা দিলেন। হাজার হলেও বুয়েটের ক্যাডার, মার ধোর করার দৌড়ও সীমিত।

চোর এর জল্লাদ
চোর ধরতে পারলে এরকম করেই হলের গেস্ট রুমে প্রহার পর্ব চলতো। "আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না" -- একথা সিনেমাতে দেখে দেখে অভ্যস্ত লোকজনও তামাশা দেখতে হাজির থাকতো। ব্যাপারটা অমানবিক প্রচন্ড, কিন্তু হলের ভুখামাগা টিউশনী-জীবী ছেলেপেলের শখের কম্পিউটার বা অন্ধের যষ্টি মার্কা ক্যালকুলেটর নিয়ে হাঁটা দিলে সেসব চোরের জন্য মায়া খুব কমজনেরই থাকতো। আর বুয়েটের নিয়ম হলো, চোর দের হল থেকে নিয়ে পুলিশে না দিয়ে বুয়েটের সিকিউরিটি অফিসে পাঠানো ... সেখান থেকে চোরেরা আদৌ হাজতে যেতো কিনা কেউ দেখেনি কখনো, বরং ঘন্টা কয়েক বসিয়ে রেখে জামাই আদরে ছেড়ে দেয়া হতো।

তাই অমানবিক হোক যাই হোক, হলের চোরদের হাল্কা "জামাই আদর" হলেই করা হতো। মুকি ভাইয়ের মতো শক্ত মন সবার ছিলোনা, তাই চোর পেটানোর দায়িত্ব বাধা ছিলো হলের গার্ড নুরুন্নবী ভাইয়ের। বেঁটে খাটো মানুষটার মাথায় প্রচন্ড চকচকে টাক, আর মুখে রীতিমত মিলিটারি মার্কা গোঁফ। চোর পেটানোর বিবিধ কৌশল নখদর্পনে ... ওনার হাতের কাজ দেখতে সবাই জড়ো হতো। অবশ্য বেশি দূর বাড়ার আগেই বুয়েটের সিকিউরিটি অফিসের লোকজনে হাজির হতো। অনেক সময় স্থায়ী নিদর্শন হিসাবে কাঁচির প্রয়োগ ঘটতো ... ভয়ের কিছু নেই ... চোরের চুল বা ভুরুই কেবল কাটা পড়তো বেঘোরে।

চোর যখন প্রেমিক , চোর যখন ওস্তাদ

অনেক সময়ে হল থেকে সিকিউরিটি অফিসে অগস্ত্য যাত্রা করা চোরদের ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনেকের নজরে আসতো পরবর্তীতে। ব্লেজার পরা সেই চোর মুকি ভাইয়ের মার খেয়ে সম্ভবত কয়েকদিন শয্যাগত ছিলো। তবে বেশি দিন লাগেনি, সপ্তাহ খানেক পরেই নিউমার্কেটে তাকে দেখা গেছে - রিপোর্ট অনুসারে এক তরুণীর বাহুলগ্ন অবস্থায় ডেটিং এর সময়ে। হয়তো হলের ক্যালকুলেটর বিক্রয়লব্ধ টাকাই উড়াচ্ছিলো সেখানে।

প্রেমিক বা ছিঁচকে চোর ছাড়াও ছিলো সংঘবদ্ধ চোর বাহিনী। সাইকেল চোর যেমন --- হলের ভিতর থেকে অজস্র সাইকেল চুরি গেছে। এসএসসি পাশের পরে কেনা আমার প্রথম সাইকেলটাকে বুয়েটে নিয়ে এসেছিলাম। শক্ত তালা দিয়ে সিঁড়ির ভেতরে রাখা ছিলো। কোরবানী ঈদের ছুটিতে এসেই দেখি ওটা লাপাত্তা। সবাই জানালো, আজিমপুরের সাইকেলের দোকানে গেলে এখনই ওটা ফেরত পাবো হাজার খানেক টাকায়, দোকান প্রেরিত চোরেরাই এই কাজ করে থাকে।

সংঘবদ্ধ চোরদের নিয়ে আরেক ঘটনা, অবশ্য রশীদ হলের না ঠিক ... আমাদের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের ল্যাবের সামনে জুতা খুলে ঢোকার নিয়ম ছিলো। অবধারিত ভাবে সেখান থেকে জুতা চুরি যেতো। একদিন ক্লাসের এক ছেলে বেরিয়ে দেখে, তার চকচকে কেডসটা পায়ে দিয়ে একজন হাঁটা দিয়েছে। দৌড়ে ব্যাটাকে ধরার পরে হালকা দুএক ঘা দিতেই জানালো, সে আসল বড় চোর না ...তার ওস্তাদ নিচে অপেক্ষা করছে, তাকে পাঠিয়েছে এই কাজে। ছেলেপেলে চার তলা থেকে তাকিয়ে দেখে, আসলেই টাক্কু এক লোক অপেক্ষা করছে নিচে। দল বেঁধে না গিয়ে পা টিপে টিপে বিশাল এক বাহিনী গিয়ে আচমকা ঘিরে ধরে ওস্তাদকে গ্রেপ্তার করলো। অনেকেরই সে সপ্তাহে বা আগের মাসে স্যান্ডেল/জুতা চুরি গেছে, খালি পায়ে বাড়ি ফেরার অপমান সইতে হয়েছে। মার দেয়ার উৎসাহ প্রবল। তবে মারতে গিয়ে আর হাত উঠেনা বেশি। ওস্তাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো ... আমার এক বন্ধুর আবার ব্যবসাবুদ্ধি প্রবল, সে সোৎসাহে প্রশ্ন করলো, জুতা প্রতি কত টাকা লাভ হয়? যেনো, লাভ বেশি হলে সেও ব্যাপারটা ভেবে দেখবে!!

শেষে চোর-ওস্তাদ -- দুইজনকেই সেই ব্ল্যাকহোল সিকিউরিটি অফিসে পাঠানো হলো, পেছন পেছন আমার আরেক শোকাহত বন্ধু ছুটলো। বেচারার নাকি নতুন কেনা ৭০০ টাকার দামী লেদারের স্যান্ডেল (ঐ আমলে এটাই অনেক দাম ছিলো) গত সপ্তাহেই চুরি গেছে। পাবলিকের সামনে লজ্জা করছিলো, তাই সিকিউরিটি অফিসের বারান্দাতে ওস্তাদকে গুনে গুনে ৭টা লাথি দিয়ে মনের ঝাল মেটালো।

-------------

পাদটীকা

চোরদের উপরে হালকা মারধোর করাটা অমানবিক, কিন্তু একই চোর যখন মাসের পর মাস ভোর-পার্টি হয়ে হলে চুরি দারি করে বসে, গ্রাম - মফস্বল থেকে আসা টিউশনি- করে খাওয়া ছেলেদের সবচেয়ে দামী সম্বলটুকু চুরি করে নিয়ে নিউমার্কেটে ডেটিং করে, তখন তাদের উপরে ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভটা কেনো থাকে তা বুঝতে পারি। তবে এদের চেয়েও জঘন্য চোরের কথা শুনেছিলাম রশীদ হলেই ... কোনো এক ছাত্র এক দিনের জন্য হলের বাইরে গেলে তার রুমমেটই সেই ছাত্রের ক্যালকুলেটর আর বইপত্র চুরি করে বেচে দিয়েছিলো। পরে বমাল ধরা পড়া সেই চোরের কী শাস্তি হয়েছিলো, তা অবশ্য জানতে পারিনি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০০৮ দুপুর ২:২৬
৩২টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×