somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (চতুর্থাংশ)

১৪ ই জুন, ২০২৪ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (তৃতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমার ছয় কাকার কোনো কাকা আমাদের কখনও একটা লজেন্স বা একটা বিস্কুট কিনে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। আমাদের দুর্দিনে তারা কখনও এগিয়ে আসেননি। আমরা কী খেয়ে আছি, আদৌ খেয়েছি কি না; সে ব্যাপারেও কখনও জানতে চাননি। কেন চাননি কে জানে! মাকে এ ব্যাপারে জিগ্যেস করে কখনও কোনো সদুত্তর পাইনি। মা একা হাতে পুরো সংসার সামলেছেন। ঝড়-ঝঞ্চায় বাড়ির চারপাশের বেড়া ভেঙে গেলে মা আমাদের নিয়ে ঠিক করতেন।

মায়ের কাছ থেকে এটা-ওটা আবদার করে আমাদের সবসময়ই হতাশ হতে হতো। কারণ, মায়ের হাতে খুব কম সময়ই টাকা-পয়সা থাকত। বাবা তেমন টাকা পাঠাতে পারতেন না। মা আমাদের এটা-ওটা বলে বুঝ দিতেন। আর বলতেন, “তোদের বাবা দেশে এলে সব হবে।”

ছোটো আমি মাঝেমধ্যে কাউকে না বলে ঘর থেকে চাল চুরি করে নিয়ে যেতাম। তারপর স্থানীয় নারাঙ্গী বাজারে সেটা বিক্রি করে ‘মজা’ খেতাম। বৃহস্পতিবার ছিল এখানকার হাটবার। বড়ো পরিসরে বাজার বসত। সেদিন আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। আমার সাথে আমার ছোটো কাকাতো ভাইবোনেরাও যেত। অনেকসময় এমন হয়েছে যে, ওদের কিছু খাওয়াতে গিয়ে আমি নিজে কিছুই খেতে পারিনি।
আমাদের ঘরের পেছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। সে গাছে অনেক পেয়ারা ধরত। অনেকদিন পেয়ারা পেড়ে বড়ো বুলে করে হাটে নিয়ে যেতাম। দুই টাকা হালি বিক্রি করতাম। আর আসার সময় পাঁচ টাকা ভাগা গুড়া মাছ নিয়ে আসতাম, সাথে কচু। মা মজা করে রান্না করতেন।

কয়েকটা হাঁস ছিল আমাদের। ডিম পাড়লে সেগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। এছাড়া মায়ের লাগানো গাছ থেকে কলা, লাউ তুলে বিক্রি করে দৈনন্দিন খরচ মেটাতাম।

শৈশবের ইদের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে আমার। বোনেরা ইদের সময় নতুন জামা-কাপড়ের বায়না ধরত। এক ইদে না পেলে অন্য ইদে ঠিকই পেত। আমি কখনও কোনো ইদে জামা-কাপড় পাইনি। বোনদের দেওয়ার পর আমার জন্য বরাদ্দ থাকত না। দেখা যেত স্কুলে পরার যে জামা ছিল, সেটা পরে ইদ কাটত।

মায়ের অসহায়ত্ব আমি বুঝতাম। তাই একটু বড়ো হওয়ার পর দাবি-দাওয়া কমতে থাকে আমার। মা গর্ব করে বলতেন, “আমার ছেলেটা সংসারের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে শিখে গেছে।”

কোনো কোনো ইদে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমাদের। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মায়ের সাধ্য ছিল না নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়ার। মামারা যদি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদেরও জামা কিনে দেন, মা সে ইচ্ছে পোষণ করতেন।

মামারা আমাদের যথেষ্ট আদর-যত্ন করতেন। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য যেসব জামা-কাপড় কিনতেন, আমাদের জন্যও একই রকম জামা কিনতেন। শৈশবে যেসব জিন্স বা গেঞ্জি পরতাম, সবই মামাদের কিনে দেওয়া। আমার ছয় মামা আরব দেশে থাকতেন। সেখান থেকে জিনিসপত্র পাঠাতেন।

যখন একটু বড়ো হলাম, তখন কিছু কিছু বৈষম্য চোখে পড়ত। যেমন ইদের সময় মামাত ভাইবোনেরা ২০০-৩০০ টাকা করে সালামি পেলেও আমি পেতাম ৫-১০ টাকা। মনে মনে জেদ চাপত; ভাবতাম, আমার বাবা বিদেশ থেকে এলে আমিও নিশ্চয়ই বেশি করে টাকা পাব।

মামাত ভাইয়েরা সেসময়ই নতুন মোবাইল ফোন পেয়েছিল। আমি ওদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে সেসময়কার হিন্দি গানের ভিডিও দেখতাম। ওরা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যেত। যদিও কিছু বলত না।

আমি প্রথম মোবাইল পেয়েছিলাম কলেজে উঠার পর, তাও সেটায় ছবি তোলা যেত না, গান শোনা যেত না।

এক ইদে মামার বাড়ি গেলাম। মামাত ভাইদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল। আমি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম কেন মা আমাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার মা ইদের দিন ভালো কিছু খেতে পারবেন না, পরতে পারবেন না আর আমি মামার বাড়ি থেকে ভালো খাব, ভালো পরব- এসব ভেবে জন্মের কান্না পেল। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার জামা-কাপড় গোছাতে লাগলাম। এক মামি জিগ্যেস করলেন, “কী হয়েছে?” আমি কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটা কথাই বললাম, “মায়ের কাছে যাব।”

এর পর বাড়ি চলে আসি। আর কখনও কোনো ইদে মামার বাড়ি যাইনি।

চলবে...

ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারতে ওয়াকফ বিল: মুসলিম সম্পদের উপর হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের নতুন অধ্যায়

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৪ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:৩৭

ভারতে ওয়াকফ বিল: মুসলিম সম্পদের উপর হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের নতুন অধ্যায়

ছবিঃ এআই ব্যবহার করে তৈরিকৃত।

ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দমন-পীড়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এবার যুক্ত হলো একটি নতুন উপকরণ—ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈদ্যুতিক শাটল গাড়ি চালু

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:০৬




ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চালু হয়েছে বৈদ্যুতিক শাটল গাড়ি। গ্রিন ফিউচার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য আজ সোমবার চালু হয়েছে চারটি গাড়ি। প্রতিদিন সকাল আটটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতের নেতৃত্ব কী কাঁঠালপাতা খাচ্ছে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১:০৩



ভারতের এই কাঁঠালপাতা খেকো নেতৃত্ব তাদের দেশের ভিতর মুসলিম নির্যাতন, ওয়াকফ বিল অথবা অন্যকোন অপকর্মের কথা বললেই বলে এটা তাদের অভ্যন্তরীন বিষয় অথচ এরা প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের অভ্যান্তরীন বিষয় নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাঠ প্রতিক্রিয়া: দেবলোকের যৌনজীবন - অতুল সুর

লিখেছেন নীল আকাশ, ১৪ ই মে, ২০২৫ দুপুর ২:০৯



হিন্দুদের ৩৩ কোটি দেবতা কিন্তু স্বর্গের অপ্সরদের সংখ্যা ৬০ কোটি। ৩৩ কোটি দেবতা ৬০ কোটি অপ্সরাদের সাথে কি করতেন, সেটাই এই বইতে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ‌

লেখক বইয়ের শুরুতেই গ্রীক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাত্রদল - শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান ত্রাস

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৪ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৬

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর কেবল ছাত্রলীগের রাজনীতি নিশিদ্ধ না করে দরকার ছিল শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি নিশিদ্ধ করা। ইন্টারিম সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কুফল ভোগ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে সেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×