গনহত্যা
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বিচারে গনহত্যা, অত্যাচার, ধর্ষন এবং অগ্নিসংযোগ চালায়।
আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ লোক তাদের হাতে শহীদ হয়। দুই হতে চার লক্ষ নারী তাদের হাতে শারিরীক নির্যাতনের স্বীকার হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এটাই ছিল স্বল্পতম সময়ে নৃশংসতম গনহত্যা। বাংলাদেশের কোন গ্রাম এবং শহর তাদের এই ধ্বংসলীলা থেকে রেহাই পায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়ঃ
১. ডাঃ জেবা মাহমুদের ভাযায় তার পিতা রাজশাহীর সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ সম্পর্কে -
কিছু স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং পুলিশ কর্মকর্তা তার বাসায় গোপন মিটিং করেন। কিন্তু তা গোপন ছিলনা। কারন ঐ মিটিং-এ কিছু রাজাকার উপস্থিত ছিল যারা পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর কাছে মিটিং-এর খবর পৌছে দেয়।
আমার বাবা ছিলেন কোষাগারের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন কোষাগারে প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয় পুলিশ বাধা দিলে সে আমার বাবাকে জানায়। আমার বাবা জবাবে বলেছিলেন, "আমার লোকজন সঠিক কাজই করেছে। কোষগারে প্রবেশের কোন অধিকার তোমার নেই।" ঐ ক্যাপ্টেন সন্ধ্যায় আবার আসে এবং আমার বাবাকে জানায় রংপুর থেকে ব্রিগেডিয়ার তার সাথে কথা বলতে চায়। আমার বাবাকে সরাসরি গ্রেপ্তারের সাহস তাদের ছিলনা। তারা তাদের সাথে বাবাকে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।
আমার এখনও মনে আছে বাবা জীপে করে ড্রাইভার এবং গার্ড সহ ক্যান্টনমেন্টে যান। তিনি আর কোনদিন ফিরে আসেননি। যেই শয়তানের থাবা থেকে বাবা দেশকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন সেই শয়তানই আমার বাবাকে চিরতরে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়।
২. সংবাদকর্মী নাদিম কাদেরের ভাষায় তার বাবা চট্টগ্রামের কর্ণেল কাদের সম্পর্কে -
একদিন খুব ভোরে একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন তার বাহিনী নিয়ে আমাদের বাসায় এসে আমার বাবাকে বলে, "তুমি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে আমি সম্মান দেখাতে পারছিনা। তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।" তারপর থেকে সকল তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বাবাকে সর্বত্র খুঁজি কিন্তু আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মা তার জন্য অপেক্ষা করেন। আমরা তার লাশ দেখিনি তাই সবসময় এই আশায় থাকি যে তিনি একদিন ফিরে আসবেন।
আমার বাবার একমাত্র অপরাধ ছিলো তেল এবং গ্যাসকুপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক যেই গুদামে থাকতো তার চাবি আমার বাবার কাছে থাকতো এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জোরপূর্বক সেই গুদাম খুলে তারা কোন বিস্ফোরক পায়নি। তিনি সব বিস্ফোরক মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। এই বিস্ফোরকগুলো মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করতো।
৩. আফতাব আহমেদের মুখে তার বড় ভাই সৈয়দপুরের ডঃ শামশেদ আলী সম্পর্কে -
সৈয়দপুরের উত্তরে একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন ছিল যেখানে মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো। গ্রেপ্তারের পরে আমার ভাইকে সেই ইঞ্জিনের কাছে একটি গর্তের পাশে গুলি করার জন্য নেয়া হয়। মির্জা নামক একজন বিহারীকে এই হত্যার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। গুলি করার সময় আমার ভাই রাইফেলটি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। এরপর তারা আমার ভাইকে হত্যা করে ষ্টীম ইঞ্জিনে তার মৃতদেহ পুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু তার বিশাল শারিরীক আকৃতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। তখন তারা তার দু-হাত, দু-পা কেটে ফেলে তার শরীরটি পুড়িয়ে ফেলে। আমরা দাফনের জন্য তার দেহটি পাইনি।
৪. খুলনার মুক্তিযোদ্ধা সালাম খানের মুখে তার চার মাসের শিশু রেহানা সম্পর্কে -
চার মাসের শিশু রেহানাও ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতার শিকার। তার অপরাধ ছিলো সে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম খানের কন্যা। ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১ পাকিস্তানী বাহিনী তার বাড়ীতে হানা দেয়। কিন্তু আবদুস সালামকে না পেয়ে তারা রেহানাকে বুটের তলায় পিষ্ট করে হত্যা করে।
[চলবে]
পুর্বের পোষ্টসমুহঃ
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ১
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ২
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৩
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৪
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৫
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৬
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৭
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০০৮ বিকাল ৪:৪৩