বড়দা সেই যে গেলো , গেলো দুই সপ্তাহ ধরে তার কোন খোঁজ নাই। বড়দা যাওয়ার সময় আমার হাতে শ খানেক টাকা গুজে দিয়েছিলো। দুই সপ্তাহ সেই টাকায় চলছে। আজকাল অঞ্জু অনেক বেশি বায়না ধরে ওকে সামলাতেই আমার ঘাম ছুটে যায়। আম্মা আবার একা চুপচাপ বিছানায় পরে থাকেন আগে তাও মাঝে মাঝে নানা কে চিঠি লিখতে বলতো এখন তাও বলে না মাঝে মধ্যে আমি উঁকি দিয়ে দেখি আম্মা কিছু বলে কি নাহ কোন রকম নরাচড়া নাই। আম্মা যেনো আগের থেকে বেশি বুড়া হয়ে যাচ্ছে। উঁকি মারলে অবশ্য অন্য বিপদ আছে অঞ্জু হাত বাড়িয়ে ছুটে আসে ও ভাবে আমি হয়তো কিছু এনেছি খাবার তাই উঁকি দিয়ে এক ঝলক দেখেই নিচে নেমে যাই তাও ধরা পরে যাই ঠিকি সিড়ি দিয়ে নামার সময় জামার কোনায় টান অনুভব করি। অঞ্জুর ক্ষুধার্ত চোখ আমার আর দেখতে মন চায় না।
রতন চাচা এখন যেয়ে জোট বেধেছে বিরেন বাবুর সাথে, গতকাল দুইজন মিলে এসে বেশ শাসিয়ে গেলো বাড়ি ছাড়া করবে। বড়দা নাকি বিরেন বাবু কে খুনের ভয় দেখিয়ে বাড়ি দখল করেছে। অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি বড়দা বিরেন বাবু কে এত্ত গুলা টাকা দিতে। আমি বড়দার অপেক্ষায় থাকি। আমি জানি বড়দা এলেই সব সমস্যার সমাধান। আজ একদম কোন খাবার নাই। অঞ্জু কিছুক্ষন পর পর এসে ভাভা খাবো বলে কান্না করছে। আগে যাও মাঝে মধ্যে বকুল অল্প হলেও লুকিয়ে খাবার নিয়ে আসতো কিন্তু সেই যে মারামারি হলো তারপর আর আসে না। বাগান থেকে কিছু শাক এনে ভর্তার মতো করে অঞ্জুকে খাইয়ে দিলাম কিন্তু আম্মা কে কি খাওয়াবো। চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। বড়দা যে কেনো আসে না কে জানে। আমি মনে মনে বড়দা কে ডাকি।
সন্ধ্যার ঠিক আগে কিছু লোকজনের ডাকাডাকি শুনে আমি ঘরের বাহিরে আসি দেখি যে পুলিশের পোষাক পরা এক লোক সাথে দুইজনের কাধে বাশের লাঠি দিয়ে কি একটা ঝুলানো বস্তা মতো আমাকে দেখে পুলিশ এগিয়ে এসে বললো এটা কি সামসু ডাকাইতের বাড়ি, আমি হা করে চেয়ে থাকলাম, সামসু ডাকাত কে বুঝতে পারছি না, আবার জিজ্ঞাসা করলো এটা কি সামসু ডাকাতের বাড়ি, আমি মাথা নেড়ে বললাম না এটা আমাদের বাড়ি আপনি কে? পুলিশ লোকটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে বাড়িতে বড় কেউ নাই? আমি আছি আমাকে বলেন, ভয়ে ভয়ে বললাম। পুলিশ লোকটা আমার হাত ধরে লাঠির সাথে ঝুলানো বস্তারটার কাছে নিয়ে ইশারায় অন্য দুই জনকে বস্তা খুলতে বললেন। সন্ধ্যার নিভে যাওয়া আলোতে দেখলাম একটা মুখ চেনা যায় না চোখ সম্ভাবতো তুলে ফেলা হয়েছে নাক ঠোঁট কাটা। একে চেনো আংগুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো পুলিশ। আমি মাথা নাড়লাম। আমি আসলেই চিনতে পারছি না। লোক দুইটার পেছন থেকে রতন চাচা বলে উঠলো এইতো সেই ডাকাইত টা সামসু ডাকাইত। ভালো হইছে দিছে শেষ কইরা, আমার গায়ে হাত দেয়, দিছে জবাই কইরা। হা হা হা করে পিশাচের মতো হাসতে লাগলো। আমি অস্থির হয়ে লাশ টা চেনার চেস্টা করতে লাগলাম কোন ভাবেই আমি বড়দার সাথে মেলাতে পারছি না। নাক চোখ কিছুই তার জায়গা মতো নাই। খুব বাজে গন্ধ আসছে। বুকের ভেতর ভয়ানক কস্ট হচ্ছে কিন্তু কান্না পাচ্ছে না। আব্বা মারা গেলো এমন কষ্ট হয় নাই কিন্তু আজ হচ্ছে। বস্তার ভেতর থেকে মনে হলো বড়দা বলছে বিল্টু পালা তুই পালা এরা তোকেও মেরে ফেলবে।
চাপা একটা চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি আম্মা আঞ্জুর হাত ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মার পরনের সাদা শাড়ি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সন্ধ্যার আলো তে আম্মাকে ভুতের মতো লাগছে। যেনো শুন্যে ভেসে এসে বস্তাটার উপর আম্মা ঝাঁপিয়ে পরলো। আব্বার মৃত্যতে আম্মা পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিলো বড়দার লাশ দেখে সেই পাথর যেনো আজ ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। একদিকে রতন চাচার উল্লাস অন্যদিকে আম্মার কান্না আমার চারপাশে পুরা পৃথিবী যেন একদম থেমে গেলো। আঞ্জু এসে আমার গলা ধরে জিজ্ঞাসা করলো ভাভা, দাদা কি ভাত আনতে গেছে? ওকে বলার মতো কোন শব্দ আমার নাই। ভিড়ের মধ্যে বকুল কে মনে হয় একঝলক দেখলাম। ওকে জিজ্ঞাসা করতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো এতো দিন কই ছিলি। পুলিশ আম্মাকে টেনে পাশে সরিয়ে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে বললো খোকা এটাই সাইন করে দাও যে লাশ বুঝে পাইছো আমরা চলে যাই। এর মধ্যে রতন চাচা তার একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো পুলিশ স্যার আমার এই কাগজেও একটা সাইন দিতে বলেন আমার কাজটাও তাইলে হয়ে যায় বড় ফারা যখন কাটছে তাইলে নিশ্চিন্তে বাড়ি যাই। আমি মাথা নিচু করে বললাম আমি সাইন দিতে জানি না । আম্মা আর অঞ্জুকে সাথে নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলাম। চারিদিকে অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার, আমরা ভোরের অপেক্ষায় বসে আছি ।
বকুলের বাবাই সব করলেন। বাবার কবরের পাশে বড়দার কবর হলো। সেইদিন দুপুর থেকে বিরেন বাবু আর রতন চাচা উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। বিরেন বাবু বলছে যে সে বাড়ি রতন চাচা কে বেচে দিয়েছে। রতন চাচা আমাদের বাড়ি থেকে বাহির হয়ে যেতে বলছেন না চলে গেলে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে বাহির করবে। আম্মা আর আমি বাড়ির ভেতর চুপচাপ বসে আছি না থেকেও বা করবো কি। আমাদের আসলেও কিছুই করার নাই। আমি কেবল বললাম আম্মা বড়দা বিরেন বাবু কে এত্ত গুলা টাকা দিছে। আম্মা ভাড়ি নিশ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আম্মা একটা ছেড়া সুটকেসে কিছু কাপড় নিয়ে আমাকে আর অঞ্জুকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। অঞ্জু কে কোলে নিয়ে আমি আর আম্মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিন্তু কি জন্য জানি না। একবার পেছন ফিরে দেখালাম নতুন খোড়া বড়দার কবর পাশে পুরানো ভেংগে যাওয়া আব্বার কবর।
আগের পর্ব যারা পড়েন নাই তাদের জন্য !!
যাপিত জীবন ০১
যাপিত জীবন ০২
যাপিত জীবন-০৩
যাপিত জীবন-০৪
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২২ দুপুর ১২:৩০