somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষের পাতা - ৯

১৪ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েকদিন পর ঠিক রাত সাড়ে আটটার সময় একটা ফোন এল। তিন চারবার বাজার পর আব্বা গিয়ে ধরলেন। এত দূর থেকে কেবলমাত্র অস্পষ্ট কিছু হ্যাঁ না ধরনের কথা কানে ভেসে আসছিল। অবশ্য শোনার তেমন কোনো আগ্রহও ছিল না, কারণ যেটা অবশ্যম্ভাবী সেটা মেনে নেয়া ছাড়া আমার কোনো গতি নেই। আড়ি পেতে আগেভাগে খবর নিয়ে লাভ কি, আটিসের হাত ধরে এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়ে আধা পেটা খেয়ে না খেয়ে এক কুড়ে ঘরের নিচে মাথা গুজে সুখের সংসার করবো? এ শুধু গল্পেই হয়। জীবনের সত্যগুলো আমাদের সপ্ন থেকে এতই সুদূরপরিহিত যে ক্ষণিকের জন্য সেগুলোর জীবন্ত স্বাদ পেতে কল্পনার রুপকথায় আশ্রয় নিতে হয়। পনের কুড়ি সেকেন্ড পর আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, “ধর তোর ফোন”
ফোন ধরাতে নিষেধাজ্ঞা জারির পরও কার ফোন বুঝি আমাকে ডেকে দিচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরলাম, “হ্যালো”
ঐ প্রান্ত থেকে বলে উঠলো, “কিরে কেমন আছিস?”
আমি খুশির চোটে এক বিশাল চিৎকার দিয়ে দশহাত লাফিয়ে উঠলাম, “টর্চ তুই?”
“হ্যাঁরে, কেমন আছিস তুই?”
মহাউৎসাহে বললাম, “ভাল, খুব ভাল আছি। তোর কি খবর? তোর বর কই? কি জানি নামটা ভুলে গেছিরে, সরি”
বরের কথা বলতেই টর্চ একেবার আহ্লাদে গলে পড়ল। বাচ্চা মেয়ের মতো খিল খিল করে সেকি হাসি। বুঝলাম বেশ সুখেই আছে। হানিমুন পর্ব এখনো শেষ হয়নি অথবা সুন্দরী মেয়েরা বোধহয় বরের কাছে একটু বেশিই আদর পায়। কোথায় রাগ করবে বরের নাম ভুলে গেছি তা না, হাসতে হাসতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সেই হাসির মধ্যেই কোনমতে লজ্জা আর খুশী মিশ্রিত গলায় বলল, “ওর নাম মিজান, ও তো রোজ সকাল সাতটার সময়ই বেরিয়ে যায়। ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালগেরিতে লেকচারার না?”
“ও আচ্ছা জানতাম না। ভালই তো”
হাসি থামিয়ে টর্চ এবার সিরিয়াস গলায় বলল, “তোর কথা প্রবালের(বিবিসি, টর্চের ভাই) কাছ থেকে শুনলাম। এক কাজ কর তুই আর আটিস ক্যানাডায় চলে আয়। মিজানকে সব বলেছি। আমাদের এখানে থাকবি যতদিন লাগে। কোনো সমস্যা নাই। ভিসা পাসপোর্ট বল্টুরাই করে দিবে। চিন্তা করিস না। আরে তোরা যে দুজন দুজনকে এত ভালবাসিস আগে বলিসনি কেন? আগে জানলে মিজানকে বলে আগেই কিছু একটা করতে পারতাম। শোন এখন রাখি। তুই আমাকে ঠিক জানাবি তো?”
ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে মাথাটা চরকির মতো ঘুরতে লাগলো। কি সর্বনাশ করেছে ঢ্যাঙা। সাতপাঁচ না ভেবে বানিয়ে বানিয়ে এ সব কি বলেছে আর কতদূর যে এটা ছড়িয়েছে কে জানে? এখন পর্যন্ত আমাদের মাঝে ভালবাসার অসচ্ছতাই দূর হল না, একে অপরে ভালবাসি শব্দটা নিয়ে লুকোচুরিই খেলে চলেছি শুধু। মুখ ফুটে বলিনি কখনোও, যদি সব সপ্ন, সপ্নই থেকে যায় তবে কষ্টটা সহ্য করবার শক্তি থাকবে কিনা আমার জানিনা, এই ভয়ে। আর ঢ্যাঙা লজ্জার মাথা খেয়ে সব কিছু এমন নগ্নভাবে উন্মোচন করে দিল?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধাক্কাটা হজম করলাম। টর্চের অবাস্তব প্রস্তাবে আর যাই হোক এই বুঝলাম যে হানিমুন পর্বের বিভরে বর্তমানে ওর বাস্তবটা সপ্নময় রঙিন হলেও আমার জন্য অন্তরের টানটা একেবারে খাটি। অনুভুতিতে আঘাত না দেয়ার জন্য সরাসরি কিছুনা বলে বললাম, “তুই আমার জন্য এত করবিরে। ঠিক আছে চিন্তা করে বিবিসিকে জানাবো না হয়”
টর্চ বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “ঠিক আছে”
ফোনটা রাখার পর সোফা থেকে উঠে পিছন ঘুরে দাড়াতেই দেখি আব্বা ঘরের দরজার কাছে দাড়িয়ে। একটু সন্দিগ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি চিন্তা করে প্রবালকে জানাবি?”
আপুর ঘটনার পর আব্বা আমাকেও আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। বললাম, “ফাইজা কানাডায় ওর বাসায় যেতে বলেছে। আমি বলেছি চিন্তা করে প্রবালকে জানিয়ে দিব”
আব্বা এবার একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বেশ মোলায়েম সুরেই বললেন, “রাজিবের সাথে বিয়ে হলে কানাডা কেন হাজার হাজার দেশ ঘুরতে পারবি। চিন্তা করিস না”
অনাকাঙ্ক্ষিত এই পিতৃস্নেহের অসহ্যতায় মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, “আব্বা আমি এই বিয়েটা করবো না”
আব্বার ভমরকৃষ্ণ গাত্রবরনের তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য না করা গেলেও চোখ দুটো হয়ে উঠলো ভয়ঙ্কর রকমের রক্তছটা লাল। হুংকার দিয়ে বললেন, “তুই কি বললি? খবরদার এই কথা যেন তোর মুখে আর না শুনি”
এরপর গলার স্বরটা আবার একটু নামিয়ে বললেন, “রাজিবদের বাসায় গেছিলাম। কথা পাকা করে এসেছি। তোকে অবশ্য আজকালের মধ্যেই জানাতাম। ওরা বেশি দেরী করবে না। একমাসের মধ্যেই সব শেষ করতে চাচ্ছে।” বলে আব্বা ঘরে চলে গেলেন।
আমি আমার ঘরের জানালার সামনে গিয়ে ঠাই দাড়িয়ে থাকলাম। অনুভুতিগুলো তখন বর্ণনার অতীত। অনেকটা নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নেয়া মানুষের অনুভূতির মতো মিশে একাকার হয়ে শেষ মুহূর্তে যখন শুধু আপনজনের চেহারাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে সেরকম।
ঘড়িতে নয়টা বাজে। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ-র একটানা ঘ্যানঘ্যানে শব্দকে ছাপিয়ে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টির শব্দ
পাচ্ছি। স্ট্রিট ল্যাম্পের পাশে পোকাগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। আটিসের ঘরটা অন্ধকার। বৃষ্টির তোড়টা যেন একটু বাড়তে লাগলো। মাঝে মাঝে ঝাপটা এসে মুখে লাগছে। এ অবস্থায় বের হওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। অথচ ওর সাথে কথা বলা খুব দরকার। দেখতে দেখতে ঘড়িতে পৌনে দশটা বেজে গেল। বাইরে বেশ জাঁকিয়েই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওর ঘরটা এখনো অন্ধকার, বৃষ্টির ছাটে বাইরেটা আরো অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি জানি ও ঘরে আছে। কিন্তু এত রাতে এই বৃষ্টি আর অন্ধকারের মাঝে যাবো? দ্বিধায় পরে গেলাম। অথচ দেখা করা যে খুবই জরুরি। ভাবলাম দুটো কথা বলেই চলে আসব। মাথায় ওড়নাটা জড়িয়ে সবার অগোচরে এক দৌড়ে আটিসের ঘরের দোরগোড়ায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। দারগা কাকুর আসল দালানটা থেকে আটিসের ঘরটা একটু বিচ্ছিন্ন তাই আমার উপস্থিতি শুধু ও’ই টের পেল। আমি কিছু বলার আগেই ও’ বলল, “সোহানা?”
“হুমম”
“ভিতরে আসো। এত বৃষ্টির মধ্যে? বৃষ্টিতে ভিজলে তো তোমার জ্বর চলে আসে।” বলে ঘরের বাতিটা জ্বালালো।
আমি ঘরে ঢুকে দরজার পাশে পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। আটিসকে কথাটা বলতে যাবো হঠাৎ চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। সেটা লুকোতে মাথাটা নিচু করে ওড়নাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। জলের ফোটাগুলো টপটপ করে ওড়নায় আর হাতে পড়তে লাগলো। কি যে হল আমার কিছুতেই চোখের পানি রুখতে পারছিলাম না। আটিস কাছেই দাড়িয়ে ছিল। আরো কাছে চলে এল। অনেক কাছে। খুব নরম আদর মাখানো অথচ গভীর গলায় বলল, “সোহানা, আমার দিকে তাকাও”
আমি চোখের উপর হাতটা রেখে আরো আড়াল করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর কথায় আমার যেন বাধ ভেঙ্গে গেল। নিশব্দ কান্নার দমকে শরীরটা কেপে কেপে উঠতে লাগলো। দুটো কথা বলতে এসে আমার এ দশা হবে ভূভারতেও কল্পনা করিনি। তাহলে আসতাম না। কখনই আসতাম না। আমি চাই না আটিস আমার এই কষ্ট দেখুক।
ও’ আবার অসহায়ভাবে বলল, “সোহানা, একবার আমার দিকে তাকাও” কিন্তু আমি পারছিলাম না তাকাতে, কিছুতেই না। হঠাৎ আমার চিবুকে ওর আলতো আঙুলের ছোয়ায় আস্তে করে আমার মুখটা তুলে ধরলো। নুয়ে পড়ে আমার আরো কাছে চলে এসে চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওর দুচোখ বন্ধ করে ফেললো। পিছন ফিরে চেয়ারের মাথা শক্ত দুহাতে আকড়ে ধরে সমস্ত চাপা থাকা কষ্টে বুক নিঙড়ানো এক আর্তনাদ বেরিয়ে এল-‘সোহানা’
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি ওর চোখ এখন বন্ধ, মুখে প্রচণ্ড যন্ত্রণার ছাপ। চেয়ারের মাথাটা আরো বেশি শক্ত করে চেপে ধরছে। আস্তিন গুটনো হাতদুটোয় শিরাগুলো সব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওকে ডাকলাম, “আটিস” কোনো ভাবান্তর হল না। আবার ডাকলাম, কয়েকবার ডাকলাম, কিন্তু একবারও ফিরে তাকালো না। একটু চুপ করে থেকে ওর আসল নামে ডাকলাম, “সাগর”
ও’ ওভাবেই চোখদুটো বন্ধ করে থাকলো। একটুও নড়লো না, খুব কষ্টে নিজেকে ধাতস্ত করতে করতে শুধু বলল, “আমি পারলাম না সোহানা”
ওর হাতটা ধরার খুব ইচ্ছা করছিল, কিন্তু কিসের যেন একটা বাধা, বুঝলাম না। ওর দিকে অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম। কি করব? আমার যে কিছুই করার নাই। কিছুটা পিছিয়ে এসে বললাম, “সাগর আমি যাই”
...................চলবে
[কিন্তু আমি আবার কবে আসবো জানি না]
১ম পর্ব ২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১:২৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×