somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্যে রাজনৈতিক বিতর্ক: নির্বাচন নাকি দীর্ঘমেয়াদি শাসন?

০৩ রা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ব্রিটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। তার মন্তব্যের খণ্ডিত অংশ নিয়ে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি তা জন্ম দিয়েছে বিভ্রান্তি ও সংশয়ের। বিশেষ করে নির্বাচন কবে হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে তার বক্তব্য নিয়েই মূলত এই বিতর্ক।

ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, দেশের নাকি অনেক মানুষ চান তিনি ৫, ১০, এমনকি ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকুন এবং তাদের নাকি নির্বাচনের দরকার নেই। যদিও তিনি এ কথা "মজার ছলে" বলেছেন মনে করা হলেও, এর পরপরই তিনি সুশাসনের জন্য এই চাওয়া বলে যুক্তি দেন। এই মন্তব্য দেশের গণতন্ত্র-প্রেমী মানুষকে চমকে দিয়েছে।

তবে দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বিএনপি ও তার মিত্ররা, এই বক্তব্যকে আমল দিতে নারাজ। বিএনপি নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা তার ওপরই আস্থা রাখতে চান। তার মতে, নির্বাচন একটি আলাদা বিষয় এবং এটি কোনো শর্তসাপেক্ষ নয় । সংস্কার বা বিচার প্রক্রিয়া নির্বাচনের জন্য বাধা হতে পারে না। তিনি এই দীর্ঘমেয়াদি শাসনের কথাগুলোকে "বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা" হিসেবেই দেখছেন।

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নির্বাচনী রোডম্যাপের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথা বলা হয়েছে। তার মতে, এখান থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই এবং তিনি এই বিষয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি দেখেন না।

প্রধান উপদেষ্টার দীর্ঘমেয়াদি শাসনের মন্তব্যকে অনেক রাজনৈতিক নেতা কথার পিঠে কথা বা একটি রেটোরিক হিসেবে দেখছেন। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মাহমুদ মনে করেন, নেপালের সাথে সময় নিয়ে প্রশ্নের জবাবেই প্রধান উপদেষ্টা সাধারণ মানুষের ১০-৫০ বছরের চাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন, কিন্তু তিনি তা মিন করেননি। বরং তিনি ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং বলেছেন এই ধরনের কথাবার্তাকে তারা পাত্তা দিচ্ছেন না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা যখন বলেন, "আমরা কতদিন থাকব সে সিদ্ধান্ত আমাদের" এবং "নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত" তিনি প্রধান উপদেষ্টা থাকছেন—তখন নির্বাচন নিয়ে সংশয় আরও বাড়ে। তার এই বক্তব্য প্রশ্ন তুলেছে: জনগণের চাওয়া বা বিরোধী দলের দ্রুত নির্বাচনের দাবি কি এই সরকারের কাছে গুরুত্বহীন ?

ড. ইউনূস তার সরকারের তিনটি প্রধান কাজের কথা বলেছেন : সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। তিনি কাজগুলোর যে ক্রম উপস্থাপন করেছেন, তাতে মনে হতে পারে মানুষ সংস্কার ও বিচার শেষ হওয়ার পরই নির্বাচন চায়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ক্রম নিয়ে প্রশ্ন* আছে। দেশের সাধারণ মানুষ একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমেই দ্রুত গণতান্ত্রিক পথে ফিরতে চায়, যা জরিপের ফলাফলেও স্পষ্ট।

সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সরাসরিই বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা একেক সময় একেক কথা বলছেন, যা দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তার মতে, নির্বাচনই এখন প্রধান বিষয় এবং অন্য কোনো কথা না বলে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। তিনি জনগণের দীর্ঘমেয়াদি চাওয়ার দাবিরও সমালোচনা করে বলেছেন, "দেশের মানুষ তো জানতে চায় নির্বাচন কবে?"

সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিতের কথা বললেও, দল নিষিদ্ধ না হওয়ার বিষয়ে তার বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে আইন উপদেষ্টা ও প্রেস সচিবের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হয়েছে বলে জামায়াত নেতা জুবায়ের মনে করেন। বিএনপি নেতা প্রিন্স বিশ্বাস করেন, সরকার জনগণের সেন্টিমেন্টের প্রতি আস্থা রেখেই কাজ করবে। এনসিপি নেতা আলাউদ্দীন মাহমুদ এই বিতর্ককে ভূরাজনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের "ডিষ্টার্বিং এলিমেন্টে" উদ্বিগ্ন এবং এটি বাংলাদেশের নতুন ভূরাজনৈতিক পথে হাঁটার ইঙ্গিত।

সব মিলিয়ে, প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য দেশের মানুষের মনে নির্বাচন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করলেও, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও নেতারা তার দেওয়া ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের নির্বাচনের রোডম্যাপের ওপরই আস্থা রাখতে চাইছেন। তাদের মূল ফোকাস এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি, যা এখনো বড় দলগুলোর মধ্যেও দৃশ্যমান নয় বলে এনসিপি নেতা মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টা কি তার দেওয়া রোডম্যাপে অবিচল থাকবেন, নাকি তার বক্তব্যে সৃষ্ট সংশয় আরও দীর্ঘায়িত হবে ?

ডয়েচে ভেলের 'প্রধান উপদেষ্টার কথায় যত বিভ্রান্তি' এবং সমকালের 'প্রধান উপদেষ্টা কী বার্তা দিতে চাইলেন' থেকে অনুপ্ৰাণিত ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:০৪
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×