somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপ্লবী থেকে শেখ হাসিনা: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তটা কোথায় ?

২১ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২০২৪ সালের আগস্ট। ঢাকা দেখেছিল এক গণ-অভ্যুত্থান, যার ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছিল এক যুগের পুরনো ক্ষমতা কাঠামো। প্রতিশ্রুতি ছিল—বৈষম্যের অবসান হবে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে, এবং দেশ দেখবে এক নতুন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা। মঞ্চ প্রস্তুত হলো, পর্দা উঠল, আর দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল সেই ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’। কিন্তু মঞ্চের আলো যখন তীব্র হলো, তখন দেখা গেল—এ তো নতুন কোনো নাটক নয়, বরং পুরোনো একটি নাটকেরই পুনঃমঞ্চায়ন, যেখানে চরিত্রগুলো শুধু পোশাক বদলেছে।

প্রথম দৃশ্যের শুরু হলো সেই বহুচর্চিত "বৈষম্যের" সূত্র ধরে। কুমিল্লার ছেলে আসিফ মাহমুদ, যিনি কিনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন পুরোধা, পেলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার গুরুদায়িত্ব। দেশের রাস্তাঘাটের হাল ফেরানোর জন্য তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে যখন ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিশাল একটি একক প্রকল্প নেওয়া হলো কুমিল্লার জন্য, তখন সবাই ভাবল, যাক, এবার হয়তো আঞ্চলিক বৈষম্য মিটবে। কিন্তু যখন জানা গেল, কুড়িগ্রামের মতো জেলা যেখানে ৭০ শতাংশ উপজেলা সড়ক খারাপ এবং রাস্তা মেরামতের জন্য বছরে মাত্র ৪০ কোটি টাকা পায়, তাদের জন্য কোনো একক প্রকল্প নেই, অথচ সেই বরাদ্দের সিংহভাগ (৪৫৩ কোটি টাকা) চলে গেল উপদেষ্টার নিজ উপজেলা মুরাদনগরে—তখন বোঝা গেল, বৈষম্যের সংজ্ঞা পাল্টায়নি, শুধু এর সুবিধাভোগী পাল্টেছে। এই বৈষম্যমূলক বরাদ্দটি সাতক্ষীরার ২ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পের মতোই ক্ষমতা বলয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল। বলে রাখা ভালো তরুণদের আইকনিক নেতা হাসনাত আবদুললাহ যে আসন থেকে ইলেকশন করবেন সেখানেও বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ।

এরপর নাটক গড়াল ঢাকার দিকে। সামনে নির্বাচন। হঠাৎ করেই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তাঁর নির্বাচনী এলাকা মুরাদনগর থেকে ভোটার হয়ে গেলেন ঢাকার অভিজাত আসন ঢাকা-১০-এর। আর কাকতালীয়ভাবে, তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচনের ঠিক আগে ঢাকার ২৭৪টি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হলো। এই বরাদ্দের ৯৯ শতাংশই পড়ল তাঁর নিজের আসন এবং নতুন দল এনসিপির দুই নেতা (নাহিদ ইসলাম ও তাসনিম জারা) সম্ভাব্য নির্বাচনী আসনে। অন্যদিকে, ঢাকার বাকি ১৭টি আসনে কোনো বরাদ্দ গেল না বললেই চলে।

দর্শকরা হাততালি দিতে গিয়েও থমকে গেল। এই দৃশ্য তো পরিচিত! ভোটের আগে মসজিদ-মাদ্রাসা-মন্দিরে সরকারি টাকায় 'উপহার' বিতরণ: শেখ হাসিনার সরকারও তো এই স্ক্রিপ্টই অনুসরণ করত, যেখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম আর গোপালগঞ্জের মতো জেলাগুলো এডিপির ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ লুফে নিত, আর মাগুরা, নড়াইল ও লক্ষ্মীপুরের মতো জেলাগুলো পেত মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জ* এডিপির ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়ায় যে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট ছিল, আসিফ মাহমুদ সেই একই আয়না ধরেছেন। নতুন বন্দোবস্তের নামে পুরোনো কায়দায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা দেখে মনে হলো, মঞ্চের প্রপসগুলোও বদলানো হয়নি।

মঞ্চের নেপথ্যে চলল আরও এক প্রহসন। উপদেষ্টার সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী একান্ত সচিবের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্য ও অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ উঠল। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যা কিনা পুরোনো আমলের মতোই 'সরকারের মর্জি বুঝে চলে' বলে পরিচিত, তারা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েও তদন্ত কার্যত স্থগিত রাখল। কারণ? 'কান টানলে মাথা আসতে পারে'—অর্থাৎ, ছোট মাছ ধরতে গেলে হয়তো বড় মাছ, স্বয়ং উপদেষ্টাও জালে জড়িয়ে যেতে পারেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ফসল এই সরকারে, দুর্নীতির তদন্তের এই 'সীমারেখা' টেনে দেওয়া দেখে দর্শকরা ফিসফিস করতে শুরু করল: এ তো ক্ষমতার ছায়ায় থাকার সেই পুরোনো সুবিধা, যা থেকে দেশকে মুক্তি দিতে এই পরিবর্তন এসেছিল।

আর এই পুরো নাটকটির নেপথ্যের প্রধান চরিত্র, যিনি কিনা বিশ্বজুড়ে নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত, সেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রইলেন নীরব। কথিত আছে, আসিফ মাহমুদ তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আনার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, আর সেই 'কৃতজ্ঞতার দায়' হয়তো উনার মুখে কুলুপ এঁটেছে। নৈতিকতার মানদণ্ড যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাছে পরাজিত হয়, তখন সেই নীরবতা সরকারের নৈতিক ব্যর্থতার প্রধান সাক্ষী হয়ে ওঠে। এই নীরবতার আড়ালে উপদেষ্টারা যা খুশি তাই করার সুযোগ পেলেন।

তাই মঞ্চে যখন "নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত" লেখা ব্যানার ঝুলছে, তখন দর্শকরা দেখতে পাচ্ছে একটি প্রতিচ্ছবি। এই সরকার অতীতের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে যে আয়না তুলে ধরেছিল, এখন সেই আয়নাতেই তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই—আগের প্রতিচ্ছবি ছিল এক দলের, আর এখনকার প্রতিচ্ছবিতে নতুন নেতারা ভিড় করেছেন। এটি কোনো নতুন বন্দোবস্ত নয়, এটি হলো এক 'আয়না-বাজি', যেখানে দেশের মানুষ প্রতারিত হয়ে দেখছে এক চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ।


বিবিসি বাংলা : নির্বাচনের আগে ঢাকা-১০সহ তিন আসনে হঠাৎ বিশেষ বরাদ্দ, কী বলছেন উপদেষ্টা?
মানবজমিন: বৈষম্যবিরোধী’ উপদেষ্টার জেলাপ্রীতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিবও একই পথে ।
বিবিসি বাংলা : উপদেষ্টাদের এপিএস-পিও'র দুর্নীতির ফাইল ডিপ ফ্রিজে ।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×