somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার পরামর্শ এখন আর কেউ দেয় না !

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছোটবেলায় আব্বার সাথে বাজারে যাওয়াটা আমার কাছে একটা অদ্ভুত খেলা ছিল। দোকানদার ক্যালকুলেটর হাতে নেওয়ার আগেই আমি মুখে মুখে হিসাব কষে ফেলতাম। পাঁচশো টাকা দিলে কত ফেরত আসবে, তিনশো আশি টাকার বাজার হলে বাকি কত থাকবে। চারপাশের মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো, আর আমি গর্বে ফুলে উঠতাম। বাজারের পরিচিত দোকানদাররা আব্বাকে বলতেন, ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবেন ভাই, অংকে মাথা ভালো তো! আব্বা হেসে বলতেন, ওর তো নৌবাহিনীতে যাওয়ার সখ। কিন্তু ধৈর্য কম ছেলের। এই ধৈর্যের অভাবের প্রমাণ ছিল আমার দর কষাকষি না করা। মধ্যবিত্ত পরিবারে দর কষাকষি একটা সংস্কৃতি, একটা বাঁচার কৌশল। কিন্তু আমি এক দোকান থেকেই জিনিস কিনে ফেলতাম, দামদর না করে। এটা আব্বার চোখে আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল।

বছরগুলো গড়িয়ে গেল। ২০১৯ সালে এসে পেঁয়াজের দাম যখন আকাশ ছুঁয়ে গেল, তখন বুঝলাম দর কষাকষি শুধু দক্ষতা নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারতের কর্ণাটকে বন্যা হলো, ভারত পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল। বাংলাদেশে যেন রাতারাতি পেঁয়াজ সোনার চেয়ে দামি হয়ে গেল। সিন্ডিকেটের দাপট শুরু হলো। পেঁয়াজের দাম ত্রিপল সেঞ্চুরি করে ফেলল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো। আমরা মধ্যবিত্তরা তখন পেঁয়াজ কেনা পঁচাত্তর শতাংশ কমিয়ে দিলাম। আগে আধা কেজির নিচে পেঁয়াজ কিনতাম না, এখন দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকার কিনতে পেঁয়াজ শুরু করলাম। যখন দাম একদম চরমে, তখন আমরা পেঁয়াজ ফুল কিনে রান্নায় ব্যবহার করতাম। স্বাদ পাইনি, কিন্তু একটা সান্ত্বনা পেয়েছিলাম যে অন্তত পেঁয়াজের গন্ধ তো আছে।

হোটেলগুলোতে সিঙ্গারা-সমুচার সাথে কাঁচা পেঁয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। ফাস্টফুড আর মোগলাইয়ে পেঁয়াজের পরিমাণ এতটাই কমে গেল যে খেয়ে বোঝাই যেত না পেঁয়াজ আছে কিনা। খাবারের দাম বাড়ল, কিন্তু মান কমল। আমাদের মিরপুরের টিনশেডের বাসায় এক বৃদ্ধা মহিলা ভাড়া থাকতেন। তিনি একটা হোটেলে কাজ করতেন। তার অদ্ভুত একটা ব্যবসা ছিল। হোটেল থেকে চুরি করে পেঁয়াজ সহ নানা রকম মশলাপাতি এনে বাসার গরিব ভাড়াটিয়াদের কাছে বিক্রি করতেন। কিন্তু একসময় তিনিও হাল ছেড়ে দিলেন। হোটেলে কঠিন কড়াকড়ির কারণে উনার বিজনেস লাটে উঠে ।

মানুষ তখন সরকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রত্যাশা ছিল দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিন্ডিকেট ভাঙা হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু যা হলো তা মানুষকে হতবাক করে দিল। শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে তার চাটুকার সাংবাদিকদের সামনে বসে এমন একটা বক্তব্য দিলেন যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ম্যাডাম পেঁয়াজের ঝাঁজ কমছে না কেন ? প্রথমে তিনি সিন্ডিকেটকে দোষ দিলেন, তারপর বললেন ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, তুরস্ক থেকে আনার চেষ্টা করছি। তারপর যে কথা বললেন তা শুনে পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন, এত হইচই করার কী আছে? আমি তো বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে। পেঁয়াজ না খেলে কী হয়?

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মানুষ বিস্মিত হলো না, ক্ষুব্ধ হলো। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতো দেশে, যদি সত্যিই কোনো সরবরাহ সংকট থাকতো, তাহলে হয়তো মানুষ বুঝত। কিন্তু এখানে সমস্যা ছিল সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীকে জবাবদিহি করানোর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু তিনি মাথা-ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সমাধান দিলেন। পেঁয়াজ খাওয়াই বন্ধ করে দাও, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এই বক্তব্যের প্রভাব পড়ল দেশজুড়ে। প্রতিদিন রান্নাঘরে যখন মহিলারা পেঁয়াজ কাটতেন, তখন শেখ হাসিনার কথা মনে পড়ত। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুরু হলো। হোটেলে সিঙ্গারার সাথে পেঁয়াজ চাইলে হোটেল মালিকরা হাসিমুখে বলতেন, পেঁয়াজ কম খান ভাই। শেখ হাসিনার শাসনামলে মানুষ শিখে গেল বেশি দাম দিয়ে জিনিস কিনতে। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হলো। ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য এটা একটা সুবিধা হয়ে দাঁড়াল। মানুষ তো আর আগের মতো প্রতিবাদ করবে না, তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এবার আসি ইন্টারিম সরকারের কথায়। নভেম্বর মাস থেকে আবার পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দাম ছাড়িয়ে গেল দেড়শো টাকা। সরকার প্রথমে ভেবেছিল আমদানি করবে না, যাতে দেশের চাষিরা ফসলের ভালো দাম পায়। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। অবশেষে সরকার হার মানল, আবার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি হয়ে গেছে। মানুষ আবার উচ্চমূল্যে পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হলো।

শুধু পেঁয়াজ নয়, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে নয় টাকা বাড়িয়ে দিল ব্যবসায়ীরা, সরকারের কোনো অনুমতি ছাড়াই। নতুন সরকার আসার পর থেকেই তেলের দাম বেড়েছিল। এখন আবার বাড়ল। সরকারের ইমেজ সংকটে পড়ে গেল। বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের সাথে বোঝাপড়া করে তিন টাকা কমাতে পারলেন। লিটারপ্রতি একশো পঁচানব্বই টাকা হলো, যা এখনও বেশি। কিন্তু অন্তত একটা পার্থক্য আছে। ইন্টারিম সরকারের কেউ এসব নিয়ে মজা করছে না। কৃষি উপদেষ্টা, খাদ্য উপদেষ্টা হয়তো তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন না, কিন্তু তারা অন্তত বে-লাইনে কথা বলছেন না। মানুষের যন্ত্রণাকে হালকা করে দেখছেন না।

এখানে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, যা গত বছর জাপানে ঘটেছিল। জাপানে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে গেল। সাধারণ মানুষ সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হলো। একদিন সংবাদমাধ্যমে খাদ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলো, চালের দাম কেন এত বেশি? মন্ত্রী উত্তর দিলেন, আমার তেমন ধারণা নেই, কারণ আমি চাল উপহার পেয়ে থাকি। ব্যস, এর বেশি কিছু লাগল না। পরের দিনই তাকে বরখাস্ত করা হলো। জাপানের মানুষ জীবনযাত্রার মানে বাংলাদেশ থেকে অন্তত একশো বছর এগিয়ে। তবুও যখন খাদ্যমন্ত্রী মানুষের মৌলিক প্রয়োজন নিয়ে হালকা মন্তব্য করলেন, তার চাকরি গেল। কারণ খাদ্য শুধু একটা পণ্য নয়, এটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার।



সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৯

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

বিএনপি রাজনীতিতে এক অদ্ভুত মোড়—অনেক বছর পর হঠাৎ করেই তারেক রহমান সরাসরি জামায়াতকে ঘিরে কিছু সমালোচনামূলক কথা বললেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচনে বিএনপি কি ২৭৮ আসন পেতে যাচ্ছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১০



একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পাচ্ছি। আগামী নির্বাচনে বিএনপি ইতিহাসের সর্বোচ্চ আসন পেতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে একদলের সর্বোচ্চ প্রাপ্ত আসন ২৭৮ টি। এটি বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর জাতীয় সংসদ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এডমিন সাহেব আমাকে নিয়ে অনেক বক্তব্য দিতেন এক সময়।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০৯



আমার "চাঁদগাজী" নিকটাকে উনি কি জন্য ব্যান করেছিলেন, সেটা উনি জানেন; আসল ব্যাপার কখনো আমি বুঝতে পারিনি; আমার ধারণা, তিনি হয়তো নিজের দুর্বলতাগুলো নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতেন; মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার পরামর্শ এখন আর কেউ দেয় না !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৪৫


ছোটবেলায় আব্বার সাথে বাজারে যাওয়াটা আমার কাছে একটা অদ্ভুত খেলা ছিল। দোকানদার ক্যালকুলেটর হাতে নেওয়ার আগেই আমি মুখে মুখে হিসাব কষে ফেলতাম। পাঁচশো টাকা দিলে কত ফেরত আসবে, তিনশো আশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×