আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে এই উইকএন্ড এ বাজার করতে যাব, কাঁচাবাজার না, আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এখানে আসার সময় বাসা থেকে কম্বল নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাগেজ ভারী হয়ে যাওয়ার কারনে কম্বল বাদ দিতে হয়েছে। আর কুকিং এর জন্য অন্যান্য জিনিসপত্র তো কিনতেই হবে। আমি আসার সময় শুধু প্লেট আর গ্লাস নিয়ে এসেছি। গতকাল তনয় এবং শিমুলের সাথে কথা হয়েছে যে, আমরা তিনজন আজকে বের হবো, দুপুর বারটায় আমার রিচমন্ড স্টেশনে থাকতে হবে, তনয় আর শিমুল ১২ টার ট্রেন এ আসবে গ্লেনফেরী থেকে। আমি যথারীতি ঘুম থেকে উঠে গেলাম। দুপুর ১২টায় আমার জন্য উঠাটা একটু আরামদায়ক। অন্যান্য কাজ শেষ করে খেতে গিয়ে দেখি আমার রুমে খাবার কিছু নেই। তখন মনে হলো যে, ফ্রিজে দুধ আছে, দুধ খেয়ে যাই। আমি ফ্রিজ খুলে দেখি দুধ আছে কিন্তু খুব অল্প পরিমানে। কেউ খেয়ে ফেলেছে। এরকম তো হওয়ার কথা না। কারন, এখানে কেউ কারো জিনিস ধরে না। দুধের কৌটায় আমার রুমের নাম্বারও লিখা ছিল। কি আর করা, যা আছে সেটাই খেলাম। এরপর রুমে এসে দেখি শিমুল ফোন করেছিল। আমি কল ব্যক করলাম। বললো আর কিছুক্ষনের মধ্যে তারা বের হবে। আমি যাতে কিছুক্ষন পর রিচমন্ড স্টেশনে যাই।
আমি রিচমন্ড স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেন আসছে। প্লাটফর্ম ৭ ও ৮ এই দুইটা প্লাটফর্ম এ ফ্লিন্ডারস্ট্রিট এর ট্রেন একসাথে আসলো। বিপদ! আমি কোন ট্রেন এ উঠব চিন্তা করছি, তাড়াতাড়ি তনয়কে কল করে সিওর হলাম যে তারা কোন প্লাটফর্মে আছে। ভাগ্য ভালো দুইটা প্লাটফর্ম পাশাপাশি। আমি ট্রেন এ উঠে বসলাম। ফ্লিন্ডারস্ট্রিট নেমে ওদের সাথে দেখা। এখানে ট্রেন চেন্জ করতে হবে। আমাদের গন্তব্য ফুটসক্রে। আমরা খুজে খুজে ট্রেন বের করে ট্রেন এ উঠে বসে আছি, আর কয়েকমিনিট পরে ট্রেন ছাড়ার কথা। এমন সময় হঠাৎ করে মাইক্রোফোনে শোনা গেল যে, এই ট্রেন যাবে না। প্যাসেন্জার সবাইকে অন্য ট্রেন ধরতে বলা হচ্ছে। আমরা আবার ট্রেন থেকে নেমে ডিসপ্লে বোর্ড দেখতে লাগলাম। আরেকটা লাইনের ট্রেন ফুটসক্রে যায়। আমরা সেই ট্রেন এ উঠে বসলাম।
ফুটসক্রেতে নেমে প্রথমেই মনে হলো অস্ট্রেলিয়ার বাইরে কোন দেশে চলে এসেছি। এখানে খুব কম অস্ট্রেলিয়ান থাকে মনে হয়। রাস্তাঘাটে বেশিরভাগ অন্য দেশের মানুষ, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান (মনে হয় সব ইন্ডিয়ান না - সাউথ এশিয়ানদের চেহারা প্রায় একই রকম)। একটু হেটে গেলাম একটা দোকানে, দোকানের নাম - মিনা বাজার। বাংলাদেশীদের দোকান। দোকানের সামনে সাইনবোর্ড এ বাংলা লেখা, এই প্রথম মেলবোর্ন এসে কোন দোকানের সাইনবোর্ড এ বাংলা লেখা দেখলাম। ভিতরে বাংলাদেশের নানা রকম জিনিসপত্র, তবে বাংলাদেশী দামে না, সবই অস্ট্রেলিয়ান দামে। বাংলাদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যায় এইটাই আবার কম কি? ইলিশ, রুই, চিংড়ি, আইড় সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। রুই মাছের কেজি দেখলাম ৩/৪ ডলার প্রতি কেজি। সস্তাই তো মনে হলো। তবে ইলিশ মাছ ১৪ ডলার প্রতি কেজি। আমি কুকিং এর কিছু জিনিসপত্র কিনলাম। তনয় আর শিমুল কিনলো মাছ। আমরা সবাই মিলে কিছু কলিং কার্ড কিনলাম। কম টাকায় দেশে কথা বলার জন্য কলিং কার্ড এর বিকল্প নেই। লেবেরা মোবাইল দিয়েও কথা বলা যায় তবে সেটার ভযেস কোয়ালিটি কলিং কার্ড এর চেয়ে খারাপ - আর প্রতি কল এ কানেক্টিং ফি লাগে।
এরপর আশেপাশের চাইনিজ, ইন্ডিয়ান দোকান থেকে আরো কিছু জিনিস কিনে আমরা গেলাম কে-মার্ট এ। এখানে কাপড় চোপড়, কম্বল, বালিশ এসব পাওয়া যায়। আমি আর তনয় দুইটা শীতের সোয়েটার কিনলাম। একেকটা ৯ ডলার করে যেগুলো ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কিনলে ২০০ টাকা পাওয়া যাবে। শিমুল একটা জিন্স প্যান্ট কিনলো, ভিতরে লিখা - মেড ইন বাংলাদেশ। থাকে থাকে জিন্স প্যান্ট সাজানো, বেশিরভাগই বাংলাদেশের তৈরি। আমি একটা কম্বল কিনলাম। আমাদের কেনাকাটা শেষ করে যখন বাইরে বের হয়েছি তখন সবারই প্রচন্ড ক্ষুধা লেগে গেছে। আমার তো আরো বেশি - কারন সকালে কিছুই খাওয়া হয়নি বলতে গেলে। আমরা একটা টার্কিশ কাবাব হাউজে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে - গিয়ে সেখান খেকে তিনজন তিনটা কাবাব নিলাম। একেকটার যে সাইজ - একবারে খাওয়া সম্ভব না। তনয় ছাড়া আমরা দুইজন অর্ধেক করে খেলাম। বাকি অর্ধেক প্যাক করে সাথে করে নিয়ে আসলাম, রাতে কাজে দিবে। আসার সময় আমি আর তনয় দুইজন আসবো, শিমুলের কোথায় যেন একটা দাওয়াত আছে, সে সেখানে যাবে। আমি আর তনয় ট্রেনে করে প্রথমে ফ্লিন্ডারস স্ট্রিট আসলাম। এখানে ট্রেন চেন্জ করতে হবে আবার।
আমি আর তনয় ট্রেন এ উঠলাম। আমাদের হাতে অনেকগুলো ব্যাগ। ট্রেনেও অনেক লোক। আমরা একটা সিট এ ব্যাগ রেখে অন্য দুই সিটে বসে আছি। অনেক লোকজন দাড়িয়ে আছে, ট্রেনএ মাঝে মাঝেই দেখা যায় সিট ফাকা থাকলেও অনেকে দাড়িয়ে খাকে - কারন এখানে এক জায়গা খেকে আরেক জায়গায় যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। আমাদের ট্রেন চলছে, আমি আর তনয় দুইজনেই একটু বিব্রত বোধ করছি একটা একস্ট্রা সিট দখল করে রাখার জন্য। হঠাৎ করে এক বুড়ি এসে আমাদের ব্যাগ তনয় এর কোলের আর একটা ব্যাগ এর উপর তুলে দিয়ে সিটে বসে গেল। সে আবার আমাকে কিছু কিছু জ্ঞানও দেওয়া শুরু করলো - বৃদ্ধ হলে কি কি সমস্যা এসব ব্যাপারে। আমি বললাম - ঠিক আছে কোন প্রবলেম নেই। তারপরও দেখি তার জ্ঞান দেওয়া কমে না। বৃদ্ধরা সব দেশেই এক - কথা বলতে বেশি পছন্দ করে।
কিছুক্ষনের মাঝেই আমরা ইউনিভার্সিটিতে এসে পড়লাম। মাছ মাংস এসব ইউনিভার্সিটির ফ্রিজে রেখে আমি আমার জিনিসপত্র তনয় এর ডেস্কের উপর রেখে কিছুক্ষন এদিক সেদিক হাটাহাটি করতেই দেখি সন্ধ্যা লেগে গেল। আমার সাথে ক্যামেরা নিয়ে বের হয়েছি, ইউনিভার্সির কিছু ছবি তুলবো, এর মধ্যে দেখি এক সিকিউরিটি এসে বললো, ইউনিভার্সিটির ভিতরে ছবি তোলা যাবে না, সিকিউরিটি সমস্যা। ছবি তোলা প্রজেক্ট বাদ দিয়ে আবার তনয় এর ডেস্কে এসে বসলাম। আর কিছু করার নেই। আমার ব্যাগ থেকে কাবাবগুলো বের করে আমি আর তনয় খেয়ে ফেললাম - তখন রাত প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। রাতের খাবার মোটামুটি হয়ে গেল। কলিং কার্ড দিয়ে বাসায় কথা বললাম। ইউনিভার্সিটি থেকে কলিং কার্ড ইউজ করার সুবিধা হলো কানেক্টিং ফি লাগে না, সেটা ইউনিভার্সিটি দিয়ে দেয়, তবে এরা কল ট্রাক করে, বেশি কথা বললে এরা নোটিশ পাঠায়। এরপর আর কিছুক্ষন থেকে আমি সাড়ে আটটার দিকে চলে আসলাম। রিচমন্ড স্টেশন থেকে নেমে আমি হোটেল এর দিকে হাটছি, নাইট ক্লাবগুলোর সামনে তরুন তরুনীদের ভিড়। আমি কোলস এ গেলাম, আপেল আর কলা কিনলাম, যদি ক্ষুধা লাগে তাহলে খাওয়া যাবে। এরপর সোজা হোটেল এ ঢুকলাম। রাত বাজে সাড়ে নয়টা। কিছুক্ষন এটা সেটা করে, লেখালেখি করে তারপর নেট এ বসবো।
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১০
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৯
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৭
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৬
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৫
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৪
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৩
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ২
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


