আজকে আমার মেলবোর্ন শহরে ৩য় দিন। অন্যান্য দিনের মত এটাও একটা বোরিং দিন হিসেবেই শুরু হলো। ঘুম থেকে উঠে দেখি ১১ টা বাজে। অর্থাৎ জেট লেগ কিছুটা হলেও কাটা শুরু করেছে। বিছানায় আরো ১ ঘন্টা এদিক সেদিক গড়াগড়ি করে ১২ টার দিকে বিছানা থেকে উঠলাম। তনয় এর আসার কথা আমার এখানে বিকাল ৪ টার দিকে। হাতে প্রচুর সময়। কি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবছি। এমন সময় মনে হলো যাই একটু হোটেল টা ঘুরে দেখে আসি। রিচমন্ড হিল হোটেল ছোট তবে সুন্দর। ভেতরে এবং হোটেলের বাইরেও বসার মত জায়গা আছে। আমি হোটেল এর ভেতরে যে বসার জায়গা আছে সেখানে বসলাম। গাছের নিচে ৩ টা আলাদা আলাদা টেবিল। টেবিলের উপরে অ্যাশট্রে। সেখানে বসে এটা সেটা ভাবছি। আজকে শনিবার, ছুটির দিন। হঠাৎ গাছের দিকে খেয়াল করলাম। লেবু গাছ। সেই গাছে প্রচুর পরিমাণে লেবু ধরে আছে। কেউ মনে হয় লেবু নেয় না। আসার আগে একবার তনয় এর কাছে শুনেছিলাম যে, সে একবার একটা লেবু কিনেছিল ২ ডলার দিয়ে, এখন দেখছি লেবু গাছে ধরে আছে, মনে হয় এগুলো এখানেই নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
একটু পর ঘড়ি দেখছি। দেখলাম ১ ঘন্টাও পার হয়নি। আমার কিছুই করার নেই। দেশ ছাড়ার আগে শেষ কয়েকদিন এত ব্যস্ত ছিলাম যে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সাথে ঠিকমত ফোনেও যোগাযোগ করতে পারিনি। এখন হাতে প্রচুর সময়, কিন্তু যোগাযোগের কোন সিস্টেম নেই। আবার যখন সিস্টেম হাতে পাওয়া যাবে তখন দেখা যাবে আবার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে যাব। এইটাই নিয়ম।
আবার রুমে ফিরে আসলাম। রুম থেকে কয়েকবারে বের হয়ে গিয়ে বাথরুম সারলাম। এই করতে করতে দেখি ২ টার বেশি বেজে গেল। তারপর বসে আছি, কখন ৪ টা বাজবে, তনয় আসবে। আমার বাইরে যাওয়ার ও সিস্টেম নেই। কারণ আমার কোন মোবাইল ফোন নেই। তনয় আসলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। ও আমার হোটেলের নাম্বার জানে। তাই হোটেল ত্যাগ করা সম্ভব না। পেটে মনে হয় একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তনয় এর কথা মত এখানকার খাবার নাকি সব খাটি। তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। নাকি কুত্তার পেটে ... । হাল্কা একটু খাওযা দাওয়া করে আবার হোটেল রুমে ফেরত আসলাম। পেটে সমস্যা হলেও করার কিছুই নাই। অবশ্য আমার কাছে ওষুধ আছে। বাংলাদেশী। এখানে নাকি যেকোন ওষুধ কিনতে গেলে ডাক্তার এর প্রেসক্রিপশন লাগে। সেই ঝামেলায় পড়তে হবে না বলে মনে একটু শান্তি পাচ্ছি। যা হোক, হোটেল রুমে এসে কি করবো সেটাই ভাবছি। ভাবতে ভাবতে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু। ঘুম থেকে উঠে দেখি ৪ টার মত বাজে। তনয় তো এতক্ষনে চলে আসার কথা। তাহলে কি সে আমাকে খুজে না পেয়ে চলে গেল নাকি? আমি তাড়াতাড়ি রিসেপশনে চলে গেলাম। বললাম, আমার খুজে কেউ এসেছিল নাকি? রিসেপশনিস্ট বলল, না। আমি আবার বললাম, কেউ কি আমার খোজে ফোন করেছিল কিনা? সে আবারো আমাকে নিরাশ করলো। আমি আবার রুমে ফেরত আসলাম। এখন ভাবছি কি করা যায়। তনয় এর জন্য বসে না থেকে আমি বের হয়ে একটু হাটাহাটি করে আসি। আমি বের হযে এলাম। আসার সময় রিসেপশনে বলে আসলাম, কেউ যদি আমার খোজ করে তাহলে যাতে বলে যে আমি আধঘন্টার মধ্যে ফেরত আসব। এই বলে বের হয়ে মনে হলো আমি একবার তনয়কে ফোন করে খোজ নেই বেচারার কি খবর। আমি বুথ খেকে তনয় কে ফোন করলাম। সে বলল, সে যে ইনভাইটেশন এ গেছে সেখানে আরো একটু দেরি হবে। তখন বাজে ৫টার মত। আমি বললাম কতক্ষণ লাগবে। সে বলল, ১ থেকে ২ ঘন্টা। আমি বললাম, যে আমি একটু বের হয়েছি, তুই যদি আসিস তাহলে একটু বসিস। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে চলে আসবো। ফোন রেখে দিয়ে আমি হাটতে বের হলাম। গতদিন যেদিকে গিয়েছিলাম, আজ তার উল্টাদিকে। এদিকে দেখি দোকানপাট একটু বেশি। ব্যস্ত শহর। আমি হাটছি। অনেক দোকানপাট দেখলাম। মোড়ে মোড়ে বার। এখানে মনে হয় সবাই ড্রিংক করে। তবে সিগারেট খুব কম লোক খায়।
প্রায় ঘন্টাখানেক হাটাহাটি করে আবার হোটেল এ ফেরত আসলাম। হোটেল এর সামনের রাস্তায় হাটাহাটি করছি এর মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এল। আমি ঘড়ি দেখলাম, পৌনে সাতটা বাজে। তারমানে প্রায় বাংলাদেশের মত সময়েই সন্ধ্যা হয়। তনয় আমাকে একবার বলেছিল সন্ধ্যা নাকি ১০টার দিকে হয়। এখন দেখছি তা ঠিক না। হয়ত তখন সামার ছিল বলে আরো দেরি করে সন্ধ্যা হতো। এখন উইন্টার এর শুরু হচ্ছে মাত্র।
পৌনে আটটার দিকে রুমে আসলাম। রুমে আসার একটু পরেই দেখি দরজায় কে যেন নক করছে। আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখি তনয় দাড়িয়ে আছে। আমি বললাম, শিমুল কই? শিমুল হলো তনয় এর বন্ধু। সে আমারও বন্ধু কিন্তু আগে কখনও দেখা হয়নি। তনয় বলল, শিমুল নাকি রিসেপশনে বসে আছে। রিসেপশন থেকে নাকি বলেছে যে, আমি রুমে নেই। একটু আগে বের হয়ে গেছি। তনয় তারপরও রিচেক করার জন্য আমার রুমে এসেছে। একটু পর শিমুল এসে হাজির। প্রথম দেখা, কিন্তু তার কথাবার্তা শুনে মনে হলো না যে প্রথম দেখা। হয়তো বিদেশ বলে এমন হলো। সে রুমে ঢুকার পরপরই মেলবোর্ন এর গুনগান গাওয়া শুরু করলো। আমার যাতে ভালো লাগে সে জন্যই মনে হয়। কিছুক্ষণ আড্ডাবাজির পর আমরা তিনজন বের হলাম রাস্তায়, হাটাহাটি করতে। শিমুল আমাকে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে গেল। সেখানের ম্যানেজার এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, আমি নেক্সট ১৫ দিন তার ওখান থেকে মাঝে মাঝে ফুড কিনতে যাবো। আমাকে বলল, রান্না করতে ইচ্ছা না করলে এখান থেকে কিনে খাবি। আমি বললাম, এখানকার বৈশিষ্ট্য কি? সে বলল, ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশী ফুড প্রায় কাছাকাছি। আমার কাছে অবশ্য তা মনে হলো না। কারণ দেখলাম, প্রচুর অস্ট্রেলিয়ান সেই দোকানে বসে খাবার খাচ্ছে। এরা তো ঝাল খায় না। কেমনে কি? আর যাই হোক, একটা ব্যাকআপ তো থাকলো। গত দুই দিন যাবৎ অবশ্য আমি অস্ট্রেলিয়ান ফুডই খাচ্ছি। একবারও ভাত খেতে ইচ্ছে হয়নি। রান্না করতে হবে বলে না, আসলেই ইচ্ছে হয় নি। আসলে কাউকে খেতে দেখিনি তো তাই মনে হয়। ওই হোটেল থেকে বের হয়ে আবার আমরা হোটেল এ আসলাম। হোটেল এ এসে কিছুক্ষণ বসে আড্ডা দিলাম। তারপর আবার বের হলাম। এবার তিনজন রাস্তায় হাটছি। আমি গেলাম মোবাইলের সিম কার্ড কিনতে। ২ ডলার দিয়ে একটা লেবেরা কোম্পানীর সিম কার্ড কিনলাম, সংগে ১০ ডলার এর রিচার্জ ভাউচার। সমস্যা হলো, দোকানী, তনয় বা শিমুল কেউই জানে না কিভাবে এটা এ্যকটিভ করতে হয়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও এটা এ্যকটিভ করতে পারলাম না।
তখন বাজে রাত সাড়ে নয়টার মত। তনয় আর শিমুল চলে যাবে। যাওয়ার আগে আমাকে বলল তাদের সাথে ট্রেন স্টেশনে যাওয়ার জন্য। আমিও চললাম। ট্রেন এ চড়ার নাকি কি সিস্টেম আছে। সেটা দেখতে হবে। আমি গেলাম তাদের সাথে। ২৯.৪ ডলার দিয়ে একটা উইকলি টিকেট কাটলাম। এই টিকেট দিয়ে ৭ দিন জোন ১ এ যেকোন জায়গা থেকে যেকোন জায়গায় যাওয়া যাবে। ওরা আমাকে ট্রেন এ উঠার সিস্টেম আর ট্রেন শিডিউল কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি ফেরত আসছি। আসার পথে দেখলাম, রাস্তায় প্রচুর মানুষ। বিভিন্ন নাইট ক্লাব আছে এখানে। এদের সামনে প্রচন্ড ভিড়। এরা উইকএন্ড এ প্রচুর এনজয় করে। আমি আস্তে আস্তে আমার হোটেল এর কাছাকাছি মোড়ে এসে পৌছলাম। এসে বাসায় ফোন করলাম বুথ থেকে। বাসায় কথা বলা শেষ করে হোটেল এ এসে পড়লাম। এখন আগের থেকে ভালো লাগছে। গতকালকের মনখারাপ ভাবটা এখন একটু কম। হোটেল এ এসে খাওয়া দাওয়া করলাম। হাল্কা খাওয়া। বেশি খেতে পারছি না এখানে আসার পর থেকেই। এরপর কাপড় বদলানোর পালা। কাপড় বদলানোর পর আরো কয়েকবার চেষ্টা করলাম সিমটা এ্যকটিভ করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তারপর ল্যাপটপ খুলে বসলাম। লিখা শুরু করলাম দিনলিপি। এখন একটা মুভি দেখবো। মুভি দেখা শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়বো। দেখি আগামীকাল কি হয়?
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১০
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৯
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৮
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৭
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৬
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৫
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৪
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ২
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


