সকাল দশটায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কথা থাকলেও আমার ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই দেখি সাড়ে ৯টার মত বেজে গেল। একটু বাইরে বেরিয়েছি, অমনি ঠান্ডা জেঁকে ধরলো। আবার এসে বিছানায় একটু গড়াগড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে যখন রাস্তায় বেরিয়েছি তখন দেখি ১১টার বেশি বাজে। ১১:৩৮ এর ট্র্রেনে চড়ে যখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পৌছালাম তখন প্রায় ১২টা বাজে। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে তনয় এর রুমে হাজির হলাম। বেচারা মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। আমি গিয়েছি বলে সে তার ডেস্ক থেকে উঠে আসলো, আমরা বাইরে বেরিয়ে গেলাম। ব্যাংকে যেতে হবে, মোবাইল কিনতে যেতে হবে, তারপর মেন্ডিস অথবা শ্যারন এর সাথে দেখা করতে হবে, তাদের কাছ থেকে আমার ডেস্ক বুঝে নিতে হবে, ড. লাই এর সাথে দেখা করতে হবে - অনেক কাজ। প্রথমে ব্যাংক এ্যকাউন্ট করে ফেললাম, তারপর মোবাইল কিনতে গেলাম থ্রি এর একটা অথোরাইজড ডিলার এর কাছে। সেখানে প্যাকেজগুলো যাচাই বাছাই করে একটা প্যাকেজ ঠিক করে আমরা বের হয়ে দেখি প্রায় দেড়টার কাছাকাছি বাজে। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। তনয় আমাকে নিয়ে গেল একটা টার্কিশ কাবাবের দোকানে। মঙ্গলবার তাদের ডিসকাউন্ট থাকে, হাফ দামে কাবাব পাওয়া যায়। আমরা দুইজনে দুইটা কাবাব খেলাম। তনয় বললো, এগুলোকে এখানে মিল বলে। কাবাব খেয়ে বের হয়ে গেলাম শ্যারন এর রুমে। শ্যারন আমাকে বললো চাবি নিতে সিকিউরিটির কাছে যেতে। আমার নামে নাকি চাবি ইস্যু করা আছে। আমি রেলস্টেশন পার হয়ে সিকিউরিটির অফিসে গিয়ে হাজির, কিন্তু সেখান থেকে অনেক খুজাখুজি করেও আমার নামে কোন ইস্যুড পেপার পেল না। আমি আবার ফেরত আসলাম। আমাকে বলা হলো আজকে আমার ডেস্ক রেডি কিন্তু আমার কম্পিউটার একসেস এখনও নেই। আগামীকাল থেকে আমার কম্পিউটার একসেস দেওয়া হবে। এর মাঝে তনয় এসে বলে গেল প্রফেসর টি ওয়াই চেন আমাকে ডেকেছে। টি ওয়াই এই রিসার্চ ল্যাব এর হেড। আমার তার আন্ডার এই পিএইচডি করার কথা ছিল। কোন একটা কারনে আমার টপিক তার পছন্দ হয়নি মনে হয়। সুতরাং আমার সুপারভাইজর এখন চেঞ্জ হয়ে যাবে। ড. বেই লাই হবে আমার সুপারভাইজর।
তনয় আমাকে টি ওয়াই চেন এর রুমে নিয়ে গেল। ব্যাটা পাগল টাইপ লোক, আমাকে পেয়েই বললো, তুমি এসেছ ২৯ এপ্রিল আর এখানে জয়েন করেছ ৩মে, কেন? আমি বললাম, আমার জয়েনিং এ্যপয়েন্টমেন্ট ছিল ৩ তারিখ। সে বললো, তুমার জয়েনিং এর লাস্ট ডেট তো ১মে। এখন কি তুমি স্কলারশীপ পাবে? আমি বললাম, পাব, আমাকে সেইভাবেই মেইল দেওয়া হয়েছিল, ১ মে শনিবার তাই নেক্সট ওয়ার্কিং ডে তে এনরোল করার জন্য বলা হয়েছিল। ব্যাটা কি বুঝল কে জানে, আমাকে রুম থেকে বের করে দিল। বের করে দেওয়ার আগে আবার আমার ফোন নাম্বার রেখে দিল। বললো, ফোন করলে যাতে রুমে গিয়ে হাজিরা দেই। আমার আর তার রুমে গিয়ে হাজিরা দেওয়ার ইচ্ছা কম। পাগল ছাগল মানুষ, কি করতে কি করে তার নাই ঠিক, এর সাথে পিএইচডি করতে হলে হয় আমার পিএইচডি হতো না হয় এই ব্যাটা রিসার্চ ল্যাব এর হেড থাকতো, কিন্তু দুইটা একসাথে হওয়ার সম্ভবনা আমি দেখতে পেলাম না। আল্লাহ বাচাইছে। আমি আবার কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে সুপারভাইজর চেঞ্জ করার ফর্ম ফিলাপ করলাম। সেই ফর্মে সাইন করার জন্যও টি ওয়াই আমাকে দুইবার ফোন করলো। দুইবার ই মাথা খারাপ অবস্থা। যা হোক ফর্ম সাইন করা শেষ করে আমি শ্যারন এর কাছে জমা দিয়ে চলে এলাম। এখন আর আপাতত আমার কিছু করার নেই। তবুও বসে আছি, পাঁচটা পর্যন্ত থাকি, যদি টি ওয়াই আবার ডাকে তাহলে আবার হাজিরা দিতে হবে, প্রথমদিনই ব্যাটাকে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই।
এর মধ্যে আমার নতুন সুপারভাইজর এর মেইল। আমাকে ৪ টা পেপার দিয়েছে পড়ার জন্য। আমি গেলাম তার কাছে, গিয়ে বললাম, থিংগস নিড টু বি সর্টেড আউট ফর মি ইয়েট। আই হ্যাভ নট গট দ্য একসেস অব মাই কম্পিউটার, নট ইভেন দি কিইস অব মাই রুম। সে বললো, নো প্রবলেম, দেন আই উইল প্রিন্ট দি পেপারস ফর ইউ। আমি দেখলাম ব্যাটা আমাকে ছাড়বে না। তাই বললাম, ইফ আই নিড টু প্রিন্ট দেম, দেন আই ক্যান ডু ইট ফ্রম মাই ফ্রেন্ডস কম্পিউটার। আই উইল চেক দি পেপারস ফার্স্ট, দেন উইল প্রিন্ট দি নিডেড ওয়ানস। বলে ব্যাটার রুম থেকে বের হলাম। ব্যাটা লোক ভালো, সমস্যা একটাই, খালি কাজ কাজ করে। আরে ব্যাটা, আমার বাসা এখনও ঠিক হয় নাই। স্কলারশীপের টাকা যে ব্যাংক এ্যকাউন্টে যাবে সেইটা এখনও এ্যকটিভেট হয় নাই। যাযাবর অবস্থায় আছি, এর মধ্যে আমাকে দিয়ে রিসার্চ করাতে চায়। কি যে আছে কপালে কে জানে। আমি আবার তনয় এর রুমে গিয়ে হাজির হলাম। তনয় এর পাশের ডেস্ক এ বসে একটা চাইনিজ ছেলে আছে তাদের সাথে একটা রুম ফাকা আছে, যদি সেইটা পাওয়া যায়। চাইনিজটার সাথে পরিচিত হলাম, নাম বরিস। তার ডেস্কের উপর লিখা দেখলাম জু। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমার ডেস্কে লিখা জু, তুমি তোমার নাম বরিস বলছো কেন? সে আমাকে বললো, জু হলো তার চাইনিজ নেম এবং বরিস হলো তার ইংলিশ নাম। কালে কালে যে আরো কত কি দেখবো? একই লোকের দুইটা নাম। আরে ব্যাটা নাম তো নামই। আমার নাম বাংলায় যা, ইংলিশ এও তাই, আরবী, ফার্সি, স্প্যানিশ, চাইনিজয়েও তাই থাকবে।
বরিস ওরফে জু আমাকে জানালো যে, আগামীকাল তার আরেক পার্টনার এর সাথে কথা বলে আমাকে জানাবে বাসা দেবে কিনা? আমি বললাম ওকে। একটু পরই দেখি এক বাংলাদেশী ভাই আর একটা চাইনিজ ছেলেকে নিয়ে এসে বরিস এর সাথে কথা বলছে বাসার ব্যাপারে। ওই বড় ভাই এখন ওদের সাথে থাকেন, উনি আমার ব্যাপারে কথা বলছেন। এইটা বাদে হাতের সব বাসা শেষ। এখন ভরসা ইন্টারনেট এর বিজ্ঞাপন। আর মাত্র সাতদিন আছে আমার হোটেল। এর মধ্যে বাসা না পেলে প্রবলেম। তিনগুন টাকা খরচ করে হোটেল এ থাকতে হবে। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। আমার একটা ইন্টারনেট কানেকশন সহ কম্পিউটার খুবই জরুরী। অন্তত বাসা খুজার জন্য হলেও। মেজাজ খারাপ অবস্থায় চিন্তা করলাম, হোটেল এ চলে আসবো। এর মাঝে শিমুল এর ডেস্ক এ গেলাম। বেচারার আগামীকাল প্রেজেন্টেশন। বেচারা স্লাইড নিয়ে গুতাগুতি করছে। আমি গিয়ে একটু কথাবার্তা বলে চলে এলাম। সবার ঝামেলা শেষ হলে হয়তো সবাইকে নামিয়ে দেওয়া যাবে বাসা খোজার ব্যাপারে। দেখি কি হয়? মাথায় টেনশন কাজ করছে। এর থেকে দেশেই ভালো ছিলাম এই কথা বার বার মনে হতে লাগলো।
ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এলাম ট্রেন এ চড়ে। রিচমন্ড এ নেমেই দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। আমার সাথে ছাতাও নেই। ভিজে ভিজে হোটেল এ যেতে হবে। আমি হাটছি। অনেকেই দেখি আমার মত রাস্তায় হাটছে আর ভিজছে। আমি কোলস এ গেলাম। আমার ম্যাচ কেনা দরকার এবং সাথে কিছু খাবার। ম্যাচ এবং খাবার কিনে বাইরে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি শেষ। আমি আস্তে আস্তে হোটেল এসে হাজির হলাম। হোটেল এ এসে কিছু করার নেই। বাসা নিয়ে টেনশন মাথায় ঘুরাঘুড়ি করছে। আমি টেনশন দূর করার জন্য একটা পেপার পড়া শুরু করলাম। শুরু হয়ে গেল আমার পিএইচডি। একটা পেপার পড়া শেষ করে একটু শান্তি শান্তি লাগলো। বাইরে বের হলাম। পাঁচমিনিট হাটাহাটি করে আবার এসে পড়লাম। বাইরে খুবই ঠান্ডা। এরপর বাসায় ফোন করলাম। ফোন এ কথা বলা শেষ করে ঘুমাতে যাবো ভাবছি। দিনলিপি লিখতে বসেছি এখন। কালকে অনেকগুলো কাজ আছে। সকালে গিয়েই কম্পিউটারের ব্যবস্থা করতে হবে। বাসা খুজতে হবে ইন্টারনেট এ। মোবাইল নিয়ে আসতে হবে কালকে। ব্যাংক এ্যকাউন্ট এ্যকটিভেট করতে হবে। অনেক কাজ। এখন ঘুমিয়ে যাওয়াই মনে হয় ভালো কাজ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে।
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১০
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৯
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৮
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৭
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৫
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৪
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৩
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ২
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


