অবশেষে একটা মোটামুটি ব্যস্ত দিন পার করলাম। বসে থেকে থেকে আমি প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এবার মনে হয় মটর স্টার্ট হয়ে গেল। সামনে ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর দিন দেখতে পাচ্ছি। সকালে উঠেই মনে হলো ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। তনয় বলেছিল ১২:৩৮ এর ট্রেন এ যেতে। আমি বলেছিলাম আমি আর একটু আগেই যাওয়ার চেষ্টা করবো। এখানে একটু পরপরই ট্রেন চলে। এখানে আসার পর আমি ট্রেন এ উঠিনি। তনয় আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে টিকেট পাঞ্চ করে স্টেশনে ঢুকতে হয়। ট্রেন এ কিভাবে উঠতে হয় সেই সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই। তাই ভেবেছিলাম যে একটু আগে যাব, কোন ঝামেলা হলে যাতে হাতে কিছু সময় থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবহাওয়ার কারনে আরো ঘুমাতে ইচ্ছা হলো, কিন্তু কিছু করার নেই। ইউনিভার্সিটিতে এপয়েন্টমেন্ট করা আছে। আমি প্রাতঃরাশ সেরে আস্তে আস্তে রেডি হয়ে দেখি প্রায় সোয়া বারোটা বাজে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম রিচমন্ড স্টেশনের উদ্দেশ্যে। আমার হোটেল থেকে রিচমন্ড স্টেশন হেটে যেতে লাগে ১২-১৩ মিনিট লাগে। আমি যখন স্টেশনে পৌছলাম, তখন দেখি ১২:৩৮ এর ট্রেন এর ২ মিনিট বাকি আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেন এসে গেল। আমি ট্রেন এ উঠে বসলাম। ট্রেন চলা শুরু করলো। দ্রুত এক্সিলারেশন হয় এই ট্রেন এ। এবং টাইমলি আসে। আমি নামবো গ্লেনফেরি স্টেশনে। ট্রেন এ দেখি খুব বেশি লোকজন নেই। আমার কামরায় গুটিকয়েক লোক। এখন মনে হয় অড টাইম, তাই। আসলেই তো, দুপুর বারটার সময় আর কে ট্রেন এ উঠতে যাবে, স্টুডেন্ট ছাড়া। অল্প কিছু সময় যেতে না যেতেই আমি গ্লেনফেরি স্টেশনে চলে আসলাম। আমার কামরা থেকে এই স্টেশনে কেউ নামবে না। আমি গেটের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে আছি, ভাবছি অটোমেটিক গেট খুলে যাবে, কিন্তু গেট খুলছে না। কি বিপদে না পড়লাম, কারন গেট না খুললে নামবো কিভাবে, ট্রেন তো মনে হয় ৩০ সেকেন্ড এর বেশি দাড়ায় না কোন স্টেশনে। হঠাৎ দেখি দরজার মাঝে একটা সবুজ রং এর বোতাম। বোতাম এ চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল আর আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। গ্লেনফেরি স্টেশনে নেমে দেখি অন্যান্য কামরা থেকে প্রচুর লোকজন নামছে, শুধু অস্ট্রেলিয়ান না, বিভিন্ন দেশের। বুঝতে বাকি রইলো না যে এরা আমার মতই এখানকার স্টুডেন্ট। স্টেশন থেকে বের হতেই দেখি আমার ইউনিভার্সিটি, আসলে স্টেশনের দুইপাশেই ইউনিভার্সিটি। তাই যেকোন দিকে বের হলেই ইউনিভার্সিটি দেখা যায়।
আমি ইএন বিল্ডিং খুজছি। ইন বিল্ডিং এ শ্যারন বসে। তার সাথে আমার এপয়েন্টমেন্ট আছে দুপুর ১:৪৫ এ। এখন মাত্র ১২:৪৫ বাজে। তার থেকে ভালো আগে তনয় এর রুম খুজে বের করি। তনয় বসে রুম ৪০৩ এ। আমি চারতলায় উঠে এদিক সেদিক খুজছি। অবশেষে রুম ৪০১, ৪০২ পাওয়া গেল। আমি পরের রুমে গিয়ে দেখি সেটা একটা ক্লাসরুম, রুম ৪০৫। করিডোরের উল্টাপাশে তাকিয়ে দেখি রুম ৪০৪। মাঝে ৪০৩ কোথায় গেল সেটা বুঝতে পারছি না। পাশে দেখি একটা রুমের দরজা খোলা, আমি উকি দিয়ে দেখি এক বিদেশী মেয়ে মাথা নিচু করে কাজ করছে। দরজা থেকে চলে আসার সময় হঠাৎ খেয়াল করে দেখি দরজার উপরে লিখা ৪০৩। পাওয়া গেছে, সোজা ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে অনেক ডেস্ক, সবাই কাজ করছে, কিন্তু কোন শব্দ নেই। সুন্দর পরিবেশ। আমি খুজে খুজে তনয় এর ডেস্ক বের করলাম। তনয় আমার সাথে বের হয়ে এল। তার রুম থেকে বের হয়ে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আরো কিছু বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এর সাথে পরিচয় হলো, সাদী, মৌ, কবিতা এরা সবাই আমার ব্যাচের, রুয়েটের স্টুডেন্ট। পরিচয় পর্ব শেষ করে আমি, তনয় আর সাদী নিচে নেমে এলাম। নিচে নেমে কথা বলছি এমন সময় আরো কিছু বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এর সাথে তনয় আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সমীরন ভাই, সাইফুল ভাই, মোর্শেদ আরো অনেকেই। এখানে দেখি বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এর ছড়াছড়ি। হঠাৎ খেয়াল হলো ১:৪৫ এ শ্যারন এর সাথে আমার এপয়েন্টমেন্ট। আমরা আবার বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করলাম। শ্যারন বসে লেভেল ৫ এ। আমরা যখন ৪ তলায় উঠে এসেছি, তখন তনয় হঠাৎ বললো য়ে শ্যারন চলে যাচ্ছে। আমি ঘড়ি দেখলাম, ১:৩৫ বাজে। শ্যারন দেখি আর একটা স্টুডেন্টকে নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। মনে হয় সেই স্টুডেন্টও আমার মত নতুন স্টুডেন্ট। এনরোল করতে এসেছে। যা হোক, আমি আর তনয় ১:৪৩ এ শ্যারন এর ডেস্ক এর সামনে গেলাম, গিয়ে দেখি শ্যারন নেই। আমরা বের হয়ে আসবো এমন সময় দেখি শ্যারন দৌড়ে আসছে তার ডেস্কের দিকে। এসে তনয় কে বললো, তোমার বন্ধু এসেছে? আমি আমার পরিচয় দিলাম। ঘড়িতে তখন বাজে ১:৪৫। শ্যারন আমাকে অনেকগুলো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে কোনটা কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটা বলে দিয়ে বললো, বিকাল ৩ টার সময় আমাকে এনরোল করতে হবে সুইনবার্ন রিসার্চ এ। তার আগে সময় পেলে আমাকে ড. বেই লাই এর সাথে দেখা করতে বললো। শ্যারন এর রুম থেকে বের হয়ে আমি গেলাম ড. বেই লাই এর সাথে দেখা করতে। তনয় আমাকে নিয়ে গেল তার রুম এ। আমার সাথে তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ১০ মিনিট এর মত কথা হলো। লোকটাকে দেখে ভালোই মনে হলো, নিপাট ভদ্রলোক। এর সাথেই মনে হয় আগামী কয়েক বছর কাজ করতে হবে। তার সাথে কুশলাদি শেষ করে আমি তনয় এর রুমে আসার পর তনয় আমাকে বললো, চল আমার বাসায়, তাড়াতাড়ি খেয়ে আসি। দুইটার একটু বেশি বাজে। ৩টার সময় আবার আমার এপয়েন্টমেন্ট। চলে গেলাম তনয় এর বাসায়। ইউনিভার্সিটির কাছেই সুন্দর একটা বাসা। ছোট একটা রুম, কিন্তু সুন্দর। একটা খরগোসও আছে। তনয় এর বাসা থেকে বের হয়ে আমরা চলে এলাম রিসার্চ বিল্ডিং এ। আমি তো কিছু চিনি না এখানকার, আর এই টম হারামী সব ভুলে বসেছে। সেও আমার মতই এদিক সেদিক খুজাখুজি করছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে সে অবশেষে কবিতাকে ফোন করে আসতে বললো। কবিতা আসার আগেই অবশ্য সে আবার আর একজনকে জিজ্ঞেস করে বের করে ফেলল কোনটা রিসার্চ বিল্ডিং। আমরা রিসার্চ বিল্ডিং এ ঢুকলাম। এবার তনয় লেভেলও ভুল করলো, অন্য একটা লেভেল এ নিয়ে গিয়ে হাজির। যাহোক, কিছুক্ষণ খুজাখুজি করার পর অবশেষে এলিজাবেথ হিল এর অফিস খুজে বের করা গেল। তখন প্রায় ৩ টা বাজে। এলিজাবেথ হিল অন্য একটা স্টুডেন্ট এর এনরোলমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিল মনে হয়। তার একজন সহকারী আমাকে বসতে দিল। তনয় আর কবিতাকে চলে যেতে বললো, কারন আমার এনরোলমেন্ট প্রসেস শেষ হতে ৩০ মিনিট এর মত সময় লাগবে বললো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এলিজাবেথ হিল এসে আমার কাগজপত্র নিয়ে গেল। একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হলো। সেই ফর্ম এন্ট্রি দেয় কিন্তু কি জানি একটা ঝামেলা হচ্ছে, বার বার সিস্টেম থেকে বলছে, দিস স্টুডেন্ট হ্যাজ অলরেডি এনরোলড। খাইছে, কোন বেটা আমার নামে এনরোল করে গেল। এলিজাবেথ হিল বলতেছে এটা সিস্টেম এর সমস্যা, সিস্টেমটা কম্প্লিকেটেড। প্রায় ৪০ মিনিটের মত লাগলো আমার এনরোলমেন্ট প্রসেস শেষ হতে। লাস্ট ১০ মিনিটে এলিজাবেথ হিল এত বার সরি বলা শুরু করলো যে, আমার নিজেরই খারাপ লাগা শুরু হতে লাগলো। আমি বারবার বলছি, আই হ্যাভ ইনাফ টাইম, টেক ইউর টাইম। বেটি ১০ মিনিট এর জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে সরি বলতেছে।
এলিজাবেথ হিল এর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে আমার তনয় এর কাছে যাওয়ার কথা, সে আমাকে স্টুডেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার এ নিয়ে যাবে। সেখান থেকে স্টুডেন্ট কার্ড নিতে হবে। এলিজাবেথ হিল এর কাছ থেকে বের হয়ে আমার কাছে মনে হলো, স্টুডেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার এ আমি একাই চলে যাই, আমার কাছে তো একটা ম্যাপ আছেই। তনয় এর কাছে গেলে আবার বের হয়ে আসতে কিছু সময় চলে যাবে, স্টুডেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার ৪ টায় বন্ধ হয়ে যায়। আমি চলে গেলাম সেন্টার এ। পাসপোর্ট এবং এনরোলমেন্ট এর কাগজ এর বিনিময়ে আমাকে একটা স্টুডেন্ট কার্ড দিল। তনয় এর অফিসে যাবো ভাবছি। হাটাও শুরু করেছি, এই সময় একটা এশিয়ান মেয়ে দেখি আমাকে কি জানি বলার চেষ্টা করছে। তাকিয়ে দেখি লিবেরা সিমের মার্কেটিং করছে। দেখেই আমার মনে পড়লো, আমার পকেটে একটা লিবেরা সিম আছে, একটিভেট করতে পারি নি। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ক্যান ইউ হেল্প মি ইন দিস রিগার্ড। সেই মেয়ে আর একজনকে ডেকে আমার প্রবলেম এর কথা বললো, সে আমার মোবাইল নিয়ে আমার পাসপোর্ট নাম্বার আর নাম নিয়ে কোথায় যেন ফোন করে এ্যকটিভেট করে দেওয়ার কথা বললো, আমাকে বললো, ইউ টক টু দ্য কাস্টমার কেয়ার, ক্যান ইউ স্পিক হিন্দি। আমি বললাম, নো, আই ক্যান স্পিক ইংলিশ এন্ড বেংগলী। সে বলে, ইটস ওকে, দেন ইউজ ইংলিশ। আমার কথা রলা শেষ হলে সেই এশিয়ান মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, হোয়ার আর ইউ ফ্রম? আমি বললাম, বাংলাদেশ। সে বললো, সেও বাংলাদেশের, ঢাকার মেয়ে। এখানে এ্যকাউন্টিং এ মাস্টার্স করছে। আমি থ্যাংকস দিয়ে চলে এলাম। আমার ১২ ডলার এর একটা গতি হয়েছে ভেবে মনে আনন্দ হচ্ছে। আজকে আর ফোন বুথ এ যেতে হবে না। হোটেল এর বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথা বলা যাবে। বাসায় আমার একটা মোবাইল নাম্বার জানলো। যেকোন সময় বাসা থেকে যোগাযোগ করতে পারবে।
আবার তনয় এর ডেস্ক এ ফেরত আসলাম। তনয়কে বললাম, কি কি কাজ করে এসেছি। সেখান থেকে বের হয়ে চলে গেলাম ব্যাংকে। গিয়ে দেখি কমনওয়েলথ ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে ৪ টা বাজে। সুতরাং ব্যাংক এ্যকাউন্ট খোলা হলো না। আমার পকেটের অস্ট্রেলিয়ান ডলার প্রায় শেষের দিকে। বাকি যা আছে তা সব ইউ এস ডলার। তনয়কে কাহিনী বললাম। ওই ব্যাংকের পাশে আর একটা ব্যাংকে তনয় নিয়ে গেল। সেখান থেকে পাসপোর্টকে আইডেন্টিফিকেশন দেখিয়ে আমি ইউএস ডলারগুলো অস্ট্রেলিয়ান ডলারে কনভার্ট করে ফেললাম। এখন একটা মানসিক শান্তি লাগছে। পকেটে টাকা আছে খরচ করার মত। দরকারের সময় এখানে ইউএস ডলার আর কাগজ একই জিনিস।
এবার আজকের মত মোটামোটি কাজ শেষ। বাসায় চলে যেতে হবে। আমি ট্রেন স্টেশনে আসলাম। ট্রেন এ করে আবার রিচমন্ড স্টেশনে এসে গেলাম। হোটেল এ ফেরার সময় কোলস থেকে কিছু দরকারী খাবার কিনে আনলাম। আমার এখানে খাবার শেষ হয়ে গেছে। খাবার নিয়ে এসে বাসায় ফোন এ কথা বললাম। এরপর রাতের খাবার খেতে খেতেই দেখি রাত ১০টার উপর বাজে। এরপর শ্যারন এর দেওয়া কাগজগুলো দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে ১১টা বেজে গেল। আজ আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। এখন দিনলিপি লিখে ঘুমিয়ে পড়ি। কালকে সকালে আবার ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। অনেকগুলো কাজ আছে। ব্যাংক এ্যকাউন্ট করতে হবে, থ্রি এর একটা মোবাইল নিতে হবে, শ্যারন এর সাথে দেখা করতে হবে, ড. লাই এর সাথে কথা বলতে হবে, আমার ডেস্ক, চাবি ইত্যাদি বুঝে নিতে হবে। অলস সময় এর শেষ দেখতে পাচ্ছি।
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১০
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৯
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৮
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৭
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৬
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৪
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ৩
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ২
ফিরিঙ্গিদের দেশে - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


