শুভ অপরাহ্ন। এই দুপুরে ঘুমঘুম চোখে খুব সহজেই কিন্তু শৈশবে ফিরে যাওয়া যায়। আমার দিব্যি মনে আছে দুপুরের খাওয়ার পর রাশিয়ান বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে যেতাম খুব ছোট বেলায়। সেই অসংখ্য বই ছবি আর গল্পের ভিড়ে আজ একটি ঝকঝকে শৈশব নিয়ে এলাম।
লাল বইয়ের মলাটে জড়ানো অদ্ভুত সুন্দর এক শৈশবের বই 'গল্প আর ছবি।' লাল মলাটের এই বইটি নিমেষেই শৈশব কে রাঙিয়ে দিতো চমৎকার কিছু চকচকে ছবিতে।রাশিয়ান শিশুতোষ বই গুলোর ছবি গুলো যে কি সুন্দর হতো , এই বই না দেখলে বোঝা যাবে না। 'গল্প আর ছবি' এর একটা ছবি গল্প আজ নিয়ে এলাম।
প্রগ্রতি প্রকাশনের ছাপাখানা বন্ধ হয়েছে বহু বছর আগে।এখনকার বাচ্চাদের কাছে সেই বই গুলো নেই। অনেকে শৈশবের মহামূল্যবান সম্পদ গুলো আজ আগলে রেখেছেন , বুক সেলফে রঙিন সেই শৈশব সবচেয়ে বেশি ঝলঝল করে , ঝকঝকে সোভিয়েত শৈশব।
আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস বাচ্চা এবং বাচ্চার বাবা মায়ের জন্য। আমার মত যারা এখনো বাচ্চা আছেন তাদের জন্য।সবার জীবনে শৈশব আসুক ফিরে ----------
গল্প : বিপদ তারণ পাচন
বাড়ি যাচ্ছিলো সজারু। পথে সঙ্গ ধরলো খরগোশ , চলল তারা দুজন মিলে। দুজনে পথ পাড়ি , অনেক তাড়াতাড়ি।
বাড়ি তো কাছে নয় , যায় , যেতে যেতে গল্প করে।
পথে পড়েছিল একটা লাঠি।
গল্প করছে খরগোশ , নজর করেনি , হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়ে আর কি।
'বটে ! ' রেগে উঠলো খরগোশ , লাথি মারলে লাঠিতে , দূরে গিয়ে পড়লো লাঠিটা।
সজারু কিন্তু কুড়িয়ে নিলে লাঠিটা। কাঁধে তুলে চলে গেলো খরগোশের সঙ্গ ধরতে।
খরগোশ দেখে সজারুর কাঁধে লাঠি। অবাক হয়ে বলে :
'লাঠিটা নিয়ে কি হবে তোর , কী বা লাভ ?
' এ লাঠি সাধারণ লাঠি হয়' , বললে সজারু , ' এ হলো বিপদ তারণ পাঁচন। '
জবাবে কেবল ফ্যাঁচ করলে খরগোশ।
যেতে যেতে পড়লো নদী।
এক লাফে পেড়িয়ে গেল খরগোশ। অপর পাড় থেকে চেঁচিয়ে বললে :
' এই কাঁটা-মাথা , লাঠিটা ফেলে দে , লাঠি ঘরে পাড় হতে পারবি না!'
কিছু বললে না সজারু। একটু পেছিয়ে গেল সে, তারপর ছুটে এসে নদীর মাঝখানে লাঠি গেঁথে তার উপর ভোর দিয়ে এক লাফে পেড়িয়ে গেল অপর পাড়ে, দাঁড়ালে গিয়ে খরগোসের পাশেই , যেন কিছুই হয় নি।
দেখে হাঁ হয়ে গেল খরগোস :
' দেখছি তুই লাফ মারতে পারিস খাসা। '
সজারু বললে , ' লাফাতে আমি মোটেই পারি না। আমাকে সাহায্য করে ওই বিপদ তারণ পাঁচন , লাঠির ভরে বাঁচন।'
চলল তারা এগিয়ে। যেতে যেতে পৌঁছলো এক চোরাবালিতে।
খরগোস লাফিয়ে যায়। সজারু পেছু পেছু আসে , লাঠি দিয়ে মাটি পরখ করে দেখে।
' এহ , কাঁটা-মাথা কোথাকার , অমন কুঁতে কুঁতে আসছিস কেন ? বোধ হয় তোর ওই লাঠিটা...'
কথাটা শেষও হল না , লাফ দিতেই চোরাবালিতে ডুবে গেল একেবারে কান পর্যন্ত। এই বুঝি সে খাবি খেয়ে তলিয়ে যায়।
খরগোশের কাছে একটা ঢিবিতে এসে সজারু বললে :
' নে লাঠিটা ধর বেশ শক্ত করে। '
লাঠি আঁকড়ে ধরল খরগোশ।প্রানপনে বন্ধুকে চোরাবালি থেকে টেনে তুলল সজারু।
শক্ত ডাঙায় এসে খরগোশ বললে সজারুকে :
' ধন্যি তুই সজারু , আমায় বাঁচালি। '
'কি যে বলিস , এ ওই বিপদ তারণ পাঁচন , খানাখন্দে বাঁচন।'
চলল এগিয়ে , মস্ত এক ঘন কালো বনের প্রায় মুখে এসে দেখে মাটির উপর পাখির ছানা।
বাসা থেকে পড়ে গেছে , করুন স্বরে চিঁচিঁ করছে , মায়ে বাপে পাক দিচ্ছে কেবলি , জানে না কী উপায়।
' বাঁচাও গো সাহায্য করো আমাদের। ' কাকলী করে উঠল তারা।
বাসাটা অনেক উঁচুতে , নাগাল পাওয়া ভার। খরগোশ সজারু কেউ তো আর গাছে উঠতে জানে না। অথচ বিহিত একটা করা দরকার।
ভাবল সজারু , ভেবে উপায় বের করলে।
খরগোশকে হুকুম দিলে , ' গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়া! '
গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়াল খরগোশ। সজারু লাঠির ডগায় বসালে ছানাটিকে , নিজে লাঠি নিয়ে উঠলো খরগোশের কাঁধে , তারপর যতদূর পারে উঁচু করে তুলে ধরল লাঠিটা , প্রায় বাসার কাছেই পৌঁছলো ডগাটা।
ছানাটা এক লাফ দিতেই একেবারে বাসার মধ্যে।
মা বাপের তখন কী আনন্দ ! খরগোশ আর সজারুর চারপাশে উড়ে উড়ে কিচিরমিচির করে :
'ধন্যি তোমাদের , ধন্যি তোমরা ! '
আর সজারুকে বললে খরগোশ :
' সাবাস তোকে সজারু , বেশ বুদ্ধি করেছিলি !'
'কী যে বলিস , এ সবই ওই বিপদ তারণ পাঁচন , গাছে তোলায় বাঁচন।'
ঢুকল বনের মধ্যে। যতই ভেতরে ঢোকে ততই বন ঘন, ততই বন আঁধার।
ভয় লাগে খরগোশের। সজারু কিন্তু পরোয়া করে না , সামনে এগিয়ে চলে , লাঠি দিয়ে ডালপালা সরায়।
হটাৎ বনের ভেতর থেকে একেবারে সামনের দিকে লাফিয়ে এল প্রকান্ড এক নেকড়ে।
রাস্তা আটকে গর্জন করে উঠলো:
'থাম !'
থেমে দাঁড়ালো খরগোশ সজারু।
ঠোঁট চেটে দাঁত শানিয়ে বললে নেকড়ে :
'তুই সজারু সারা গায়ে কাঁটা তোর , তোকে ছোঁব না , কিন্তু তুই ট্যারা-চোখো খরগোস ,
তোর ল্যাজা মুড়ো সবশুদ্ধ গিলব। '
ভয়ে কেঁপে উঠলো খরগোস , লোম তার সাদা হয়ে উঠল , শীতকালে যেমন হয়।
ছুটতেও পারে না , পা যেন গেঁথে গেছে মাটিতে। চোখ বন্ধ করে ক্ষণ গুনছে এই বুঝি নেকড়ে তাকে খেলে।
সজারু কিন্তু ঘাবড়ালে না। লাঠিটা হাঁকিয়ে যত জোরে
পারে বাড়ি মারলে নেকড়ের পিঠে।
যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠল নেকড়ে , লাফিয়ে উঠে দে
ছুটে...
সেই যে ছুটল , ফিরেও আর তাকাল না।
'ধন্যি তুই সজারু , নেকড়ের হাত থেকেও তুই আমায় বাঁচালি। '
' এ ওই বিপদ তারণ পাঁচন , পিটুনি দিয়ে বাঁচন। '
চলল আরো এগিয়ে। বন উজিয়ে বেরিয়ে এল পথে। তবে পথ আর দুর্গম , পাহাড় ভেঙে ওঠা।
সজারু লাঠিতে ভর দিয়ে খুটখুটিয়ে ওঠে , আর বেচারি খরগোস পিছিয়ে যায় , ক্লান্তিতে উল্টে পড়ে আর কি ।
বাড়ি প্রায় এসে গেছে। খরগোস আর চলতে পারে না।
'ভাবনা নেই ', বললে সজারু , 'আমার লাঠিটা ধর। '
লাঠি চেপে ধরলে খরগোস , সজারু থাকে টেনে তুলতে লাগল পাহাড়ে।
খরগোশের মনে হল পাহাড়ে উঠতে বেশ হালকাই লাগছে যেন।
বললে , ' দ্যাখ , তোর বিপদ তারণ পাঁচন আমায় এবারেও সাহায্য করল তাহলে।'
এমনি করেই সজারু ঘরে পৌঁছে দিলে খরগোস কে। খরগোস গিন্নি আর ছানাপোনারা তারই পথ চেয়ে বসেছিল।
সবার আনন্দ আর ধরে না। সজারুকে বলে খরগোশ :
' তোর এই বিপদ তারণ যাদু পাঁচন নইলে আর আমার ঘরে ফিরতে হত না। '
হেসে সজারু বললে :
'লাঠিটা তোকে উপহার দিলাম , কাজে লাগবে। '
অবাক হল খরগোস :
'এমন যাদু লাঠি ছাড়া তোর চলবে কি করে ?'
'ভাবনা নেই , ' বললে সজারু , 'লাঠি সব সময় মেলে , কিন্তু বিপদ তারণ ---- সেটা এইখানে। '
এই বলে নিজের মগজটা দেখাল সজারু।
সব তখন পরিস্কার হয়ে গেল। খরগোশ বললে :
' ঠিক বলেছিস , লাঠিটা কিছু নয় , বড়ো কথা হল বুদ্ধিমন্ত মাথা আর দয়াবন্ত বুক। '
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বিপদ তারণ পাঁচন - গল্প এখানেই শেষ হলো। আগামীতে অন্য কোন ছবি গল্প নিয়ে আসবো বাচ্চা আর বাচ্চার বাবা মায়েদের জন্য। ভালো থাকুন। শৈশব ফিরে আসুক।
মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাশিয়ান বইগুলো বুকের মাঝখান থেকে আচমকা বের হয়ে আসতে চায় লেখায়। খুব ছোটবেলায় যখন আব্বা আমাকে বই পড়ে শোনাতেন , যখন আমি বানান করেও পড়তে পারতাম না , যখন আমি স্কুলেও যেতাম না -- তখন থেকেই রাশিয়ান বইগুলো আবার সাথেই আছে। তাই সেই 'ছোটমানুষের ' বইগুলোকে মাঝে মাঝে আমি শৈশবের স্কুল বলে ডাকি !
আরো সোভিয়েত শৈশব :
রাশিয়ান শৈশব: ছবি ব্লগ ( বাচ্চা এবং বাচ্চাদের বাবা মায়েদের জন্য )
রুটির ফুল --- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মোরগ ভাইটি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
বীরব্রতী ভাসিয়া -- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
আমার সোভিয়েত শৈশব - আমার শৈশবের স্কুল !
শুনছি , ঘাস বাড়ছে...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৪