somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃশব্দ দূরত্বে (৬)

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(তিন)
মাধবীলতাদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার বাড়তে থাকে।বাধা দেবার কেউ নেই।এই আজকে গাছ কাটছে তো কাল ঝারের বাঁশ কেটে নিয়ে যাচ্ছে।এর মধ্যে একদিন রাতে পুকুরের মাছ মেরে নিয়ে যায়।কারা মাছ মেরেছে কেউ বলতে পারেনা।একদিন মাধবীলতা কার্তিককে বাসায় ডেকে আনে।এর আগে কার্তিককে খবর দিলেও সে আসেনি।আজ বাড়ির দরজায় মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিল।কার্তিককে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়।

-বাবা কার্তিক তোমাকে কতদিন ধরে ডাকছি,তুমি আসোনা কেন বলতো?
বাসনা প্রশ্ন করে।
-পিসী,কাজে এতো ব্যস্ত সময় পাচ্ছিলাম না।এইতো আজকে এলাম।
মাধবীলতার দিকে চেয়ে কার্তিক উত্তর দেয়।
মাধবীলতা বুকের কাপড় ঠিক করে।কার্তিকের চাহনী ভালোনা।লোকটাকে সে পছন্দও করেনা।বাধ্য হয়েই ডাকতে হচ্ছে।
-কার্তিক তোমার কর্তা দাদা আমাদের পরিবারের ভালো বন্ধু ছিলেন।সেই দাবী নিয়েই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তোমাকে ডাকি বাবা।তুমি রাগ করোনাতো?
বাসনা করুণ সুরে কার্তিককে বলে।
-না না পিসী কি যে বলেন।
কার্তিক তাড়াতাড়ি বলে উঠে।
-শুনেন দাদা ওপাড়ার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছি।আমাদের একটু সহযোগিতা করুন।ওপাড়ার জব্বার মোল্লার ইশারায় সব হচ্ছে।আপনারা একবার চেষ্টা করেন দাদা।
মাধবীলতার কথা শুনে কার্তিক কিছুক্ষণ নিরব হয়ে থাকে।
-কি হলো বাপ?
বাসনা প্রশ্ন করে।
-পিসী তোমাদের যুগ আর নেই এখন।ঘোর কলি কাল চলছে।আর এটা হিন্দুস্থান নয়,এটা পাকিস্থান।এখানে হিন্দুদের কথা কেউ শুনবেনা।পারোতো তোমরা ওপারে চলে যাও।
কার্তিক বলে।
-কার্তিক ওপারে আমাদের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই।কে আমাদের আশ্রয় দেবে?
-আশ্রয়ের কথা কি বলছেন? আপনাদের যত সম্পত্তি,বেচে দেন।ওপারে জায়গা জমি করেন।
-হাসালে বাবা।তুমি কিনবে আমাদের জমি?
-কি যে বলেন পিসী?
আরও কিছুক্ষণ গল্প করে কার্তিক চলে যায়।এভাবেই সময় কাটতে থাকে।ক্রমশঃ মাধবীলতা মরিয়া হয়ে উঠে।শেষে জব্বার মোল্লাকেই ডেকে পাঠায় একদিন।জব্বার মোল্লা মাধবীলতাদের বাসায় আসে।সাথে আরও একজন।ওদের বাহিরের ঘরে বসতে দেয় পল্টু।সুজলা জল খাবার দিয়ে আসে।মাধব খেলা শেষে বাড়িতে আসে।বসার ঘরে টুপি পড়া দাঁড়িওয়ালা দুইজনকে দেখে খুব অবাক হয়।
-মা উনারা কারা?
-মুসলমান পাড়ার জব্বার কাকু।
-উনারা আমাদের বাড়িতে কেন?
-আমরা ডেকেছি বাবা।
-কেন?
-ও তুই বুঝবিনা বাবা।
মাধবীলতা পিসীকে নিয়ে বাহিরের ঘরে যায়।জব্বার আর তার সঙ্গী উঠে দাঁড়ায়।আদাব দেয় পিসীকে।ওদের মধ্যে অনেক্ষণ আলোচনা হয়।আলোচনা শেষ করে জব্বার মোল্লারা চলে যায়।যাওয়ার সময় পথে সঙ্গীটি জব্বার মোল্লার কাছে জানাতে চায়, কেন পানির দরে পেয়েও সম্পত্তি কিনতে রাজি হলোনা।জব্বার হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,যে সম্পত্তির বেশীর ভাগই একদিন আমাদের হবে সেটির জন্যে টাকা খরচ করা কেন?

এর কিছুদিন পর মাধবীলতা তার দুই ছেলেকে নিয়ে ভারতে চলে যায়।জোগেস ওদের রেখে আসে।পিসীকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল।পিসী রাজি হয়নি।বলেছিল,চৌদ্দ পুরুষ এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছে।এই মাটি ছেড়ে আমাকে যেতে বলিসনা মা।মাধবীলতা পল্টু আর সুজলাকে সবকিছু দেখে রাখতে বলে।ওপারে দমদমে এক বাসায় উঠে ওরা।বড় ছেলে বিপ্লবও চলে আসে ওর কাছে।আত্মীয়-স্বজনহীন স্থানে খুব দ্রুতই জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়।বিপ্লব আর মাধব এক কারখানায় সামাণ্য মাইনেতে চাকরি নেয়।এক বেলা কখনওবা আধাপেটা খেয়ে দিন কাটতে থাকে।মাধবীলতা ছেলেদের কষ্ট আর চোখে দেখতে পারেনা।মানুষের বাসায় কাজ করবে,এ কথাও তার কল্পনাতে আসেনা।শেষে আবার দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।দেশে খবর পাঠায়।জোগেস এসে ওদের নিয়ে যায়।দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই বাসনা মারা যায়।মাধব আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে।তবে বিপ্লব পড়াশুনার ধারে কাছেও যায়নি।মাধবীলতা ওকে সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে লাগিয়ে দেয়।

মাধবের পড়াশুনা এক বছর পিছিয়ে যায় ওপারে যাওয়ার কারণে।সে তার স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিল।একদিন সে তাদের বাড়ি হতে অনেক দূরে আমগাছ তলার নীচে পড়ছিল।একজন লোক সাইকেল চালিয়ে তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে যায়।মাধবের কাছে আসে।
-বাবা তুমি এখানে পড়ছো কেন?
মাধব সামনের মাঠের গরু দেখিয়ে বলে যে,গরু চরানোর সময়টুকু সে পড়ে কাটায়।
-খুব ভালো।তুমি ইংরেজী পড়ছিলে।তবে তোমার কিছু উচ্চারণ ভুল হচ্ছে।
ভদ্রলোকটি ওকে উচ্চারণ ঠিক করে দিয়ে চলে যায়।এই ভদ্রলোকই পরবর্তিতে মাধবকে নতুন জীবন দান করেন।উনি ধীরেন্দ্র মুখার্জি।

দেখতে দেখতে এক বছর কেটে যায়।ওদের বাড়িতে জব্বার মোল্লার যাতাযাত বেড়ে যায়।অবশ্য আগের চেয়ে অত্যাচার অনেক কমে গিয়েছে।

সেদিন শুক্রবার ছিল।মাধব আর রিপন খেলতে খেলতে বাড়ি ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছে।দুপুর পার হয়ে গিয়েছে।
-দাদা খিদা লেগেছে।চল বাড়ি যাই।
-চল।
ওরা যখন বাড়ির দিকে ফিরছিল তখন পল্টু হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের কাছে আসে।
-মাধবদা,রিপনদা পালাও তাড়াতাড়ি।
-পালাবো কেন?
-তোমাদের বাড়িতে ভয়ানক ঘটনা ঘটে গিয়েছে।ও পাড়ার মুসমানেরা বল্লম,তরোয়াল নিয়ে তোমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।মাকে জব্বার মোল্লা মুসলমান বানিয়ে নিকে করেছে।বিপ্লব দাদাকেও মুসলমান বানিয়ে ওপাড়ার সেতুর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।তোমাদের খুঁজছে ওরা।ধরা পড়লেই মুসলমান বানিয়ে দেবে।পালাও।
ওরা তিনজন দৌড় শুরু করে।কিছুদূর গিয়ে রিপন হাঁপিয়ে উঠে।মাধব দাঁড়িয়ে যায়।পল্টু চলে যায়।পিছনে কেউ আসছে কিনা দেখবার জন্য মাধব পাশের বিশাল আম গাছটায় উঠে পড়ে।গাছে উঠেই দেখতে পায় অনেক কয়েকজন এগিয়ে আসছে।সবার হাতে দা-বল্লম।মাধব আর নামার সাহস পায়না। লোকগুলি এসে রিপনকে পেয়ে যায়।রিপনের কাছে জানতে চায়,মাধব কোথায়?রিপন জানায় আব্দুলপুর ষ্টেশনের দিকে ওর দাদা চলে গিয়েছে।রিপনকে নিয়ে কয়েকজন বাড়ির দিকে চলে যায়।আর কয়েকজন ষ্টেশনের দিকে যায় মাধবের সন্ধানে। মাধব রাত হওয়া পর্যন্ত গাছেই বসে থাকে।রাত হলে গাছ থেকে নেমে আসে।মাধব কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা।অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে,সে কখনও ধর্ম বদলাবেনা।রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত পেটে সে উদভ্রান্তের মত চনধুপইলের দিকে হাঁটা শুরু করে।খুব ভোরে সে বড়দির বাসায় পৌঁছিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

এতো সকালে মাধবকে উঠোনে পড়ে থাকতে দেখে অমলেশ বাড়ির সবাইকে ডেকে তোলে।মাধবকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যায়।শুরু হয় মাধবের ভাসমান জীবন।
“হয়তো আমি মায়ের কাছে যাবো বলে ব্যাগ গুছিয়েছি
আমার মা-সাদা শাড়ি পড়ে বসে আছেন বাড়ির দরজায়।
আমার আর কোনদিন মায়ের কাছে যাওয়া হয়নি জানো,
মা আমায় আর কোনদিন কুয়ো তলায় নিয়ে যাননি
আদর করে চুল আঁচড়িয়ে দেননি।

তোমরা জানো-এই ধর্মটা আমার মাকে কেড়ে নিলো আমার কাছ হতে।

মাগো তোমার সাথে আবার দেখা হবে আমার-মরণের পরে”।

নিঃশব্দ দূরত্বে (১) (Click This Link)
নিঃশব্দ দূরত্বে (২) (Click This Link)
নিঃশব্দ দূরত্বে (৩) (Click This Link)
নিঃশব্দ দূরত্বে (৪) (Click This Link)
নিঃশব্দ দূরত্বে (৫) (Click This Link)

চলবে…………
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৫৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×