সম্প্রতি আমার এক বন্ধু চীনের এক প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছে। বন্ধুটি নিউরোসায়েন্স নিয়ে কাজ করে। বিষয়টি আমার কাছে আনন্দদায়ক হলেও কিছুটা অদ্ভুত ঠেকল অন্য কারণে। একশ চল্লিশ কোটির চীনের হঠাৎ করে বাইরে থেকে কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে কেন কিংবা দিচ্ছে কেন? এই কেন’র উত্তর খুঁজতে গিয়ে…!!!
যে চীনকে আমরা দু-দশক আগেও চিনতাম নকলের ঠাকুরদার দেশ হিসেবে, সেই চীন এখন বিশ্বের সেরা বাৎসরিক প্যাটেন্ট আবেদনকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ দু দশক আগেও প্রথম বিশটি দেশের কাতারে ছিল না। বিস্ময়কর উত্থান!! যে দেশ কিছুদিন আগেও প্রযুক্তির জন্য পশ্চিমা দেশের দিকে কাতরভাবে চেয়ে থাকত, সেই কিনা এখন প্রযুক্তি রপ্তানির দেশে পরিণত হয়েছে। দুদশক আগেও যে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংঙ্কি-এ শতের ঘরেও ছিল না, সেখানে তারা এখন ঐতিহ্যে পিছিয়ে থাকলেও অক্সফোর্ড, হার্ভাডকে টেক্কা দেওয়ার পর্যায়ে চলে আসছে গবেষণায়। ২০২১ সালের কিউএস বিশ্বর্যাঙ্কি-এ সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১৫), পেকিং বিশ্ববিদ্যালয় (২৩), ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় (৩৪)। এই ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অনেকের কাছে পরিচিত নাম কারণ দু-দুশক আগেই এই নামডাকহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রিজিওনাল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আমাদের বুয়েটের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। আজ ফুদান কোথায় আর...। আজকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকের চেয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বেশি সংখ্যক। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক ছাত্র। অবিশ্বাস্য!!
যে দেশের মানুষ কয়েক দশক আগেও ঢাকা ও কলকাতার রাস্তায় ফেরি করে চীনা রদ্দা মাল বিক্রি করত, সেই চীনারা এত দ্রুত কীভাবে আকাশ ছুঁইয়ে ফেলছে? কেউ সাম্প্রতিককালে চীন গিয়ে থাকলে, বেইজিং, সাংহাই, কয়েকদশক আগে বসবাস শুরু হওয়া শহর হংকং-এর প্যারালেল শেনঝেন, গুয়াংঝুর শান-সৈকত দেখে তব্দা খাওয়ার দশা হবে। সেটা শুধু কংক্রিটের স্তুপ নয়, সাথে পরিচ্ছন্নতা এবং এখন পরিবেশের দিকেও তাদের নজর শুধু বিস্ময় জাগাতে পারে। চীনারা রকেট গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি সেক্টরে যা বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে? কারণ চীনাদের এই প্রযুক্তিগত উত্থান বিশ্বকে ভীত না করে পারেও না। সে বিষয়ে পরে আসছি।
তাদের নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রথম দিকে সমালোচনার স্বীকার হলেও সেটাই তাদের আজকে এই অবস্থাতে এনেছে তা বলতেই হয়। তারা গুগলের বিকল্প বাইদু, ফেসবুকের বিকল্প উইচ্যাট, ইউটিউবের বিকল্প টিকটক, আমাজনের বিকল্প আলীবাবা, উবারের বিকল্প ডিডি ইত্যাদি দাঁড় করিয়েছে। হুয়াই, জেটটিই’র মতো প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ফাইভ-জি’র মতো অত্যন্ত সফিস্টেকেটেড প্রযুক্তির চালিকাশক্তিরূপে আবির্ভাব হয়েছে। যাকে পশ্চিমারাও অস্বীকার করতে পারছে না। অনেকেই শাওমিকে গরীবের নেক্সট অ্যাপল বা স্যামসাং বলতে শুরু করেছে।
আর এগুলো সম্ভব হয়েছে ৯০’র দশক হতে কপি-পেস্টের ধারা থেকে বের হয়ে উদ্ভাবনী চিন্তাধারার বিকাশের মাধ্যমে। প্রথমেই তারা তাদের বিরাট ভোক্তাশ্রেণিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পণ হিসেবে তুলে ধরে এবং পশ্চিমা কোম্পানীগুলোকে বাধ্য করে প্রযুক্তি হস্তান্তরে। বিপুল মুনাফার হাতছানিতে পশ্চিমারাও আগ-পাছ না ভেবে চীনাদের কাছে তা সরবরাহ শুরু করে। এরপর চীন অনেক ক্ষেত্রেই রিভার্স ইঞ্জিনিয়াইং-এর দ্বারা কিছু প্রযুক্তির এদিক সেদিক করে নিজেদের পণ্য উৎপাদন শুরু করে।
একবার চিন্তা করুন, বাংলাদেশ নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করছে। সেখানে চীনা প্রতিষ্ঠান মেজর ব্রিজ কন্সট্রাকশনের দায়িত্ব পালন করছে। কর্ণফুলি নদীর নিচে টানেল তৈরি করছে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান। এখন ধরুন, বাংলাদেশের সরকার যদি এই ব্রিজ ও টানেল নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরের চুক্তি করত নিজেদের কিছু লোকসান করে হলেও তাহলে কী হত? পরবর্তী যমুনা নদীর নিচের টানেল কিংবা ভোলা সেতুটা কিন্তু নিজেদের কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারত। কিন্তু কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
যাহোক, এরপরের ধাপ হিসেবে চীনারা শিক্ষা ও গবেষণাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয় উল্লেখযোগ্য হারে। যেখানে ৯০’র দশকে জিডিপি’র ১%-এর নিচে ব্যয় করত, সেটা ২০০০’র পর বাড়তে বাড়তে এখন ২.৪% এর উপর ($৩৭৮ বিলিয়ন)। বৈশ্বিক গড়ের অনেক উপরে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণা ও উন্নয়নে বাংলাদেশের ব্যয় ০.০১% এর নিচে। এর থেকে চীনাদের সাথে আমাদের উদ্ভাবনী চিন্তার দৈন্যতা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। অতীতের ব্রেইন ড্রেইনকে নানামুখী আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজের মাধ্যমে ব্রেইন গেইনে মনোযোগী হয়েছে। চীনা এই দূরদর্শী চিন্তার ফলস্বরূপই আমার বন্ধুটির চীনে গমন। ফলে আমরা শত শত চীনা নির্মিত নব নব প্রযক্তির ঝলক দেখতে পাচ্ছি।
বিশ্বের স্টিলের প্রায় ৩০% চীনারা ব্যবহার করছে। এয়ারবাস, বোয়িং এর আদলে নিজেদেরকেও এভিয়েশন শিল্পেও তুলে আনতে কোমাক সিভিল বিমান তৈরি করেছে। ফিফথ জেনারেশন ফাইটার প্লেনের স্টিলথ টেকের মতো অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তিও আবিস্কার করে ফেলেছে। নিজেরাই টারবো ইঞ্জিন তৈরি করা শুরু করেছে। বিশ্বের মোট হাই-স্পিড রেললাইনের এক-তৃতীয়াংশই চীনে। নিজেদের প্রযুক্তিতেই ম্যাগলেভ লোকোমোটিভ তৈরি করছে। নিউক্লিয়ার রিএক্টর তৈরির প্রযুক্তি যে গুটিকয়েক দেশের হাতে রয়েছে চীনও তাদের মধ্যে অন্যতম। সেমি কন্ডাক্টর উৎপাদন শিল্পে পিছিয়ে থাকায় সেখানে শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এইসব প্রযুক্তি ও বিশাল ক্যাপিটাল কাজে লাগিয়ে গোটা বিশ্বে অবকাঠামো নির্মাণের হিড়িক ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোই তাদের এইসকল প্রযুক্তির প্রধান ভোক্তা চড়া ঋণের বিনিময়ে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।
সফট পাওয়ার ও হার্ড পাওয়ার দুই ক্ষেত্রেই তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।চীনা ছায়াছবি এখন প্রায় হলিউডের ছবির মতোই ব্যবসা করছে। কারণ কারিগরি দক্ষতায় তারা আর পিছিয়ে নেই।
একটি জাতি যে এত দ্রুতবেগে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিতে পারবে তা মনে হয় বিশ্বের কোনো অর্থনীতিবিদও ভাবতে পারে নি। তাই বিশেষজ্ঞরাও আর চীনের অর্থনৈতিক উল্লম্ফনকে, দরিদ্রতা হ্রাসকরণকে আলোচনায় আনতে চায় না। চীন পারছে কিন্তু ভারত পারছে না এ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে'র অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ প্রনব বর্ধনের একটি বিখ্যাত বই রয়েছে 'Awakening Giants, Feet of Clay' নামে।
এখন কথা হচ্ছে চীনাদের এই উত্থান যে রকম নিজ জনগণ উইঘুরদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। সেরকম আরো উত্থান কী ভবিষ্যতে শত্রু রাষ্ট্র ভেবে আসা জাপানের অধিকার হরণ করবে। এরপর সাউথ চায়না সী ধরে সাউথ ইস্ট এশিয়া এবং তিব্বতের পথ ধরে..। ভয়ের ব্যাপারই বটে। এখনই ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে এয়ারক্রাফট মোতায়নের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। স্ট্রিং অব পার্ল এর আওতায় মনে হয় বাংলাদেশও ভালো মতোই ছিল। পাশের দেশের হস্তক্ষেপে...এতে দেশের লং টার্ম লস হলো কি লাভ হলো তা ভবিষ্যৎ বলবে। যদিও মিত্র দেশ হিসেবে সিপেক নিয়ে চীনাদের ক্রেডিটে ডুবে রয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশই এখন চীনা লগ্নির জন্য হাঁ হয়ে থাকে। বিপদটাও সেখানে লুকায়িত। যে কোনো ভুল অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা শ্রীলংকা কিছুটা টের পেয়েছে হাম্বান্টোটা বন্দর নিয়ে। কেনিয়াসহ আফ্রিকার অনেক দেশই ভুগছে।
সম্প্রতি চীনের এই সম্ভাব্য আধিপত্যকে রোধ করতে ‘কোয়াড’ (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া) গঠন করা হয়েছে। ইউরোপও হয়ত দ্রুতই সেখানে যোগ দিবে। ইতোমধ্যে ফ্রান্স ইচ্ছে পোষণ করেছে। ওদিকে মস্কো বলছে অতীতের তিক্ততা ভুলে বেইজিং এখন তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ('দ্যা ডিপ্লোমেটে'র এই আর্টক্যালটা বেশ চমকপ্রদ)। এবং সেটা কাজেও দু দেশই প্রমাণ করছে নানারকম চুক্তি করে। এগুলো কী তিন দশক আগের মৃত সে বিশ্ব মেরুকরণের নব জাগরণের প্রাথমিক সোপান!!!
হংকং এর উপর খবরদারী, তাইওয়ানকে হুমকি, জাপানকে চাপে রাখা, উইঘুরদের অধিকারহরণ, মেকং-ব্রক্ষ্মপুত্র নদে ড্যাম নির্মাণের ফলে ভাটির দেশে অশান্তি (বাংলাদেশেও এর প্রভাব অবশ্যভাবী), দক্ষিণ চীন সাগরে স্প্রাটলি ও অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব। এত এত হেজেমনি বা আধিপত্যবাদি আচরণ নিয়েও এখন দেখার বিষয় এই আর্থ-সামাজিক ও টেকনোলজিক্যাল উল্লম্ফন মানব সভ্যতার জন্য আশির্বাদ হয় নাকি অভিশাপ?
*****************************************************************************************
@আখেনাটেন-এপ্রিল/২১
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:১৪