somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘পরাণ’-এ ‘হাওয়া’-র দোলায় কী বাংলা ছি:নেমার(!) যুগ বদল হতে যাচ্ছে?

২৮ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথমেই একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। সে অনেক আগের কথা। কবি ম্যাকবেল পাটোয়ারীর বাবা ছাতন ব্যাপারী গিন্নিকে না বলে গিয়েছে ‘গরম হাওয়া’ নামের একটি সিনেমা দেখতে। বহুমুত্র রোগের ভুক্তভোগী ছাতন ব্যাপারী সিনেমা শুরুর একটু পরেই ‘হিসু’ করার জন্য সিনেমা হল থেকে বের হন। যাওয়ার আগে অন্ধকারে পাশের সিটে বসে থাকা এক ভদ্রমহিলার পায়ে পাড়া দিলেন। ভদ্রমহিলা ‘ক্যাঁক’ করে উঠে ছাতনের গোষ্ঠী ধরে গাল পেড়ে সিনেমা দেখায় আবার কঠিন মনোযোগী হলেন।

একটু পরেই ছাতন ফিরে সেই মহিলাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হামি কী আফনের পাওত পাড়া দিয়েছিনু’?

মহিলা বললেন, ‘কেন, সে জন্য কী এখন মাফ চাইবেন’?

ছাতন প্রতিউত্তরে বললেন, ‘না, না, এটা ক্যাংকা কতা, আফনে ঐ বেটি ছাওয়াল হলে আফনের পাশের সিট-টাই হামার কিনা তাই’।

এখানে বেশ কয়েকটি জিনিস লক্ষ্য করা যায়। আগে সিনেমা হল ছিল। ছাতন ব্যাপারীর মতো খাটাস লোকেরাও গিন্নিদের ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখছিল। খাটাস কর্তৃক পায়ে ‘ক্যাঁক’ করে পাড়া দেওয়ার চল ছিল। সিনেমায় ছল ছিল। অন্ধকারে মানুষে গিজগিজ করা সিঙ্গেল স্ক্রিনের হল ছিল। হল-র পাশে মল ছিল। সিনেমা দেখার মানুষের ঢল ছিল। সিনেমা পাড়ায় কলহল ছিল।

আর এখন ছাতনদের বয়স হয়েছে। ছাতন ব্যাপারীর সুপুত্র(!) জেনারেশন জেড-এর কবি ম্যাকবেল পাটোয়ারীদের আর সিনেমার মাঝখানে মূত্র বিসর্জনের দরকার হয় না। কারণ মূত্র বিসর্জনের জন্য আর বাইরে যাওয়ার দরকার নাই। কারণ ‘মুত্র’ এখন ‘বাংলা সিনেমা’র মাথায় করা হয়েছে। চারিদিকে ইউরিনের কটূ গন্ধ। কিংবা সিটে বসে থেকেও করা যায় শূর্ন্যগর্ভ হল-এ। অন্ধকার হল-এ এখন আর কোনো রমনীর পায়ে পাড়া দেওয়ার সুযোগই নাই। ফাঁকা। হতাশা। বিনোদনহীন। তামিল। তেলুগু। আক্ষেপ। ইস, আমাদের যদি…? কিন্তু চোখ খুলেই হিরো আলম কিংবা অনন্ত জলিলের ‘অসম্ভবকে সম্ভবের দেশে’ বিরাট চলমান সিনেমার নর্তন-কুর্দনের আয়োজন…গাঁটের পয়সা ভুসুল করে পর্দারটা আর কে দেখে?



শিল্প-সংস্কৃতির উৎকর্ষতা একটি বিকাশমান সমাজ, জাতি ও দেশের হাড়ের গঠন কতটা পাকাপোক্ত তা নির্দেশ করে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে যখন এসবের একটি সুষম মিথস্ক্রিয়া হয়, তখনই বুঝে নিতে হবে যে জাতির ভবিষ্যৎ দিনের আলোর মতোই ফকফকা। কারণ এগুলো স্রেফ কিছু পাগলাটে মানুষের ক্রিয়েটিভ চিন্তাভাবনায় শুধু নয় বা এর অন্তর্নিহিত ‘সফট পাওয়ার’ জাতিকে নতুন করে বাঁচার, উন্নতির শিখরে উঠার কিংবা বিশদ স্বপ্ন দেখার পথ উন্মোচনই নয়, মসৃনও করে তোলে।

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য দেশের ১৮ কোটি (কাগজে-কলমে সাড়ে ১৬ কোটি) ও ভারতের ১০ কোটিসহ মোট ২৮ কোটি বাঙ্গালীর এই দিকটি নিয়ে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকেরা কখনই সেভাবে চিন্তা করে নি কিংবা বলা চলে চিন্তা করার জন্য সে বোধটুকু (নাকি মেধা?) থাকার দরকার সেটাই হয়ত জাগ্রত হয় নাই। কেউ কেউ চাইলেও হয়ত তথাকথিত সিস্টেমের প্যাঁচে পড়েছে কিছু কূপমূন্ডুক অথবা সিস্টেমের উপরসারিতে বসা অপদার্থের কারণে। ফলে এত এত সম্ভাবনাময় একটি শিল্পকে কী নিদারূণ অবহেলায় আস্তাকুঁড়ে পর্যবসিত করেছি, করছি।

এত এত জনসংখ্যা যে একটি বিশালাকার বাজার, সেটি বোঝার মতো মনে হচ্ছে দেশে কেউ নেই? বাংলা ভাষাভাষীর চেয়ে তিনভাগের এক ভাগ মানুষ নিয়েও এক তামিল কিংবা তেলেগু সিনেমাও শত শত কোটি টাকা ব্যবসা করছে। তাঁদের চলচ্চিত্র তারকাদের নাম বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে। অথচ ২৮ কোটি লোকের ভাষা বুঝার মতো ক্ষমতা দেশের নীতিনির্ধারকদের নেই। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে তিন দশক আগেও ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো ছবি আজকের রেইট ধরলে ১০০ কোটি টাকার উপর ব্যবসা করেছে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ সিনেমা ১ কোটি টাকা ব্যবসা করতে পারে না।

এই ড্রামা সিরিয়াল, সিনেমা উদ্ভুত ‘সফট পাওয়ার’ যে কতটা ব্যাপক তা অনুধাবন করার মতো মাথা কী একটাও নেই জাতির কান্ডারিদের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়া ছোট্ট একটি দেশ, অথচ এই দেশটির গান, ড্রামা সিরিয়াল, সিনেমা গোটা বিশ্বকে বুঁদ করে রেখেছে। আর এর ফলে দেশেরও পজিটিভ ব্রান্ডিং হচ্ছে অকল্পনীয়। এতে পর্যটন খাতেও জোয়ার লেগেছে এসব দেশে।

তুরস্কের কথা বলা যেতে পারে, টার্কিশ সিরিয়ালগুলো গোটা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব সিরিয়ালে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখানোর পাশাপাশি নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরায় গোটা বিশ্ব থেকে পর্যটকেরা ছুটে যাচ্ছে টার্কিতে। যে দেশ দু-দশক আগেও টপ ২০ দেশের মধ্যে বিদেশী পর্যটক ভ্রমণের তালিকায় ছিল না, তারা এখন টপ ৫-এর মধ্যে ঢুকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বছরই হয়ত এ লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। বিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে এ খাত থেকে। পাশাপাশি ড্রামা সিরিয়াল রপ্তানির মাধ্যমেও বিলিয়ন ডলার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখুন। দেশে সারা বছরে পর্যটক আসে মোটে দেড় লাখ। উগান্ডাতে উগাউডের সামান্য ভূমিকা ও অন্যান্য পজিটিভ ব্রান্ডিং-এ ফি বছর বিদেশী পর্যটক যায় ১৫ লাখ। পার্থক্যটা কী গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় না? বাঙ্গালীর হাজার বছরের সমৃদ্ধ কৃষ্টি-কালচারের বৈশ্বিক প্রচারের অভাবে দেশকে ইতিবাচক ব্রান্ডিং করতে পারছি না। তা পারলে এক ভারত থেকেই বছরে ১০ লাখ পর্যটক টেনে আনা সম্ভব হত সীতাকুন্ড, ঢাকেশ্বরী মন্দির কিংবা কক্সবাজারের গল্প শুনিয়ে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন বৃহৎ পরিসরে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি তথা গান-নাটক-সিনেমা শিল্পকে বৈশ্বিক রূপ দিতে পারব। এতে দেশের ইতিবাচক ইমেজ বৃদ্ধির ফলে দেশের ব্রান্ডিং হবে, যেমনটা পোশাকশিল্পের কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে কিছুটা হলেও পরিচিত।

আর এর জন্য দরকার একটি চমৎকার সরকারি নীতিমালা ও খোলনলচে পালটে ফেলা উন্নয়নের প্রবাহ। এবং সিনেমাও যে একটি বৃহৎ শিল্প তা অনুধাবন করা। এখান থেকেও যে বছরে শত কোটি টাকা উপার্জন করা যায় তার পথ তৈরি করা যাতে অঢেল টাকার মালিকেরা এই খাতেও লগ্নি করে নিজেদের পকেট ভরতে পারে। নাম কামাতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে রাজারা যখন প্রজাদের বেশিরভাগই অ-টেকসই উপায়ে নির্মিত সেতু-কালভার্ট, ফ্লাইওভার আর বিল্ডিং আকাশ থেকে দেখিয়ে জাতিকে মুক্তির পথ দেখাবে, তখন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষ্টি-কালচার এসবের টেকসই উন্নয়নের কী আর দরকার আছে?

তারচেয়ে এই ভালো হিরো আলম কেন বিকৃতভাবে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে জাতির সংস্কৃতিতে কলঙ্ক লেপন করবে, তাকে ধরে প্যাঁদানি দিয়ে জাতির মুখ রক্ষা করি তথা সংস্কৃতি উদ্ধার করি? এতেই জাতির মঙ্গল নিহিত…?

*************************************************************
@আখেনাটেন-আগস্ট/২০২২
ছবি: এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৫:০০
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×