ছবি - wallpapercave.com
দুনিয়ায় প্রচলিত সকল ধর্ম একটি অনুশাসন, একটি জীবন/শাসনব্যবস্থা। মানুষের সমগ্র জীবনের সার্বিক কল্যাণের দিকনির্দেশনা রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে। মানুষের মন অনেক কিছু পেতে বা করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে ইচ্ছার বাস্তবায়ন সামজিক নিয়ম-নীতির মাঝে ও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকেই করতে হবে - এটাই সকল ধর্মের মূল কথা। ধর্মীয় অনুশাসন কিংবা সামাজিক শিষ্টাচার মোতাবেক যদি নিজেকে কোনো ব্যক্তি পরিচালিত না করে, নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তখনই সৃষ্টি হয় পারিবারিক-সামাজিক বিপত্তি ও বিশৃঙখলা । মানুষ সামাজিক জীব। এ সমাজ-সামজিকতা, রীতি-নীতি-শিষ্ঠাচার একদিনে গঠিত হয় নাই,তার পিছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের পরিশ্রম-অনুশাসন ও জ্ঞানী-গুনীদের সাধনা। বহুসময় ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা সমাজ-সভ্যতা এখন কার্যত আধুনিকতার নামে বিলীন হতে বসেছে।কথিত আধুনিকতার নামে মানুষের জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ধর্মের বন্ধন শিথিল হয়ে যাচছে । এর ফলে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও ঘুষ-দুর্নীতির মত অপরাধ সমাজে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে পাশাপাশি আরো অন্যান্য অপরাধের সৃষ্টি করছে। অথচ দুনিয়ায় প্রচলিত সব ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থেই ন্যায়ের প্রতিপালন ও অন্যায়ের অনুসরন না করা তথা পরিহারের কথা বলা হয়েছে।
বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে আধুনিককালে মানুষ এখন ধর্মকে ও ধর্মীয় বিধি বিধানকে নিজেদের জীবনে অবশ্যপালনীয় বিষয় বলে গণ্য করতে চাচছেনা। মানুষের নিকট ধর্ম এখন ঐচ্ছিক বিষয় হয়ে গেছে। ধর্ম পালনে শিথিলতার ফলে আমাদের সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজে ও পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়ে যাছছে এবং অভ্যন্তরীণ শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে পরপুরুষ বা পর নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচছে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে আন্তরিকতা কমে যাচছে ফলে উৎপত্তি হচছে পারিবারিক বিপর্যয়ের। আর তাইতো পত্রিকা খুললেই দেখা যাচ্ছে, পরকীয়ার কারণে মা কর্তৃক সন্তান খুন, বাবা কর্তৃক ছেলে খুন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন। এমনকি, বাবা কর্তৃক মেয়েকে ধর্ষণ,শ্বশুর কর্তৃক পুত্রবধূকে ধর্ষণ প্রভৃতিসহ চরমভাবে ঘৃণা করার মতো অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত আমাদের আশে-পাশে। বিস্তার লাভ করছে সমকামিতার মত ঘৃণ্য কাজেরও।
পৃথিবী যখন পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখনই তাতে মহামারী শুরু হয়। পবিত্র কুরআন শরিফের ভাষ্য মতে এ কথাটি সত্য। মানুষ পাপ করলে পরকালে অত্যন্ত মন্দ পরিণাম হবে,এটা সবারই কম-বেশি জানা। তবে পৃথিবীর জীবনেও পাপের কারণে ভোগ করতে হয় মন্দ পরিণাম। কোরআন ও হাদিসে এ কথা বার বার বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যত বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তার সব কিছু মানুষের পাপের ফসল। খরা, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, প্লাবন, মহামারি প্রভৃতির মূল কারণ হলো পাপ ও গুনাহ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,"মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে"। (সুরা রুম, আয়াত - ৪১)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক মানবজাতিকে বহুবার অশ্লীলতা, অনাচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন দুনিয়ায় মানুষের দ্বারা সংগঠিত সকল কাজের সুক্ষাতিসুক্ষ হিসাব তিনি নিবেন। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ আল কোরআনে, " আল্লাহর জন্যই যা আছে আসমানসমূহে ও যা আছে যমীনে। তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ সেগুলোর হিসেব তোমাদের কাছ থেকে নিবেন । অতঃপর যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দিবেন আর আল্লাহ সব কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান "। (সুরা আল বাকারা, আয়াত - ২৮৪)।
জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ও অশ্লীলতাকে রোধ করার জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত জীবনব্যবস্থা, ইসলাম পারিবারিক ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আর ইসলামের দৃষ্টিতে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলোকে নিয়ে মহান আল্লাহপাক নাজিল করেছেন এক কিতাব - আল কোরআন। যেখানে মানবজাতির জন্য রয়েছে সংবিধান তথা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ বানী মানবজাতির হেদায়েত স্বরুপ এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর দিকনির্দেশনা আল কোরআনে রয়েছে।
মানুষের এক জীবনে যা দরকার, তার সবই সাজানো রয়েছে আল কোরআনের পরতে পরতে। সুস্থ সুন্দর সুখী পরিতৃপ্ত জীবনের জন্যে যা প্রয়োজন, আল কোরআনের পাতায় পাতায় রয়েছে তারই দিক-নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনে মানব জীবনের করণীয় কাজের দিকনির্দেশনার পাশাপাশি মানবজাতির প্রতি উপদেশ স্বরুপ বেশ কিছু আয়াত আছে। আসুন আমরা সেগুলো সম্পর্কে জানি -
ছবি - sangbadchorcha.com
আল কোরআনের উপদেশাবলী
১। লজ্জা ও শালীনতার সঙ্গে চলো।(সুরা নুর, আয়াত - ৩০ & ৩১)।
"মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার"।
২। মা-বাবার ঘরে প্রবেশের আগেও অনুমতি নাও।(সুরা নুর, আয়াত - ৫৮ & ৫৯)।
"হে মুমিনগণ, তোমাদের ডানহাত যার মালিক হয়েছে এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি তারা যেন অবশ্যই তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে। ফজরের সালাতের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখ, এবং ‘ইশার সালাতের পর; এই তিনটি তোমাদের (গোপনীয়তার)সময়। এই তিন সময়ের পর (অন্য কোন সময়ে বিনা অনুমতিতে আসলে) তোমাদের এবং তাদের কোন দোষ নেই। তোমাদের একে অন্যের কাছে যাতায়াত করতেই হয়। এভাবে আল্লাহ তোমাদের উদ্দেশ্যে তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।আর তোমাদের সন্তান-সন্ততি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমনিভাবে তাদের অগ্রজরা অনুমতি প্রার্থনা করত। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়"।
৩। বিনম্র হয়ে চলাফেরা করো । (সুরা ফোরকান, আয়াত - ৬৩)।
"রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম''।
৪। মানুষের প্রতি দয়া করো।(সুরা কাসাস, আয়াত - ৭৭)।
"আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না"।
৫। সংকটকালেও আল্লাহর পথে অটল থাকো । (সুরা ফোরকান, আয়াত - ৮৭)।
ইরশাদ হয়েছে,"তোমার প্রতি আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা যেন তোমাকে কিছুতেই সেগুলো থেকে বিমুখ না করে। তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহ্বান করো এবং কিছুতেই মুশরিকদের দলভুক্ত হইয়ো না"।
৬। সমকামিতা জঘন্যতম অপরাধ।(সুরা আনকাবুত, আয়াত - ২৯)।
"তোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে গর্হিত কর্ম করছ? জওয়াবে তাঁর সম্প্রদায় কেবল একথা বলল, আমাদের উপর আল্লাহর আযাব আন যদি তুমি সত্যবাদী হও"।
৭। সৎ কাজের আদেশ করো।(সুরা লোকমান, আয়াত - ১৭)।
"হে বৎস, নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ"।
৮। মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না । (সুরা লোকমান, আয়াত - ১৮)।
"অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না"।
৯। কণ্ঠস্বর নিচু রাখো । (সুরা লোকমান, আয়াত - ১৯)।
"পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর"।
১০। নারী অশালীনভাবে নিজেকে প্রদর্শন করবে না।(সুরা আহজাব, আয়াত - ৩৩)।
"তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে ।পূর্ববর্তী জাহেলি (বর্বর) যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে"।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে আল কোরআনের আলোকে জীবন গড়ার ও চলার তওফিক দান করুণ
চলবে -
===============================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ১১ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ১০ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৯ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৮ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৭ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৬ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৫ Click This Link
আল কোরআন সংকলন-সংরক্ষণের ইতিহাস - Click This Link
আল কোরআন এর ২৬ টি আয়াত বাতিল চেয়ে আদালতে দায়ের করা রিট বাতিল করলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
- Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৪ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ৩ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ২ Click This Link
আল কোরআনের উপদেশাবলী - পর্ব - ১ Click This Link